শিল্পী: রবীন রায়
সম্প্রতি বিড়লা অ্যাকাডেমির ৪৭তম বার্ষিক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল। চারুকলার সর্বভারতীয় চালচিত্রের একটি রূপরেখা আভাসিত হয় প্রতি বছর এই প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে। এবারের প্রদর্শনী দু’টি ভাগে বিভাজিত। একটি অংশে দেখানো হয়েছে দক্ষিণ ভারতের সাম্প্রতিক দৃশ্যকলার নিদর্শন। দ্বিতীয় ভাগ প্রতি বছরের মতো নির্বাচিত ও প্রতিযোগিতামূলক। এক দিকে ঐতিহ্যের আলোকিত প্রজ্ঞা, অন্য দিকে সাম্প্রতিকের প্রযুক্তি অধ্যুষিত জটিল বাস্তবের অন্তর্নিহিত সংঘাত, এই দুইয়ের সমন্বয় ও টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে কেমন করে চলছে কালচেতনা-সম্পৃক্ত দৃশ্যরূপের সন্ধান তার আভাস প্রদর্শনীটিকে তাৎপর্যপূর্ণ করেছে।
প্রথমে দক্ষিণ ভারতীয় সম্ভার। এর শিরোনাম ‘দখিনের হাওয়া’। প্রদর্শনীটি কিউরেট করেছেন জনি এম.এল। নির্বাচিত হয়েছেন ২৫ জন শিল্পী। এর মধ্যে মাত্র একজন মহিলা। আজকের সর্বভারতীয় ও আন্তর্জাতিক ঐক্যের আবহের মধ্যেও দক্ষিণ ভারতীয় শিল্পের একটি স্বতন্ত্র ‘আইডেন্টিটি’ বা আত্মপরিচয় রয়েছে।
কে.জি.সুব্রামনিয়নের ছবিতে এই বৈশিষ্ট্য খুব স্পষ্ট ভাবে অনুধাবন করা যায়। ১৯৮৯-এর ‘শিব-পার্বতী ইন বেনারস’ ছবিতে পুরাণকল্পের ভিতর দিয়ে প্রবহমান লৌকিককে সাম্প্রতিকের মূল্যমানে অভিষিক্ত করেছেন। পাশাপাশি কে ভি হরিদাসনের ছবিতে দেখা যায় তান্ত্রিক পুরাণকল্প কেমন করে আধুনিক বিমূর্ততায় অভিষিক্ত হয়ে স্বতন্ত্র ভারতীয় আত্মপরিচয় সন্ধান করছে। বি মঞ্জুনাথ কামাথ অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রজন্মের শিল্পী। পাশ্চাত্যের জাদু-বাস্তবতাকে সুররিয়ালিস্ট কল্পরূপের দিকে নিয়ে গেছেন। গ্রটেস্ক বা কিমাকারের অন্য এক রূপ রয়েছে অরুণ কুমার এইচ.জি.-র ‘পুণ্যকোটি’ শীর্ষক পেপার পাল্প ও সাদা সিমেন্টের ভাস্কর্যে। দুটি সাদা বাঘ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। গোপীনাথ সুব্বান্নার (১৯৭০) সিরামিক ও ফাইবার গ্লাসে জলজ পত্রমঞ্জরির বিন্যাসে সহজ সৌন্দর্য ঝংকৃত হয়। এ ছাড়াও মনোনীত শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন এ.রামচন্দ্রন (১৯৩৫), সি.ডগলাস (১৯৫১), কে.এস.রাধাকৃষ্ণণ (১৯৫৬), লক্ষ্ম গৌড় (১৯৪০), এস.নন্দগোপাল (১৯৪৬), এস.জি.বাসুদেব (১৯৪১), শান্তিমণি মুদ্দাইয়া (১৯৩৭) প্রমুখ।
প্রতিযোগিতামূলক বিভাগে নির্বাচিত হয়েছেন ১৬৪ জন তরুণ শিল্পী। পুরস্কৃত হয়েছেন দশ জন। ভাস্কর্যে সুরজিৎ সরকার ও অমিত দেবনাথ, ছাপচিত্রে নীলাঞ্জন দাস ও মণীশ কিশোর। আলোকচিত্রে পল্লবী দাস ও শিবাশিস দাস। ড্রয়িং-এ অভিজিৎ সিংহ ও রাজাপ্পা রায়। চিত্রে মল্লিকা দাস সুতার। পুরস্কৃত হয়েছে ‘দ্য মেকানিক’ শীর্ষক একটি ভিডিয়ো ইনস্টলেশন। শিল্পী দুর্বানন্দ জানা। পুরস্কারের জন্য নির্বাচন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সংশয়ের ঊর্ধ্বে থাকে না। শিল্পকলায় সর্বশ্রেষ্ঠ অভিধাটি সব সময়ই বিতর্কিত।
প্রদর্শনীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি ছবি রবীন রায়ের পেপার পাল্প, গ্রাফাইট ও জলরঙে আঁকা ‘লাইফ ইন দ্য হ্যাঙ্গিং হাইরাইজ’। বিস্তীর্ণ শূন্য পরিসরের মধ্যে একটি আকাশচুম্বী অট্টালিকা। চূড়া ধরে তাকে উত্তোলন করছে একটি ভাসমান বিচ্ছিন্ন হাত। অন্য প্রান্তে বৃক্ষ, সুড়ঙ্গ ও পেপার পাল্পের উত্তল পরিসর। মিথকথনে আজকের নাগরিক সংকট ধরা পড়েছে। অরুণাংশু রায়ের মিশ্রমাধ্যমে ‘সিটিস্কেপ’ লৌকিক রূপবন্ধের সমাহার। ভোলানাথ রুদ্রের ‘কনট্রাস্ট’ স্বাতন্ত্র্যময়। পিনাকী গায়েনের ‘মাটি টাকা টাকা মাটি’তে অজস্র হাজার টাকার নোট ব্যবহৃত হয়েছে। প্রশান্ত ঘোষের ‘ড্রপিং লাইফ’ স্বাতন্ত্রের স্বাক্ষর।
স্বপন কুমার দাসের এচিং ‘ইভিনিং লাইট অ্যান্ড কালার’ লন্ঠনের আলোর ভিতর আঁধারলীনতা সুন্দরভাবে উদ্ভাসিত। শ্রীনিবাস রাও তাদুতুড়ির উডকাট ‘স্কারি ক্যাট’ প্রচ্ছন্ন কৌতুকে দীপ্ত। মানিক কুমার ঘোষের সেরিগ্রাফি ‘ব্ল্যাক স্কেপ’ মৃণালকান্তি ঢালির সেরিগ্রাফ ‘ডোন্ট’, নীলাঞ্জন দাসের লিনো ও সিনকোলে ‘ইফ আই গেট আ জব ইন আ রিয়েল এস্টেট’, ত্রিভুবন কুমারের এচিং ও অ্যাকোয়াটিল্ট ‘এইম অব লাইফ’, বীরা রেড্ডি ভেলুথুর্লা-র লিথোগ্রাফ ‘ডোন্ট লুক অ্যাট মি’ ইত্যাদি ছাপচিত্রের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাজ। আলোকচিত্রে সায়ন্তন মুখোপাধ্যায়, মৃণালকান্তি ঢালি বিষয় ও উপস্থাপনার গুণে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ভাস্কর্যে জয়ন্ত ভট্টাচার্যের গিরগিটিতে রূপান্তরিত মানুষ, মায়াধর সাহু-র কাঠ ও পেরেকে গড়া চারটি কাঁঠাল, রাজু সরকারের এক ছড়া ডাবের উপর বেঁধা একটি দা, মৌসুমী সরকারের ছাদ থেকে ঝুলন সামিয়ানা সহজ কিন্তু চিন্তাদীপ্ত কাজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy