সাফল্য: আল-আমিন মিশনের একটি কেন্দ্র
মুসলিম জাহান/ পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সময় অসময়ের বৃত্তান্ত
লেখক: মিলন দত্ত
৩৫০.০০
কারিগর
সাফল্য: আল-আমিন মিশনের একটি কেন্দ্র
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মুসলমান সমাজের অনুপস্থিতির কারণেই স্বাধীনতার পাঁচ-ছয় দশক পর্যন্ত সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজ কার্যত অদৃশ্য থেকেছে। সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘স্বাধীনতার পর ক্রমাগত অপরিচয়ের কারণে উচ্চবর্গের হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজে, বিশেষ করে কলকাতা শহরে, বাঙালি মুসলমান এক অজানা বিজাতীয় প্রাণী হয়ে গেল। আমার মনে আছে, ছোটবেলায় আমি কোন বাঙালি মুসলমান চিনতাম না’।
আর এই ক্রমাগত অপরিচয়ের কারণেই, এই অচেনা ও অজানা থেকেই মুসলমান সমাজকে একটি একরৈখিক ধর্মীয় পরিচিতির আদলে বিচার করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। আর সে কারণেই বোধহয় মুসলিম জাহান/ পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সময় অসময়ের বৃত্তান্ত বইয়ে সাংবাদিক ও লেখক মিলন দত্ত প্রথম প্রবন্ধেই সোজাসাপটা এই প্রশ্নটাই করেছেন, ‘ইনি আমাদের পড়শি, এঁকে চেনেন?’ আসলে এই বইয়ের মূল সুর এই প্রবন্ধেই বাঁধা আছে।
বইটির প্রতিটি প্রবন্ধে লেখক প্রতিবেশী চেনানোর একটা প্রচেষ্টা করেছেন। পশ্চিমবঙ্গে প্রতি চার জন বাসিন্দার মধ্যে একজন মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের ভিন্ন ভিন্ন বন্ধনীতে বেঁধে ফেলার শাসকীয় ঝোঁক অনেকটাই পুরনো; শাসকের মানসিকতা বলতে এখানে কেবল শাসনক্ষমতায় আছেন যাঁরা তাঁরা ছাড়াও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্ষমতাভোগী ও আধিপত্যকারী গোষ্ঠীর কথাও বোঝানো হচ্ছে। এদের চেষ্টায় মুসলমান সম্পর্কে অমূলক নানা ধারণা জনমানসে আস্তে আস্তে গড়ে তোলা হয়। এই রকম ধারণার বেশ কিছু নমুনা যেমন ‘মুসলমান ভোট ব্যাঙ্ক’, ‘মাদ্রাসা সন্ত্রাসের আঁতুড় ঘর’, ‘পশ্চিমবঙ্গে যে হারে অনুপ্রবেশ বাড়ছে অচিরেই হিন্দুরা এ রাজ্যে সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে’ বা ‘মুসলমানদের জনসংখ্যার বৃদ্ধির হারে অনেকেই আতঙ্কিত’ ইত্যাদি।
লেখক এক দিকে সাম্প্রতিক বিভিন্ন তথ্যের উপর নির্ভর করে এই সব অতিকথন যে আসলে কতখানি অসার তা দেখিয়েছেন, সঙ্গে তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে চমৎকার ভাবে ব্যবহার করেছেন। যেমন লেখক নদিয়ার সীমান্ত ঘেঁষা তাঁর নিজের গ্রামের উদাহরণ দিয়ে বলছেন ‘ওপার থেকে আসা হিন্দুদের গ্রামে এখনও পর্যন্ত একটিও বাংলাদেশি মুসলমানকে হাঁসপুকুর ঘর বাঁধতে দেখেনি’। অথবা তিনি প্রশ্ন করেছেন, ‘খারিজি মাদ্রাসায় কী পড়ানো হয় তা দেখার জন্য একবারও মাদ্রাসাগুলিতে উঁকি মেরেছেন?’
অন্য দিকে মুসলমানদের সম্পর্কে জন্ম-জাত বিশ্বাসের কারণেই অনেকের মনে মুসলমানদের প্রগতি সম্পর্কে ঘোর অবিশ্বাস; সংখ্যাগুরুর শাসকীয় মানসিকতায় তাঁরা সহজেই মুসলমানদের পশ্চাৎপদতার কারণ মুসলমান সমাজের অভ্যন্তরীণ সমস্যা বলে চাপিয়ে দিয়ে দায় সারেন; কিন্তু শত বাধা বিপত্তির মধ্যেও, নিজেদের অদম্য চেষ্টায় যে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা শিক্ষায় এগোনোর চেষ্টা করছেন তা লেখক এই বইয়ে জানাতে ভুলে যান নি। “... এত বঞ্চনা আর অসাম্য ঠেলে সরিয়ে সম্পূর্ণ নিজেরই চেষ্টায় বাংলার মুসলমানরা উঠে দাঁড়াতে চাইছেন” (পৃ ৩৭)।
রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে ওঠা নানা মিশনের ছাত্রছাত্রীরা এখন রীতিমতো নজরকাড়া ফলাফল করছেন। লেখক আশাবাদী, এই সব ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে থেকেই মধ্যবিত্ত মুসলমান সমাজ গড়ে উঠবে। এঁদের কণ্ঠস্বরেই মুসলমানদের উন্নয়ন যে আসলে সামাজিক ন্যায্যতার বিষয়, এ কথা শোনা যাবে। জুতসই ভাবেই তাঁর বইয়ের একটি প্রবন্ধের শিরোনাম ‘ছবিটা বদলাচ্ছে, আমরাই খবর রাখিনি’। সত্যিই যে ছবিটা বদলাচ্ছে, সে খবর রাখলে আর অতিকথনের অসারতা নিয়ে দ্বিরুক্তির অবকাশ থাকত না।
লেখকের সঙ্গে মুসলমান সমাজের নিবিড় সম্পর্কের কারণে বাঙালি মুসলমানের প্রাত্যহিক জীবনের রীতিনীতি লেখক যে ভাবে তুলে ধরেছেন তা নিঃসন্দেহে সমাজবিজ্ঞানীদের কাছে গবেষণার প্রভূত রসদ জোগাবে। যেমন নদিয়ার হাঁসপুকুরে যেখানে লেখকের বড় হয়েছেন সেখানে ঈদের বদলে ‘রোজা ঠান্ডা’ শব্দবন্ধই বহুল প্রচলিত ছিল।
মুসলমান সমাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মেলামেশার কারণেই তাঁর লেখনীতেও এমন কিছু শব্দ এসেছে— যেমন ‘জিম্মা’ বা ‘লেবাস’ যা মুসলমান সমাজে বহুল ব্যবহৃত শব্দ অথচ অ-মুসলমান সমাজ আজও এই সব শব্দেই হোঁচট খায়। এই সব শব্দের মূল উৎস আরবি বা ফার্সি হলেও এরা অনেক আগেই বাংলার শব্দভাণ্ডারে নিজেদের জায়গা ভাল ভাবেই করে নিয়েছে। স্বঘোষিত বাঙালির ‘কলমবাজি’তে প্রায় দশ হাজারের কাছাকাছি বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত আরবি ফার্সি ও উর্দু শব্দ পথ হারিয়েছে।
এই শব্দভাণ্ডারের কিছু নমুনা লেখক সচেতন ভাবে নিজের মতো করে তাঁর বিভিন্ন লেখার ফাঁকে ফাঁকে ব্যবহার করেছেন। এ ছাড়া মুসলমান সমাজের অভ্যন্তরীণ টানাপড়েন নিয়েও তিনি খোলামনে আলোচনা করেছেন, যেমন কোরানের তালাকের সঙ্গে প্রচলিত তাৎক্ষণিক তিন তালাকের বিস্তর ফারাকের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন, এর ফলে সুবিধাবঞ্চিত মেয়েরাই সবচেয়ে বেশি সমস্যার শিকার হয়।
এই সংকলনের মূল প্রবন্ধের সঙ্গে পরিশিষ্টে আরও ছয়টি প্রবন্ধ যুক্ত করা হয়েছে। এই ছয়টি প্রবন্ধ সময়ের প্রয়োজনে বা বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে লেখা হলেও আলোচ্য বইয়ের প্রধান যুক্তির সঙ্গে এগুলির যথেষ্ট সাযুজ্য আছে।
বইটি দুর্বলতামুক্ত নয়। যেমন বইয়ের প্রচ্ছদে আরবি হরফের ধাঁচে শিরোনাম ‘মুসলিম জাহান’ লেখা ও প্রচ্ছদের ছবি আসলে মুসলমান সমাজকে আবার সেই এক ছাঁচে ফেলে দেওয়ার মানসিকতারই পরিচয় বহন করে। লেখক সমগ্র বই জুড়ে যত্ন করে এই ছাঁচ ভাঙার চেষ্টাই করে গিয়েছেন, অথচ তাঁর বইয়ের মলাটে আবার সেই ছাঁচটাই বহাল। তাই মলাট দিয়ে এই বইকে বিচার করলে যেমন ভুল করা হবে, তেমনই এই বইয়ের মলাট বইয়ের প্রয়োজনেই অন্য রকম হওয়া দরকার ছিল। এই বইয়ের উপ-শিরোনাম ‘পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সময় অসময়ের বৃত্তান্ত’ বইয়ের প্রচ্ছদে ব্যবহার না করার ফলেও কিছুটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে কারণ ‘মুসলিম জাহান’ বলতে বিশ্বের তামাম মুসলমানের কথাই বলা হয়। লেখক বইয়ের শুরুতে কৈফিয়ত দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘লিখতে গিয়ে তথ্যের পুনরাবৃত্তি হয়েছে’ অথবা ‘পুরনো বস্তাপচা কথাগুলো কতদিন ধরে কত বার বলা হল’। এক কথা বার বার বলা নিয়ে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেন, ‘আমাকে অনেকেই অনুযোগ করেন আপনি এক কথা বার বার বলেন কেন? আমি বলি কারও ক্যান্সার হলে তাকে বারবার চিকিৎসা করার কথা না বলে আর কী কথা বলা যেতে পারে আমি জানি না’। সহবাসী হয়েও বিপুল ভাবে বিচ্ছিন্ন মুসলমান সমাজ সম্পর্কে ‘অসীম অবজ্ঞা ও অজ্ঞতা’ দূর করতে একই কথা ও একই তথ্যের ব্যবহার করাটা জরুরি, এখানেই এই সময়ে এই বইয়ের সার্থকতা ও প্রয়োজনীয়তা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy