ছিন্নমূল: শিয়ালদহ স্টেশনে উদ্বাস্তুদের ভিড়, ১৯৫০
হাসির কথকতা কান্নার কথা/ সত্যপ্রিয় ঘোষ: সৃজন আর জীবন
রুশতী সেন
৩০০.০০
দে’জ পাবলিশিং
সত্যপ্রিয় ঘোষের জন্ম ১৯২৪-এ। স্কুলজীবন বরিশাল, কলকাতা ও পাবনায়, কলকাতার কলেজে পড়াশোনা কিন্তু পাবনা থেকেই আই এসসি পরীক্ষা দেওয়া। ১৯৪৪-এ বাংলায় স্নাতক, স্নাতকোত্তর পড়া হয়নি কারণ সংসারে আট জন মানুষের খাওয়া-পরা বাবার পক্ষে একা সামলানো কঠিন ছিল। দশকটিও বিশ্বযুদ্ধ, বন্যা, দুর্ভিক্ষে জর্জরিত। সত্যপ্রিয় রেলের চাকরিতে ঢোকেন। তার পর দেশভাগ। ১৯৪৯-এ প্রকাশিত ‘মায়াপথ’ গল্পে লিখছেন, ‘‘পাকিস্তান ছেড়ে যাচ্ছি। যাচ্ছি পশ্চিমবঙ্গে। বাংলাদেশ ছেড়ে বাংলাদেশে।’’ নিশ্চিত আশ্রয় নেই সেখানেও। অধিকাংশ ছিন্নমূল মানুষের মায়াপথের শেষ কলকাতার বস্তিতে, মুর্শিদাবাদে পতিত জমির উপর হোগলার ছাউনিতে, নবদ্বীপের মন্দিরের দাওয়ায়, কাটিহার-পূর্ণিয়ার বস্তিতে, হুগলির জঙ্গলে, এখানে সেখানে গলিতে প্ল্যাটফর্মে শ্মশানে।
বেয়াড়া সময় ও ছন্নছাড়া জীবনই অনুভূতিপ্রবণ মানুষটিকে কলম ধরায়। ‘মায়াপথ’ ‘আমোদ’, ‘বিয়ে’ গল্পে দেশভাগ, বাস্তুহারা মানুষের প্রসঙ্গ। গল্পগুলি ছাপা হয় বর্তমান, অগ্রণী, গণবার্তা, পূর্বাশা-তে। প্রথম উপন্যাস ‘চার দেয়াল’ ১৯৫৬-তে, পরের দু’টি— ‘গান্ধর্ব’ ও ‘রাতের ঢেউ’— ১৯৬০-এ। প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনা সংস্থা থেকে বেরিয়েছিল, বিচ্ছিন্ন প্রশংসাও জুটেছিল, কিন্তু ‘যাকে বলে পাত্তা পাওয়া’ তা তিনি পাননি। ১৯৭৫-এ বন্ধু বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় টাকা জোগাড় করে গল্প সঙ্কলন ‘অমৃতের পুত্রেরা’ প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। তার পর প্রায় আড়াই দশকের নীরবতা। ১৯৯৮-এ প্রকাশিত দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘দ্বিতীয় জন্ম’। নবজন্ম ঘটে ঔপন্যাসিক হিসেবেও, ১৯৯৯-২০০৩ পর্বে চারটি নতুন উপন্যাস। কোনওটিই এখন মেলে না। এমন এক কথাসাহিত্যিককে নিয়েই রুশতী সেনের এই বই। প্রায়-আশিতে এক কথাকারের লেখায় ফেরা যেমন বিস্ময়ের, বইবাজার থেকে নিরুদ্দেশ এক লেখকের বই নতুন করে খোঁজা ও পড়াটাও কম আশ্চর্যের নয়।
সত্যপ্রিয় তাঁর লেখায় চার পাশের মানুষজনকে তুলে ধরেছেন। লিখতে চেয়েছেন যাপনের অভিজ্ঞতা। রুশতী তাঁর প্রথম লেখায় সত্যপ্রিয়র রেলজীবন পুনর্নির্মাণ করতে চেয়েছেন। তাই কলাবাগান, নারকেলডাঙা ও কাইজার স্ট্রিটে রেল কলোনিতে যাওয়া। কর্মস্থলেও গিয়েছেন, কারণ এই সব জায়গা সত্যপ্রিয়র গল্প-উপন্যাসে বিন্যস্ত। আটত্রিশ বছরের রেলজীবন শেষে সত্যপ্রিয়র ঠিকানা হয় কালিন্দীর আবাসন। কালিয়াদহের জলার এই রূপান্তরও ধরা থাকে সত্যপ্রিয়র গল্পে। এর সঙ্গে লেখকের পরিবারের মানুষ, সহকর্মী ও অন্যদের স্মৃতি যোগ করে রুশতী তৈরি করেছেন তাঁর সাহিত্যপাঠের প্রেক্ষিত।
পত্রিকার পাতায় যে উপন্যাসের নাম ‘খেলা ভাঙার খেলা’, বই হিসেবে তা ‘চার দেয়াল’। রুশতীর মতে, জীবনের সত্য থেকে উপন্যাসটি বিচ্যুত নয় কিন্তু ঘটনাবলি ও বিশেষ মুহূর্তকে জীবন্ত করে তুলতে যে ‘জ্যান্ত’ শব্দবন্ধের প্রয়োজন, তা তখনও লেখকের অধরা। ফলে বিনতা ও উন্মেষ চরিত্র দু’টি সম্পূর্ণ প্রস্তুতির আগেই পরস্পরের মনের কাছাকাছি চলে আসে। অন্যতম প্রধান চরিত্র নিত্যপ্রসাদ পাগল হয়ে যায়, শেষে তার মৃত্যু হয়। রুশতীর অনুমান, সত্যপ্রিয় পরে নতুন করে লিখলে বিকল্প কোনও পরিণতি খুঁজতেন। দ্বিতীয় উপন্যাস ‘গান্ধর্ব’ বিষয় ও নির্মাণের দিক থেকে নিখুঁত। এক নারীকে পুরুষের স্ত্রী হওয়ার অধিকার পেতে কত অপমান সহ্য করতে হয়, দেখিয়েছেন লেখক। স্বনির্ভর কৃত্তিকাকে অফিসে ‘এক হাট পুরুষের সঙ্গে বনিবনা খাতির তোয়াজ রেখে’ চলতে হয়। বিভা ও বারুণী নামের দু’টি মেয়ের অসহায়তার ছবিও এঁকেছেন লেখক। এমন উপন্যাসের পাঠক হারানো হতাশার বিষয়, রুশতীর ‘অন্দরের স্বর সাহিত্যের সংকেত’ লেখায় তা নিয়ে বিষাদ ছড়িয়ে থাকে। ‘রাতের ঢেউ’ উপন্যাসে সত্যপ্রিয়র রাঙাকাকিমার ছাপ। বাস্তবের লীলাবতীর মতো উপন্যাসের মাধবীলতাও মাঝে মাঝে ঘরছাড়া হত। এও এক ছিন্নমূল হওয়ার গল্প। ঘর অচিরে জতুগৃহ, পুড়তে পুড়তে শরীর-মন এক সময়ে ভারসাম্য হারায়। রাঙাকাকিমার কষ্ট উপন্যাসে ধরতে চেয়েছেন ঔপন্যাসিক।
চার দশক পরে আবার উপন্যাসে ফেরেন সত্যপ্রিয়। ১৯৬০-এ ভারত জুড়ে কেন্দ্রীয় সরকারি শ্রমিকদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ১৯৯৯-এ লেখেন ‘বহু বাসনায়’ উপন্যাস। বেড়াচাঁপা গ্রামের টিনের চৌচালার বাড়িতে বাবা আশুতোষ ও ছেলে নারায়ণ দু’জনেই রেলের কর্মচারী— ধর্মঘটের দুই পক্ষ। বাবার চিন্তা সংসারের অন্নের, ছেলের চিন্তা শ্রমের বিনিময়ে ন্যায্য বেতনের। ধর্মঘট বেআইনি ঘোষিত হয়, নারায়ণের হাজতবাস হয়। আশুতোষকে বইতে হয় ছেলের সাসপেনশনের বিজ্ঞপ্তি। ধর্মঘট ব্যর্থ হয় নেতৃত্বের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণে। শেষে নারায়ণ পায় বিপ্লবীর মর্যাদা, আর আশুতোষ অনুভব করে, নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের দায় তারও। রুশতীর মনে হয়, এই উপন্যাসের সমাপ্তি খানিক সরল, কিন্তু তার সঙ্গে এও মনে হয় তাঁর, বাইরের ঝড়ে অন্দরের ভাঙাগড়া অত্যন্ত দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন ঔপন্যাসিক।
‘স্বপ্নের ফেরিওয়ালা’ উপন্যাসও পরিবারের চেনা সত্যের উপর নির্ভর করে লেখা। থিয়েটারপাগল সুন্দরকাকু বা দেবেন্দ্রনাথ উপন্যাসে হয়ে যান রমানাথ, বিশ্বঘরের চিন্তায় সে নিজের ঘর বাঁধতে পারে না। সাধনার সঙ্গে তার বিয়ে হওয়া নিশ্চিত বলে জেনেছিল সবাই, কিন্তু সাধনার বিয়ে হয় রমানাথের থিয়েটার-সঙ্গী কেশবের সঙ্গে। রমানাথের জন্য সাধনার আর অপেক্ষার উপায় ছিল না, কেননা তার পরের বোনেদের বিয়ে আটকে ছিল তার জন্যে। রমানাথ কিন্তু স্বপ্ন ছাড়ে না। কলকাতার মঞ্চে সে ছেলেমেয়েদের দিয়ে ‘চাঁদ সদাগর’ নাটক মঞ্চস্থ করবেই। দিন যত এগিয়ে আসে, বাস্তবের বাধায় স্বপ্নের ডিঙা তত টালমাটাল হয়। উপন্যাসের শেষ বাক্য, ‘‘সিঁড়ির অন্ধকার অগ্রাহ্য করে এ যুগের চাঁদ সদাগর হারানো মধুকরটির খোঁজে কলকাতার কুম্ভীপাকে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন।’’
বেনেপুকুর বিদ্যাপীঠের পরিচারিকা সুধাদি ‘মানপত্র’ উপন্যাসে উমারানী সরকার। স্বামী, ভাই, ছেলে, সবাইকে ছেড়ে এসে বিদ্যাপীঠের এক চিলতে ঘরে বাস করে সে। বিদ্যালয়ের মেয়েগুলির প্রতি তার দরদের সীমা নেই, বহু পড়ুয়ার লেখাপড়ার খরচ বহন করে নিরক্ষর উমারানী। তাকে মানপত্র দেবে স্কুল। মঞ্চে আবেগঘন ভাষণ চলে, মানপত্রও পড়া হয়, কিন্তু একটা বড় রকমের ফাঁক ও ফাঁকি থেকে যায়। সামাজিক ও ব্যক্তি-পরিসরে যাদের গ্রহণ করতে পারিনি,
তাদের হাতে মানপত্র তুলে দিলেও তারা সেই মান বুকে তুলে নেবে কেমন করে?
সত্যপ্রিয়র শেষ উপন্যাস ‘বনিতা জনম’-এর কথক সুতীর্থা বা দুলি। পাশের বাড়ির পিতুদা কিশোরী দুলিকে অঙ্ক শেখানোর পাশাপাশি প্রেম নিবেদন করে। এক সময়ে পিতু রোজগেরে হওয়ায় তাদের বিয়ে হয়। দুলি বোঝে পিতুর রোজগার একটু বেশিই, উৎস চিটফান্ডের টাকা। পিতুর প্রেমও ‘বহুমুখী’, প্রমাণ গোছা গোছা লুকানো চিঠিপত্র। সন্তানসম্ভবা দুলি অশান্তির মধ্যেও আশা করে, পিতু তার বোধে ফিরবে। কিন্তু অত্যাচার বাড়তে থাকে। একটি কন্যাসন্তান জন্ম নেয়, এক দিন দুলিকে মারতে মারতে সন্তান সমেত বাড়ির বাইরে বার করে দেয় পিতু। শুরু হয় দুলির দীর্ঘ লড়াই, যার শেষ দুলি বা সুতীর্থার সপ্রতিভ নারী হিসেবে নবজন্মে। সত্যপ্রিয় এই উপন্যাস লেখেন পড়শি শিউলি চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে, যাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন রুশতী।
সত্যপ্রিয় ঘোষের জীবন থেকে তাঁর সৃষ্টির উৎস খুঁজেছেন লেখক, তেমনই আবার সৃষ্ট চরিত্রের পিছনের মানুষগুলিরও সন্ধান করেছেন। বুঝতে চেয়েছেন লেখার ভিতরের আড়াল। অনেক কথা বলার পরেও কথাকার যে কথাগুলি না বলে ছেড়ে দিয়েছেন, তাও বুঝতে চেয়েছেন। এমন সুচিন্তিত কাজের পর এখন জরুরি কাজ হল, সত্যপ্রিয়র সাতটি উপন্যাস ও চুরাশিটি গল্পকে নতুন করে প্রকাশ করা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy