আমার ইলিয়াস
হাসান আজিজুল হক
সম্পাদক: চন্দন আনোয়ার
২০০.০০
ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ (ঢাকা)
হাসান আজিজুল হক এক বার বলেছিলেন, “সাম্প্রতিক বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিকদের পাশে ইলিয়াস তাঁর স্থান করে নিয়েছেন। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, চিনুয়া আচেবে, সলমন রুশদি, গুন্টার গ্রাস, নাদিন গর্ডিমার যে মঞ্চে দণ্ডায়মান, সেই মঞ্চেই ইলিয়াসের স্থান।” অবশ্য, পুরস্কারের প্রতি ইলিয়াস বরাবরই উদাসীন ছিলন। আলোচ্য গ্রন্থটিতে হাসান আজিজুল হক এই একই বিচার অটুট রেখেছেন। ‘কল্পনা বাস্তব মিলিয়ে ইলিয়াসের সঙ্গে আলাপ’ নিবন্ধটিতে তাঁর মত, “বাস্তব আর ইতিহাস মিলে লিখিত হল খোয়াবনামা। কোন মডেল অনুসৃত হয়েছে দেখতে যাওয়া বিড়ম্বনা।” স্পষ্টত, খোয়াবনামা আর চিলেকোঠার সেপাই-এর মধ্যে ‘খোয়াবনামা’র প্রতি তিনি অধিক দুর্বল।
সুসম্পাদিত এই গ্রন্থে ইলিয়াসের উপন্যাসের উপর সে ভাবে আলোকপাত করা হয়নি। কয়েকটি বিক্ষিপ্ত মন্তব্য আছে খোয়াবনামা সম্পর্কে, কিন্তু তার বেশি কিছু নয়। তাই আমরা ইলিয়াসের নিমগ্ন ভাষাশৈলী, প্রগাঢ় স্বপ্নময়তার সে রকম আভাস এ বইয়ে পাই না। স্বপ্নময়তা কিন্তু সহজ-সরল, সাম্যবাদী ইচ্ছাপূরণের নামান্তর নয়। ইলিয়াস ইচ্ছাপূরণের এই সহজতাকে প্রত্যাখ্যান করে বিকল্প হিসেবে বেছে নেন সংঘর্ষে দীর্ণ কঠিন অগ্রগতি।
এই স্বল্পপরিসরের বইটিতে— নিবন্ধে ও আলাপচারিতায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়েছে ইলিয়াসের ছোটগল্প এবং গল্পের ভাষাশৈলীর উপর। “(ইলিয়াস) এরকম গদ্য (লিখেছেন), যে গদ্য তরলতাকে ক্রমশ পরিহার করে পরিহার করে পরিহার করে একটা কঠিন ভূমির উপর দাঁড়ায়। এর জন্য বহু জল সেচতে হয়। বহু দিন অপেক্ষা করতে হয়। তারপর রোদ আসে। শক্ত খটখটে হয়। তেমনি একটি গদ্য দাঁড় করিয়েছে ইলিয়াস।” উপরন্তু, এই খটখটে জমির উপর দাঁড়িয়ে ইলিয়াস উপর্যুপরি কশাঘাত করেছেন বিত্তবান ও মধ্যবিত্ত সমাজকে। কোনও অনুকম্পা, দরদ, হৃদয়দৌর্বল্য প্রকাশ করেননি। লেখকের ভাষায়, ‘তিনি মূত্রত্যাগ করেছেন’ মধ্যবিত্তের উপর।
তবে কি ইলিয়াস কঠিন হৃদয়বৃত্তির মানুষ ছিলেন? নিতান্তই দয়ামায়াহীন এবং কর্কশ? আদৌ নয়। লেখাকে তিনি মসৃণ করেননি ঠিকই, “মাখন-টাখন মাখানোর মধ্যে তিনি ছিলেন না,” কিন্তু মানুষ হিসেবে “কত ভালো ও বড় ছিলেন তা আমি মুখে বর্ণনা করতে পারব না। এরকম দয়ার্দ্রচিত্ত আর কঠিন বাস্তববাদী মানুষ আমি খুবই কম দেখেছি।” এই অন্তরঙ্গ মূল্যায়নে ও আলাপচারিতায়, বারংবার উচ্চারিত হয়েছে এক জনের নাম: মািনক বন্দ্যোপাধ্যায়। সম্পাদক চন্দন আনোয়ার হাসান আজিজুল হককে প্রশ্ন করেছিলেন, “জীবনকে দেখার দৃষ্টিকোণ থেকে কাকে ঊর্ধ্বে রাখবেন— মানিক না ইলিয়াস?” উত্তরদাতা বলেন, “মানিক আরও সম্পূর্ণ কারণ উনি ‘সরীসৃপ’ ও ‘প্রাগৈতিহাসিক’-এর মতো গল্প লিখেছেন; ‘পদ্মানদীর মাঝি’ ও ‘দিবারাত্রির কাব্য’র মতো উপন্যাস লিখেছেন... ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’র তো তুলনাই হয় না।” আমাদের মনে রাখতে হবে যে ইলিয়াস মাত্র দু’টি উপন্যাস লিখেছিলেন এবং পঁচিশটি ছোটগল্প। তাঁর অকালপ্রয়াণে আমরা কতটা বঞ্চিত হলাম, এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া অবশ্য সহজ নয়।
আসলে মানিক এক দিকে, অন্য দিকে তাঁর দুই উত্তরসূরি হাসান আজিজুল হক ও ইলিয়াস গড়ে তুলেছেন সৃষ্টির এক তন্ময় ত্রিকোণ। বিশ্বসাহিত্যের যেটুকু খোঁঁজ রাখি, তাতে দাবি করতে পারি, আর কোনও সাহিত্যে এমন ত্রিকোণের সন্ধান মেলা কঠিন। আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যকে এক ভিন্ন, স্বতন্ত্র মাত্রা দিয়েছেন এই তিন লেখক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy