নতুন করে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে সুভাষকে। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে সংগৃহীত।
গত শতকের আটের দশকের তখন শেষবেলা। মুক্ত অর্থনীতির ছোঁয়া ও পণ্যরতির ধোঁয়া বাঙালি জীবনে তখনও এসে লাগেনি। হাওড়া স্টেশনে এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে লোকাল ট্রেনের পেট থেকে উপচে নেমে আসা ভিড় ঘামতে ঘামতে ছুটত কর্মক্ষেত্রে। রাজনীতির কারবারিরা জনজীবনকে যে আর কোনও ভাবেই আলোর পথযাত্রী করে তুলতে চান না সে কথা তখন সকলেই জানে। হতশ্বাস জনজীবনে প্ল্যাটফর্মের দেওয়ালে কালো আখরের দু’টি লিখন তখন শুধু কৌতুক ও ব্যর্থ আশার সৃষ্টি করত। ‘সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে’— এ কথা লিখে রাখতেন জনৈক কে সি পাল মশাইয়ের অনুগামীরা, ডেলি প্যাসেঞ্জার বাঙালি তা দেখত আর হাসত। দ্বিতীয় লিখনটির দিকে তাকিয়ে আশার দীর্ঘশ্বাস ফেলত। ‘সাবধান! নেতাজি ঠিক ফিরে আসবেন।’
আহা! সত্যি যদি এমন হত! নেতাজি, বিমান দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন বাঙালি তা বিশ্বাস করতে চায় না। রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রের বঞ্চনার যেমন কোনও শেষ নেই তেমনই সুভাষের প্রতি নেহরু-গাঁধীর বঞ্চনারও যেন শেষ ছিল না! বাঙালির আঞ্চলিক আবেগ উস্কে উঠত। সর্বরোগহরণকারী এক জননায়কের স্বপ্ন দেখত তারা– নাটকীয় ভাবে ফিরে আসবেন তিনি, হয়তো ঘোড়ায় চেপে— নেতাজি, তাদের প্রিয় হারিয়ে যাওয়া নেতাজি। এই স্বপ্নের মধ্যে আবেগ ছিল, যুক্তি ছিল না। সুভাষচন্দ্রকে বাঙালি হারিয়ে যাওয়া নায়ক হিসেবে ভেবেছে, তাঁর কর্মকাণ্ডের যুক্তি লেখাপত্রের নীতি বাঙালিকে তেমন আকর্ষণ করেনি। সুভাষের রাজনীতির মধ্যে যে অনুশীলন, আত্মনির্মাণ, অসাম্প্রদায়িকতা ছিল, সে সব নিয়ে বাঙালি বড় একটা ভাবে না। তিনি একা ফিরে এলে এক ধাক্কায় সবাইকে সোজা করে দিতে পারেন, এই বিশ্বাসের মধ্যে বাঙালির স্বপ্নপূরণের বাসনা খেলা করে যায়। হতোদ্যম, আত্মবিশ্বাসহীন জনসমষ্টি একক নায়কের মৌতাতে বুঁদ হয়ে থাকতে চায়।
গত শতকের আটের দশক এখন অতীত। হাওড়া স্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের কালো দেওয়াল লিখন দু’টি মুছে গেছে। জনৈক কে সি পালের ভক্তরা আর বলেন না, সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে, সুভাষ ফিরে আসবেন এ কথাও সময়ের বহরে আর বিশ্বাসযোগ্য নয়। ১৮৯৭ সালে জন্মেছিলেন তিনি, দীর্ঘজীবী হলেও একশো ডিঙিয়ে কত দিন আর বেঁচে থাকে মানুষ! ভারতীয় রাজনীতির প্রধান চরিত্ররা এখন প্রায় সবাই স্বাধীনতার পরের জাতক। তাঁরা অবশ্য অনেকেই পরাধীন ভারতের প্রয়াত জননেতাদের নতুন করে মূল্যায়ন করছেন, সেই মূল্যায়নের নব্যধারায় অনেকেই ‘মূর্তিমান’ হয়ে উঠছেন, নতুন করে গুরুত্ব লাভ করছেন। সুভাষচন্দ্র ও তাঁর আজাদ হিন্দ বাহিনীর ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটেনি। সুভাষের রাজনৈতিক আদর্শের বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন হোক বা না-হোক তাঁকে নতুন করে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। যেন গোপন এক টানাপড়েন কাজ করে যাচ্ছে। নেহরু-গাঁধী ও কংগ্রেস সুভাষকে তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা দেননি, এ বার তাই অকংগ্রেসি জমানায় সুভাষের প্রকৃত প্রাপ্য প্রদানের পালা।
বইয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে খুলতে থাকে গুমনামী বাবার কাহিনি।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধে সুভাষের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর ত্যাগ ও দেশপ্রেম গভীর। প্রশাসনিক কৃতিত্বও কম নয়। কলকাতা কর্পোরেশনে যে কাজের সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন তা দক্ষতার সঙ্গে সামলেছিলেন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের অহেতুক তোষণ করতেন না, কাজের সুযোগ দিতেন। রণনীতি ও সামরিক পরিকল্পনাতেও তাঁর দোসর মেলা ভার। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে রণকৌশল তিনি গ্রহণ করেছিলেন তা নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে, তবে ত্যাগে ও দেশপ্রেমে তাঁর বিন্দুমাত্র খাদ ছিল না। সুভাষের বিচারে অবশ্য এই কথাগুলিই সব কিছু নয়। জনমানসে থেকে থেকেই একটা প্রশ্ন ওঠে, কী হয়েছিল সুভাষের? তিনি কি বিমান দুর্ঘটনায় সত্যি প্রাণ হারিয়েছিলেন?
এই কী হয়েছিল প্রশ্নটির সঙ্গে পরাধীন ভারতের যোগ নেই, যোগ রয়েছে স্বাধীন ভারতের রাজনীতির। সুভাষ বেঁচে থাকলে স্বাধীন ভারতে কোন দায়িত্ব পেতেন? সুভাষের সঙ্গে যেমন আচরণই করুন না কেন গাঁধী, মানুষটি যে দাঙ্গা-কবলিত ভাঙা দেশের মানচিত্রে ক্রমশই একা হয়ে উঠছিলেন তা বোঝা যাচ্ছিল। গাঁধী নিহত হলেন। আর নেহরু? আম বাঙালি ও নেহরু-বিরোধী ভারতীয়রা মনে মনে নেহরু-সুভাষ দ্বৈরথের চিত্রনাট্য রচনা করে। বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষ মারা যাননি। তা হলে? নানা কাহিনি পল্লবিত হয়। সুভাষ স্তালিনের রাশিয়ায় বন্দি এ খবর রটে। ভারতে সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে তিনি দিনযাপন করছেন এ খবর মাঝে মাঝেই শিরোনামে। শৈলমারীর সাধু, গুমনামী বাবা, আরও কত জন— সুভাষের নানা অবতার স্বাধীন ভারতে মাঝে মাঝেই উঁকি দেন।
আরও পড়ুন: মতান্তর পৌঁছয়নি মনান্তরে
সন্ন্যাসীদের মধ্যে গুমনামী বাবার সুভাষ হওয়ার সম্ভাবনাই যে সবচেয়ে বেশি তাই ধাপে ধাপে প্রমাণ করতে চেয়েছেন দুই লেখক চন্দ্রচূড় ও অনুজ তাঁদের বই ‘কেনানড্রাম’-এ। ‘কেনানড্রাম’ শব্দের অর্থ জটিল অমীমাংসিত প্রশ্ন। সুভাষের কী হয়েছিল তা জানার জন্য কমিশনের পর কমিশন বসেছে। সত্যতা যাচাইয়ের দায় যেন তত নয়, বিষয়টিকে খানিকটা খুলে ও খানিকটা চেপে বিমান দুর্ঘটনার তত্ত্ব প্রমাণই যেন লক্ষ্য। পেছনে নানা রাজনৈতিক চাপ ক্রিয়াশীল। এই সব কথা সাজাতে সাজাতে দুই লেখক গুমনামী বাবার কাহিনিটি নাটকীয় ভঙ্গিতে খুলতে থাকেন। জাল প্রতাপচাঁদ আর ভাওয়াল সন্ন্যাসীর কাহিনির সঙ্গে গুমনামী বাবার কাহিনির যে মিল নেই তা জানাতে ভোলেন না। জাল প্রতাপচাঁদ আর ভাওয়াল সন্ন্যাসী দু’জনেই ফিরে এসে তাঁদের আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত, আইনের দ্বারস্থ। আইন বিচারসভা বসায়। ফিরে আসা পুরুষ আসল না নকল তাই নিয়ে বিচার চলে। জনমানস দ্বিধা বিভক্ত, উদ্বেল।
এই জনপ্রতিক্রিয়ার চরিত্র বোঝার জন্য ইতিহাসবিদ গৌতম ভদ্র ও সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বই লেখেন। আসল না নকল প্রমাণ উদ্দেশ্য নয়, আখ্যানের নানা স্তর কেমন করে ও কেন গড়ে উঠছে তাই দেখাতে চেয়েছেন তাঁরা। গুমনামী বাবা মোটেই আত্মপরিচয় দিতে ব্যস্ত নন। গোপনে থাকেন, এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যেতে হয় তাঁকে। প্রথম প্রথম প্রকাশ্যে আসতেন, ক্রমে আসা বন্ধ করে দিলেন। পাছে লোকে তাঁকে সুভাষ বলে চিনে ফেলে! দুই লেখক অবশ্য তাঁকে সুভাষ বলেই চিনতে ও প্রমাণ করতে চান। প্রমাণের নানা পন্থা। গুমনামী বাবা আর সুভাষের হাতের লেখা যে এক হস্তলেখাবিশারদ তা বলে দিয়েছেন। বাবার কাছে যাঁরা যেতেন সেই বাঙালি রাজনীতিবিদদের সঙ্গে গুমনামী বাবার পত্রালাপের সূত্র পরোক্ষ প্রমাণ হিসেবে খাড়া করা হয়েছে। সুভাষের পূর্বজীবনের নানা প্রসঙ্গ উঠেছে। গুমনামী বাবার জানা সেই প্রসঙ্গগুলি সুভাষ ছাড়া আর কারও জানার কথা নয়। পুরনো রাজনৈতিক কর্মী যাঁরা স্বাধীন ভারতে জীবিত ছিলেন তাঁদের কেউ কেউ নিঃসন্দিহান তিনিই সুভাষ। সবাই অবশ্য মেনে নেননি এ কথা। গুমনামী বাবা আদতে ছদ্মবেশী হত্যাকারী। সিআইএ-র গুপ্তচর, আনন্দমার্গী, অকংগ্রেসিদের সাজানো সুভাষ এমন কথাও উঠেছে। এই সব কথা এক রকম ভাবে শেষ হয়েছে বাবার মৃত্যুতে। ১৯৮৫-র সেপ্টেম্বরে বাবার প্রয়াণ, গোপনে দাহ করা হয়েছে তাঁকে। তবে কথা যেখানে শেষ সেখান থেকেই আবার কথা শুরু। বাবার ব্যবহৃত জিনিস দেখার সুযোগ মিলেছে। সাহিত্য পাঠে অক্লান্ত বাবা গান শুনতেন। আধ্যাত্মিক সাধনা করতেন। স্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক অবক্ষয় তাঁকে ক্লান্ত করত। অনুগামী লীলা রায়কে বাবা তাঁর হতাশার কথা জানাতেন। বাবার ব্যবহৃত জিনিসের যে তালিকা বইতে আছে তাতে হেমন্তের গানের ক্যাসেট আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই পর্যন্ত রয়েছে।
আরও পড়ুন: শিশুর চিঠিও অবহেলিত হয়নি
গুমনামী বাবার এই জীবন-বৃত্তান্ত পড়তে পড়তে কতগুলি কথা মনে হয়। হাওড়ার স্টেশনের দেওয়াল লিখনকে সত্য বলে প্রমাণ করার কোনও বাসনাই এই মানুষটির ছিল না। গুমনামী বাবা বা সুভাষ তিনি যে-ই হন না কেন স্বাধীন ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা সম্বন্ধে তিনি সচেতন, তবে সে বিষয়ে তাঁর কোনও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা গ্রহণের ইচ্ছা ছিল না। মাঝে মাঝে গোপনে রাজনীতিবিদদের কেউ কেউ তাঁর কাছে আসেন, তাঁর অস্তিত্বের খবরও রাখেন। তবে এইটুকুই। এই আত্মগোপনের চিত্রনাট্য আলাদা করে সুভাষচন্দ্রের মূল্যায়নে আমাদের সহায়তা করে না।
গুমনামী বাবার কিস্যা হয়তো সুভাষের প্রতি বঞ্চনার বেদনাকে গভীর করে, সুভাষকে ট্র্যাজিক নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়। গণতন্ত্রে জননায়কের প্রয়োজন, তবে কাল্পনিক একনায়কের হাতে নিজেদের সব দায়িত্ব সমর্পণ করার কথা ভাবে যারা সেই জনগোষ্ঠী গণতন্ত্রের দায়িত্বকে অস্বীকার করে। সুভাষের রাজনীতির আদর্শ জনগণতান্ত্রিক বলেই মনে হয়, তাঁকে সর্বরোগহর একনায়ক হিসেবে দেখা হোক এ বোধকরি তিনিও চাইতেন না।
(লেখক বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক)
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube Channel - এ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy