দেশভাগের সিনেমা
সম্পা: সুশীল সাহা
৪৫০.০০
সোপান
নিমাই ঘোষের মৃত্যুর পর সত্যজিৎ জানিয়েছিলেন, “তিনি ছিলেন ক্যামেরাম্যান, তবে মনে মনে তিনি ছবি পরিচালনার ইচ্ছা পোষণ করতেন... পার্টিশান নিয়ে ‘ছিন্নমূল’ ছবি পরিচালনা করেন নিমাই ঘোষ। বাংলা ছবিতে বাস্তবধর্মিতার প্রথম উদাহরণ এই ছবি।” আর মৃণাল সেন লিখেছিলেন, “পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি চিরকালের মতো ছেড়ে নিরাশ্রয় বাস্তুহারার দল কলকাতার ইট পাথরের রাস্তায় কীভাবে মাথা খুঁড়ে মরেছে, কীভাবে শিয়ালদা’র প্ল্যাটফর্মের নোংরা পরিবেশে তারা রাতের পর রাত কাটিয়েছে, খিদের তাড়নায় তারা রাস্তায় রাস্তায় ছুটে বেরিয়েছে কাজের আশায়— ‘ছিন্নমূল’ সেই সব বুকভাঙা ঘটনারই জীবন্ত দলিল।”
১৯৪৮ সালেই ছবিটির চিত্রগ্রহণের কাজ শুরু করেন নিমাইবাবু, ১৯৫১-তে মুক্তি পায় ছবিটি। নিমাইবাবু যে তাঁর ছিন্নমূল-কে ‘সামাজিক-ঐতিহাসিক কাঠামোয় প্রতিষ্ঠিত করেছেন’— শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই আলোচনাতেই শুরু হয়েছে এ বইয়ের বিন্যাস, পাশাপাশি শিবাদিত্য দাশগুপ্তের রচনায় ওই ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতেরই অবতারণা। আর, সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় খেয়াল করিয়ে দেন, রুশ চলচ্চিত্রকার পুদভকিন নিমাইবাবুর এই সৃষ্টি নিয়ে প্রবন্ধ লেখেন কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র প্রাভদা-য়।
ঋত্বিক ঘটক জন্মেছিলেন যে বিড়ম্বিত কালে, তাতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গার সঙ্গেই দেশভাগও ওতপ্রোত ছিল, ইতিহাসের সেই সামাজিক বিপর্যয়ের স্মৃতিকেই তিনি নিজের ছবিগুলিতে গেঁথে দিয়েছিলেন পঞ্চাশের শেষ থেকে ষাটের দশকের প্রথম পর্বে— বাড়ি থেকে পালিয়ে, মেঘে ঢাকা তারা, কোমল গান্ধার, সুবর্ণরেখা। ঋত্বিকের এই সব ছবি যেমন আমাদের দেশভাগের ক্ষতে উপশম হয়ে ওঠে না, তেমনই আবার ক্ষত উস্কে দেয় না; এক গভীর বিষাদের দিকে ঠেলে দেয়। তাঁর সেই স্মৃতি যেন সঞ্চিত থাকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য, যারা সুবর্ণরেখা-র হরপ্রসাদের ভাষায়, “যুদ্ধ দ্যাখে নাই, মন্বন্তর দ্যাখে নাই, দাঙ্গা দ্যাখে নাই, দেশভাগ দ্যাখে নাই।” বৌধায়ন চট্টোপাধ্যায় আর ইরাবান বসুরায় তাঁদের আলোচনায় চিহ্নিত করেন ঋত্বিকের ছবির এই স্মৃতির বিষাদবৃক্ষকে। অন্য দিকে রাজেন তরফদারের ছবি পালঙ্ক-তে কোথায় রাজেনবাবুর দেশভাগ-ভাবনা নিমাইবাবু বা ঋত্বিকের থেকে আলাদা হয়ে আসছে, সে আলোচনা আছে সোমেশ্বর ভৌমিকের লেখায়।
এ ভাবেই কুমার সাহানি, বিদ্যার্থী চট্টোপাধ্যায়, নবীনানন্দ সেন, সুরঞ্জন রায়, বিপ্লব বালা, চণ্ডী মুখোপাধ্যায় প্রমুখের কলমে এম এস সথ্যুর গরম হাওয়া, জি অরবিন্দনের বাস্তুহারা, ভীষ্ম সাহানি ও গোবিন্দ নিহালানির তমস, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের তাহাদের কথা, গৌতম ঘোষের শঙ্খচিল, সুপ্রিয় সেনের আবার আসিব ফিরে, তানভীর মোকাম্মেলের সীমান্তরেখা, দীপা মেহতার দ্য আর্থ ১৯৪৭, নন্দিতা দাশের মান্টো, গুরিন্দার চাড্ডার পার্টিশান-সহ গুরুত্বপূর্ণ দেশভাগ সংক্রান্ত ছবির আলোচনা।
সম্পাদক সুশীল সাহা জানিয়েছেন, “দেশভাগের মতো মর্মান্তিক ব্যাপারও এখানকার চলচ্চিত্রের বিষয় হিসেবে কমবেশি এসেছে একান্তই অনিবার্যভাবে।” সমস্যাটা বোধ হয় সেখানেই, বিপর্যয়ের অনির্বাযতায় দেশভাগের মতো বিষয় হয়তো আমাদের চলচ্চিত্রকারদের হাতের কাছে এসে গিয়েছে, কিন্তু তাঁরা তাঁদের ছবিতে বিষয়টিকে ঠাঁই দিতে বাধ্য থাকেন যতটা, ততটা জিজ্ঞাসু থাকেন কি বিষয়টি সম্পর্কে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy