পশ্চিম থেকে পূর্ববঙ্গ/ দেশবদলের স্মৃতি, সম্পা: রাহুল রায়। গাঙচিল, ৩৫০.০০
এ যাবৎ ১৯৪৭ সালের দেশভাগ নিয়ে যত ঐতিহাসিক এবং সমাজতাত্ত্বিক আলোচনা হয়েছে, তার অধিকাংশই পঞ্জাবকেন্দ্রিক। পুবের উদ্বাস্তুদের সংখ্যা ও যাত্রাপথের ভয়াবহতা তুলনামূলক ভাবে কম ছিল বলেই হয়তো বঙ্গ-বিভাজন এই আলোচনায় কম জায়গা পেয়েছে। সে দিক থেকে এই সংকলনটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন, যার উপজীব্য পশ্চিমবঙ্গের সেই মুসলমানদের দেশবদলের স্মৃতি, দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গের (তখন পূর্ব পাকিস্তান) অভিমুখে পাড়ি দিয়েছিলেন যাঁরা। ‘দেশ’ নামক বস্তুটির জন্য পৃথিবীর সমস্ত বাস্তুহারা ছিন্নমূল মানুষের নিরন্তর অন্বেষণ এবং তার ব্যর্থতার হাহাকার প্রতিধ্বনিত হয়েছে এই স্মৃতিমালাতেও।
দেশভাগ তো শুধু সিরিল র্যাডক্লিফের তৈরি সীমারেখা নয়, ছিন্নমূল মানুষের মনেরও দ্বিধাদীর্ণ বিভাজন। তবু, কিছু কাল আগে পর্যন্তও তথ্যনিষ্ঠ, লেখ্যাগার-নির্ভর, তথাকথিত উচ্চমার্গীয় ইতিহাস দেশভাগ-জনিত ব্যথা, বেদনাবোধ এবং সর্বোপরি মানসিকতার ইতিহাস রচনার কলাকৌশল ঠিক আয়ত্ত করতে সক্ষম ছিল না। সুখের কথা, মহাফেজখানার দলিল-দস্তাবেজের বাইরে অন্য ধরনের তথ্যসূত্রের সাহায্যে এই মানবিক ট্র্যাজেডিকে ধরার প্রয়াসও শুরু হয়েছে আস্তে আস্তে। দেশভাগের গল্প বলতে গিয়ে কান্তি পাকড়াশির দ্য আপরুটেড (১৯৭১) উদ্বাস্তু মানুষের অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দেয়। ভারত ও পাকিস্তানে দুই পঞ্জাবের উদ্বাস্তু মহিলাদের অভিজ্ঞতাকে উল্টেপাল্টে দেখে সেই প্রয়াসে এক নতুন মাত্রা যোগ করেন উর্বশী বুটালিয়া, রিতু মেনন, কমলা ভাসিনরা, আর প্রায় একই সময়ে জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডেও বলেন যে, দেশভাগের আগুনে দগ্ধ হয়েছেন এমন মানুষদের দৃষ্টিকোণ থেকেই খুঁজে পেতে হবে দেশভাগের অন্যতর ইতিহাস। নব্বইয়ের দশকে মূলত স্মৃতিকথাকে ভিত্তি করে উদ্বাস্তুদের ইতিহাস লিখলেন নীলাঞ্জনা চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, যশোধরা বাগচি, শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত, প্রফুল্ল চক্রবর্তী, দীপেশ চক্রবর্তী প্রমুখ। এ ভাবেই তৈরি হল দেশভাগের বিভিন্ন প্রান্ত ও পর্বের ইতিহাস চর্চার সঙ্গে স্মৃতিকথনের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কসূত্র।
পূর্ব ভারতের দেশভাগ ও ভিটে থেকে উৎখাত-হওয়া হিন্দু শরণার্থীদের কাহিনি যদি জটিল মনে হয়, পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে চলে যাওয়া বাঙালি মুসলমানদের গল্পটি কিঞ্চিৎ জটিলতর। এঁরা অনেকেই স্বাধীনতার স্বাদ নিয়েছেন— এবং শরণার্থীও হয়েছেন— দু’বার, ১৯৪৭-এ এবং ১৯৭১-এ। এক জীবনে দু’বার আশ্রয়চ্যুত হয়ে নোঙরহীন নৌকোর মতো চলার অভিজ্ঞতা কার ক্ষেত্রে কী রকম?
দেশভাগের পর শিশুবয়সে শান্তিপুরের পৈতৃক ভিটের পাট চুকিয়ে পরিবারের সঙ্গে রাজশাহি চলে যাওয়ার কথা ভুলে গেছিলেন রহমত আলি: ‘ভুলে গেছি, নাকি ভুলতে চেয়েছি? ওই দিনটাকে আমি মনে রাখতে চাইনি বলেই কি ভুলে গেছি?’ (পৃ: ১৩৫) কিন্তু একাত্তরে পদ্মার চরের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে আবার জন্মভিটেয় ফেরার সময় কষ্ট আর আনন্দের এক অবর্ণনীয় দোটানা আচ্ছন্ন করে তাঁকে। এই দোলাচলের গভীরে নিহিত থাকে শৈশবে দেখা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতি এক দুর্বার টান, যা মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে সমস্ত কথকের স্মৃতিচারণে স্পষ্ট। তাই হাসান আজিজুল হকের বাল্যস্মৃতিতে ধরা থাকে পূজারি ব্রাহ্মণ পাঠশালার গুরুমশাইয়ের লক্ষ্মীপূজো শেষে গুরুমার সন্দেশ, নাড়ু, নকুলদানা প্রসাদ বিতরণ, কিংবা সন্ধেয় মুদির দোকানে কাশীদাসী মহাভারত পাঠের মৃদু একঘেয়ে সুর (পৃ: ৫২)। হুসেন মহম্মদ এরশাদের স্মৃতিপটে আঁকা স্টেশনের পাশেই দুর্গাপুজোর মণ্ডপে আরতিনৃত্য, আর কদমা বাতাসা খেতে খেতে বন্ধুদের সঙ্গে মেলার মাঠ চষে বেড়ানো (পৃ: ৭৯)। রহমত আলির মনে পড়ে, প্রথম যখন পূর্ববঙ্গে গেছেন, তখন তাঁদের বাড়ির হিন্দু ম্যানেজার বিশ্বেশ্বরকাকার বাড়ি সরস্বতী পুজোর সব ব্যবস্থাই করে দিতেন তাঁর বাবা, আর দেবীর পায়ের কাছে তাঁর পাঠ্যপুস্তকগুলি রেখে দিয়ে রহমত বলতেন, ‘সরস্বতী দেবী বিদ্যাবতী, তোমার কাছে দিলাম চিঠি, একটু দয়া করো মাগো, বিদ্যা যেন হয়।’ (পৃ: ১৩৬) বইটি জুড়ে রয়েছে এ রকম সম্প্রীতির অনেক গল্প। এমন এক সম্প্রীতি যেখানে দু’টি ধর্মীয় সম্প্রদায় একে অপরের জীবনে সম্পৃক্ত হয়ে থাকে, আর আমরা পাঠকেরা মশগুল হয়ে ভাবি, আহা, এমনটাই যদি থাকত চিরকাল।
কিন্তু যে সংকলনের বিষয়বস্তুই ‘স্বর্গ’ থেকে বিদায়ের গল্প, সেখানে অনিবার্য ভাবেই লেখকদের সঙ্গে পাঠকও অবিলম্বে আছড়ে পড়েন বাস্তবে রুক্ষ প্রান্তরে। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, দাঙ্গার কালো ছায়া, দ্বিজাতিতত্ত্ব, চকিতে ছড়িয়ে পড়া গুজব, রাস্তার পাশে পড়ে-থাকা লাশ দেখে ভয়ে চমকে ওঠা, অদ্ভুত আঁধারের মতো মনে বিছিয়ে-থাকা আতঙ্কের এই ইতিহাস তো আমাদের খুব চেনা, কয়েক দশক ধরে পড়তে পড়তে ক্রমশ গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে।
তাই প্রশ্ন জাগে, এই একদা-বাস্তুচ্যুত কথকদের কি কোনও ‘দায়িত্ব’ আছে নিজেদের বিপন্নতার আখ্যানকে বেদনাবিধুর, মরমি ভঙ্গিতে পরিবেশন করার? স্বয়ং সম্পাদক আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সাহিত্যে দেশভাগ নিয়ে যত আকুলতা তার ছিটেফোঁটাও পূর্ববঙ্গীয় সাহিত্যে নেই, কারণ সেখানে শরণার্থীদের পুনর্বাসন সমস্যা ছিল না, রিফিউজি ক্যাম্প বানানোর প্রয়োজনও পড়েনি। ১৯৬১ সালের জনগণনা সম্পর্কে জয়া চট্টোপাধ্যায়ের দেওয়া পরিসংখ্যান ঘেঁটে তিনি দেখিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গের চারটি জেলায় জনস্ফীতি যখন ক্রমবর্ধমান, ঠিক সেই সময়েই পূর্ববঙ্গে সেই সংখ্যা নিম্নমুখী। অতএব, উদ্বাস্তু সংকটই না থাকলে আর তার অভিঘাত পুবের সাহিত্যে ঘটবে কী করে? তা ছাড়া বাল্য বা শৈশবের বাস্তুচ্যুতির পর যথাসময়ে সবাই সুস্থিত হয়েছেন নতুন জীবনে, তাই দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে স্মৃতিচারণ করলেও হৃদয়ের একদা-রক্তক্ষরণের সত্যনিষ্ঠ, আকুল বিবরণ দেওয়ার দায় কি থাকে কোনও? ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে?’
সংকলনে অন্তর্ভুক্ত তিন মহিলা ও দশ জন পুরুষ লেখকের সকলেই দেশান্তরী হয়েছেন, তাঁদের কেউ কেউ নিয়মিত, কেউ কেউ অনেক বছর পরে ফিরে এসেছেন, দেখতে চেয়েছেন কেমন রয়েছে তাঁদের স্মৃতির শহর বা জনপদ। অনেকের লেখাতেই উঠে এসেছে দেশভাগ কী ভাবে তাঁদের পারিবারিক জীবনকে বিপর্যস্ত করেছে— মোবারক হোসেনের আফশোস যেমন, দেশভাগের জেরে মা-র সঙ্গে আর শেষ দেখা হল না: ‘মা-বাবার স্নেহ সব বিসর্জন দিতে হয়েছে দেশভাগের কারণে। সতেজ জীবন পরবাসে শুষ্ক, শীর্ণ জীবনে পরিণত হয়েছে’ (পৃ: ৮৮)। অথচ, যে জীবন এখানে ‘পরবাস’ বলে স্বীকৃত, ‘অপশন’ দিয়ে স্বেচ্ছায় সেই জীবনে চলে গিয়েছিলেন অনেকেরই বাবা, দাদা, চাচা। বুলবন ওসমান যেমন, ১৯৫০-এ বাবার পিছু পিছু কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে পাড়ি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ‘স্বর্গোদ্যান’ থেকে তাঁর বিদায়। ওসমান অকপটে জানাচ্ছেন, ‘বাংলা বিভাগের ফলে দু’বাংলার প্রায় প্রতিটি পরিবার এ ভাবে বিভক্ত হয়ে আছে... এ এক গ্লানিময় জীবনগাথা’ (পৃ: ৬৯)। অথচ রুবেয়া মঈন দৃঢ় ভাবে জানান, দেশভাগ ‘আমার কিন্তু মনে হয় জরুরি ছিল’ (পৃ: ৯৭)। প্রবীণ লেখক হায়াৎ মামুদও অকপট, ‘দেশভাগ অনিবার্য ছিল। যা অনিবার্য তা তো ঘটবেই’ (পৃ: ১০৪)। একদা পূর্ববঙ্গ, পরে পূর্ব পাকিস্তান ও অধুনা বাংলাদেশের প্রধানত মুসলিম লেখকদের লেখায় দেশভাগের ‘অনিবার্যতা’-র এই গ্রহণ বা সহজ স্বীকৃতি তাঁদের স্মৃতিচারণকেও এক বিশেষ চরিত্র দেয়, তাঁদের বাস্তুচ্যুতির আবেগমন্থনকে এক বিশেষ পরিমিতি। রুবেয়া সখেদে বলেন, দেশভাগ ‘আমার শৈশবকে করেছে দ্বিখণ্ডিত’ (পৃ: ৯১), হায়াৎ স্বীকার করে নেন তিনি রুটলেস— ‘আমার কোনও শিকড় নেই’ (পৃ: ১০৩)— মোবারক হোসেনের হৃদয়ের বেদনা তাঁর লেখনী থেকে নিঃসৃত হয়ে আসে: ‘দেশত্যাগের যন্ত্রণা এমন এক অনুভূতি, যে না করেছে সে কোনওদিন তা বুঝবে না...দীর্ঘ হাঁটা পথ... সে যেন আর শেষ হয় না’ (পৃ: ৮৭)। এই আবেগ বেদনাবিধুর তো নিশ্চয়ই, কিন্তু অবিরল রক্তক্ষরণ বা হাহাকার সেখানে নেই।
সে না হয় না-ই থাকল। কিন্তু তবু স্মৃতিকথনের মধ্যে দিয়ে জাতিরাষ্ট্রের হয়ে-ওঠার প্রক্রিয়াটির সমান্তরাল, বিকল্প এক ইতিহাসের সন্ধান চলতে থাকে এই বইটির মাধ্যমে। আর সেই জরুরি কাজটিতে সবচেয়ে বেশি সহায়ক বদরুদ্দিন উমরের দীর্ঘ লেখাটি, যার মধ্যে নির্মোহ ভাবে বিবৃত হয়েছে বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িত, উদারমনস্ক পরিবারের ছত্রচ্ছায়ায় লালিত লেখকের বাল্য এবং কৈশোর, যেখানে সদাশান্ত বর্ধমান শহরের উপর তিরিশ-চল্লিশের দশক জুড়ে নেমে আসতে থাকে রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্ত আর দাঙ্গার ছায়া, পুড়িয়ে দেওয়া হয় তাঁদের বাড়ি, পিতৃব্যসম পুরনো পারিবারিক হিন্দু বন্ধু অবলীলায় খুলে ফেলেন বন্ধুত্বের মুখোশ, গান্ধীহত্যার সংবাদ পেয়ে বিষাদাক্রান্ত হলেও একটু পরেই হত্যাকারীর নাম ও ধর্মপরিচয় শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন তরুণ বদরুদ্দিন— যাক, প্রতিশোধমূলক নিধনযজ্ঞের খাঁড়া অন্তত এ যাত্রা নেমে আসবে না মুসলমানদের উপর। এই বাঁচার তাগিদেই পারিবারিক সিদ্ধান্ত হল বর্ধমানের পাট গুটিয়ে ঢাকায় পাড়ি দেওয়ার। ‘আসলে নিরাপত্তার অভাব ও সেই সঙ্গে অপমানবোধ স্বাভাবিক চিন্তাশক্তিকে খুব দুর্বল করল’ (পৃ: ১৭৭), অকপটে লিখেছেন বদরুদ্দিন। রুবেয়া মঈন বা হায়াৎ মামুদের মতো যাঁরা দেশভাগকে ‘জরুরি’ বা ‘অনিবার্য’ ভেবেছিলেন, এই ‘স্বাভাবিক চিন্তাশক্তি’র স্খলনের স্বীকারোক্তি তারই উল্টো পিঠ। দেশভাগের কারণ নিয়ে নানাবিধ ভাবনার এই উচ্চাবচ দোলাচলের বহুমাত্রিক ছবি ধরা রইল এই বইয়ে। ‘হাতড়ে হাতড়ে দেশ ছেড়ে যাওয়া বাঙালি মুসলিম সমাজের একটা আদল খোঁজার চেষ্টা যে করা হয়েছে এই সংকলনে’ (পৃ: ৩১), তাকে সাধুবাদ না জানিয়ে উপায় নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy