কাপমহলা, গৌতম ভট্টাচার্য। দীপ প্রকাশন, ৩৭৫.০০
ক্রিকেট খেলার রকমফের বদলাচ্ছে। টেস্ট থেকে ওয়ান ডে, তার পর টি টোয়েন্টি। পাঁচ দিন, এক দিন, তার পর খেলা এখন কয়েক ঘণ্টার। তাই নিয়েই উত্তেজনা। বিনোদন হিসেবে এখন টি-টোয়েন্টির জবাব নেই। অফিসের পর সন্ধেবেলার বিনোদন। টেস্ট ক্রিকেটের সাবেকি জগৎ হারিয়ে গেছে। যে মূল্যবোধ নিয়ে একদা ভদ্রলোকের খেলা হিসেবে পাঁচ দিনের টেস্টযাপন করা হত তা এখন সুদূর অতীত। খেলার রকম যেমন বদলেছে তেমন বদলেছে দেখার রকমও। রেডিয়োতে রিলে শোনার দিন গেছে, সরকারি দূরদর্শনে খণ্ড খণ্ড খেলা দেখার দিনও অতীত। অসরকারি চ্যানেল এখন খেলার প্রতিটি মুহূর্ত তুলে ধরে। শুধু কি মাঠ, তারা মাঠের বাইরের কথাবার্তা নিয়েও হাজির হয়। ক্রিকেট-বোদ্ধাদের পাশাপাশি লাস্যময়ী রমণীরা টিভির পর্দায় থেকে থেকেই ভেসে বেড়ান। সব মিলিয়ে অন্য রকম ইন্দ্রিয়তৃপ্তিদায়ী প্যাকেজ। শুধু খেলা নয়, খেলার বাইরে আরও অনেক কিছু।
এই অবস্থায় সংবাদপত্রের ক্রীড়া সাংবাদিকের কাজ খুবই কঠিন। পাঠকদের জানা তথ্য আবার জানিয়ে লাভ নেই। এমন ভাবে পরিবেশন করতে হবে খেলার খবর, লিখতে হবে বিশ্লেষণী প্রতিবেদন যাতে এই জানা তথ্যের ভার ডিঙিয়ে সকালবেলায় পাঠক কাগজ পড়তে উৎসাহী হন। মুচমুচে কিছু থাকাও চাই। ক্রীড়া সাংবাদিক গৌতম ভট্টাচার্য খুবই তৎপরতার সঙ্গে সেই কাজটা করেন। যেমন তিনি লিখেছেন, ‘বলের আগে যেতে পারলে তবেই তুমি বাউন্ডারিটা বাঁচাবে।’ তাঁর লেখার ভাষা গতিময়। সাবেকি সাংবাদিকতার ভাষা ছেড়ে তিনি হাল আমলের মুখের ভাষা ব্যবহার করেন। তৈরি করেন গতিময় ভাষার সঙ্গে লাগসই নানা উপমা। অনায়াসে প্রয়োজনমাফিক ঢুকিয়ে দেন ইংরেজি শব্দ। এই সমস্ত বৈশিষ্ট্য নিয়ে তৈরি হয়েছে তাঁর নিজস্ব লিখনশৈলী। পড়লেই বোঝা যায় গৌতম ভট্টাচার্যের লেখা পড়ছি। সহ-সাংবাদিকদের লেখার ভাষাকেও প্রভাবিত করতে পেরেছেন তিনি। ক্রীড়া সাংবাদিকতায় গৌতম ভট্টাচার্যের নিজস্ব একটি ঘরানা যে তৈরি হয়েছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে পরিশ্রম করার ক্ষমতা। কথার ভেতর থেকে কথা টেনে আনার সামর্থ। কাজেই গৌতম ভট্টাচার্যের লেখা বাঙালি ক্রীড়ামোদী মাত্রেই আগ্রহের সঙ্গে পড়েন।
তাঁর নতুন বই কাপমহলা ‘বিশ্বকাপ অন্দরমহলের গোপন সব কাহিনি’তে ভরপুর। মাঠে বাইরের খেলা তো আপনি সম্প্রচারিত হচ্ছে বলে দেখতেই পাচ্ছেন। সুতরাং কাপমহলায় পড়ুন ‘অন্দরমহলের গোপন সব কাহিনি’। আজহার-সঙ্গীতার তখন প্রণয় পর্ব। বাঙ্গালোরে জোর করে ক্যাম্প করলেন ভারত অধিনায়ক আজহার। সঙ্গীতার ভাই সেখানে থাকেন, সম্ভবত নিজের ভাই। তাই আজহারে সঙ্গীতায় দেখাশোনা হবে। এ দিকে চিন্নাস্বামীর জায়গায় জায়গায় তখন কংক্রিটের চাঁই পড়ে আছে। ক্যাচিং প্র্যাকটিস করা যাবে না। ‘শোনামাত্র হুইস্কির গ্লাস হাতে চেন্নাইয়ের ওয়াড়েকরকে মনে পড়ে গেল। আজ্জুকে কন্ট্রোল করা যাচ্ছে না।’ (পৃ. ১৩৮)
যে বর্ণনা দেন গৌতম তা যে লোকমুখে শোনা নয়, নিজের চোখে দেখা, পাঠককে তা সব সময়ই খেয়াল করিয়ে দেন তিনি। বর্ণনার মধ্যে লেখকের বর্ণময় উপস্থিতি। এতে পাঠকের কাছে লেখাগুলির বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। কপিল দেব গৌতমের মুখোমুখি। কপিলের মুখোমুখি হলেই সুনীল-কপিল রেষারেষির প্রসঙ্গ উঠবেই। উঠেওছে। কপিল বলছেন: ‘আজ শুনে রাখুন যে প্রতিটা টেস্ট সুনীল গাওস্কর ড্র করিয়েছে তার প্রত্যেকটা আমরা আসলে জিতেছি। কেন? না, আমরা তো হারিনি। সুনীল আমাদের শিখিয়েছিল খবর্দার হারবে না।’
অনেকখানি অংশে রয়েছে সৌরভের কথা। সৌরভকে কী ভাবে আজহার আর গ্রেগ চ্যাপেলের কারাগারে পারফর্ম করতে হয়েছিল সে কিস্সা রয়েছে। ফিজিয়ো আলি ইরানি গৌতমকে বলেছিলেন, ‘আপনাদের ছেলেটা এখানে এসে কীসব বাধিয়ে গিয়েছে। আমি তো ওকে বাঁচিয়ে দিলাম। টুয়েলফথ ম্যান হিসেবে জল নিয়ে যেতে অস্বীকার করছিল। তারপর একদিন বাসে নিজের মাল তুলতে চাইছিল না। কপিল দেব এসে তুলে দিল।’ ‘সৌরভ ভীতু ভীতু, সিনিয়রদের ফাই ফরমাস খাটা, ব্যক্তিত্বহীন’ বান্দা নন (পৃ. ১৭৪) তাই এই বিপত্তি। আর সৌরভ যখন সৌরভ তখন ‘সৌরভের অধীনে টিম ইন্ডিয়ার দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপ কামব্যাক’। ডারবানে সৌরভের ঘরে একটা ছবি। ‘লগান’ ছবির চম্পানের-এর ক্রিকেট টিম। দলবল সহ ভুবন। প্রিন্ট আউটে আমিরদের মুখ বদলে বদলে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে সৌরভদের এক একজনকে। ‘ঠিক মধ্যিখানে সৌরভ নিজে।’
বিশ্বকাপ নিয়ে বই, ভারতীয় ক্রিকেট নিয়ে বই সচিন ছাড়া অসমাপ্ত। ইংল্যান্ডে ১৯৯৯-এর বিশ্বকাপ চলাকালীন অজয় জাদেজা বলেছিলেন ‘সচিন হচ্ছে ভ্রাম্যমাণ দালাল স্ট্রিট। প্রতি মিনিটে লগ্নীকারীরা ওর ওপর ঝুঁকে রয়েছে।’ (পৃ. ১১২) সচিন কিন্তু এর মধ্যেই মাথা ঠান্ডা রেখে যা করার করেন। সেঞ্চুরিয়ন। সহবাগ-সচিন নামছেন। সহবাগের জিজ্ঞাসা, ‘পাজি আভি কেয়া করনা হ্যায়।’ সচিনের জবাব, ‘কেয়া কর না হ্যায়? পাকিস্তান কো মারনা হ্যায়?’ সচিনের সেদিন কী রুদ্র মূর্তি। ম্যান অব দ্য ম্যাচ। আর ছিলেন দ্রাবিড়। ‘টেস্ট ক্রিকেটে ৫০-এর উপর গড় নিয়েও বাদ পড়েছেন বারবার।… মন শক্ত করে খেটেছেন, পুরুষ মানুষের মতো ফিরে এসেছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে।’
গৌতমের কাপমহলার গুণ হল, একটানে পড়া যায়। ধ্রুপদী ক্রিকেট সাহিত্য লেখা তাঁর উদ্দেশ্য নয়। সেই ধ্রুপদী সাহিত্যের নিক্তিতে কাপমহলা-কে মাপা যায় না। ক্রিকেট বদলেছে, ধ্রুপদীর ধারণাও বদলায়। কাপমহলা এই সময়ের বই। সাতটা ক্রিকেট বিশ্বকাপ কভার করেছেন যে ক্রীড়া সাংবাদিক এই বই তাঁর জীবন্ত মুচমুচে ধারাভাষ্য। গম্ভীর মুখে পড়তে হবে না। ধরলে ছাড়া যাবে না। ছায়াছবির মতো বর্ণময় খেলার মাঠ ও মাঠের বাইরে সারি সারি দৃশ্য ফিল্মের রোলের মতো চোখের সামনে দিয়ে চলে যাবে। এ যেন ক্রিকেটের বায়োস্কোপ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy