Advertisement
১২ জানুয়ারি ২০২৫
Book Review

সঙ্গীত যখন সেবার দোসর

গ্রন্থটির আসল জোরের দিক তার ভূমিকা। ছবি বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের কথা সে ভাবে কোথাও লিখে রেখে যাননি, তাঁর সঙ্গীত ও সাধনার কথা ব্যক্তিগত গরজে কেউ লিপিবদ্ধও করেননি।

অলক রায়চৌধুরী
শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২৪ ০৯:৩৮
Share: Save:

কীর্তনের সাধিকা, কিন্তু প্রথম পছন্দের গান ‘বন্দে মাতরম্‌’। ন’বছর বয়স যখন, তখন থেকেই নানা সভায় শুনিয়েছেন সে গান। শুনিয়েছেন গান্ধীজি এবং রবীন্দ্রনাথকেও। সম্পন্ন ব্যবসায়ী পিতার ষষ্ঠ সন্তান ছিলেন ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়। বাড়িতে দু’খানি গাড়ি থাকা সত্ত্বেও ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসে চেপে এক পয়সা বাঁচাতেন দুঃস্থ, নিরন্ন দেশবাসীর কথা মনে রেখে। সেবাধর্মে দীক্ষিত তাঁর পরিবারে প্রধান পরিধেয় ছিল খদ্দর। ১৯২৪-এ (মতান্তরে ১৯২৬) জন্ম ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন সেবার মন্ত্রেই বিকশিত। সঙ্গীত সেখানে দোসরের ভূমিকায়।

গ্রন্থটির আসল জোরের দিক তার ভূমিকা। ছবি বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের কথা সে ভাবে কোথাও লিখে রেখে যাননি, তাঁর সঙ্গীত ও সাধনার কথা ব্যক্তিগত গরজে কেউ লিপিবদ্ধও করেননি। নিজের কথা তিনি কম বলতেন, শুনতেন বেশি। এই অবস্থায় সম্পাদকদ্বয় দায় এড়িয়ে মামুলি স্তুতির দায়সারা এক শতবার্ষিকী-স্মারক প্রকাশ করতে পারতেন। তা না-করে ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্থানের কালে সমাজ ও সময়ের চেহারাটা কেমন ছিল, সে সম্পর্কে অনেক জরুরি কথা বলেছেন। ১৯২৬-এ প্রয়াত চিত্তরঞ্জন দাশের দেশানুরাগ ও সঙ্গীতপ্রীতি তাবৎ বঙ্গজনকে প্রাণিত করেছিল, ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ও তাঁদের এক জন। ভূমিকায় সবিস্তারে এসেছে সে প্রসঙ্গ। কীর্তনিয়া রাধারানী দেবীর সাধারণ্যে জনপ্রিয়তার কথাও উঠে এসেছে প্রাসঙ্গিক ভাবেই।

এ আবহে শুধু লীলাকীর্তন নয়, রবীন্দ্রসঙ্গীত-সহ পরম্পরাবাহিত সব বাংলা গানেই মর্যাদাপূর্ণ কণ্ঠের অভিব্যক্তিতে ক্রমে শিরোনামে উঠে আসেন ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়। বেসিক ডিস্ক ছাড়াও, রাইকমল-সহ প্রায় চল্লিশটি ছবিতে কীর্তন ও অন্যান্য গান শুনিয়ে মোহিত করেন। রাইকমল-এর গানের জন্য পেয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কার। স্বয়ং আলাউদ্দিন খান এবং দবীর খানের সুপারিশে একই বছরে (১৯৪৭) তিনি ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় পান ‘গীতশ্রী’ সম্মান। বইটিতে ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের রেকর্ডগুলির একটি তালিকা আছে। সেখান থেকে জানা যায়, লালন সাঁইয়ের গানেরও রেকর্ড ছিল তাঁর। পাশাপাশি শান্তিদেব ঘোষের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখে তা বিশ্বভারতীর অনুমোদনের জন্য পাঠানো হলেও, তাঁর একখানি গানও সঙ্গীত সমিতির সবুজ সঙ্কেত পায়নি। বিষয়টি ব্যথিত করেছিল ওঁকে। এ তথ্য মেলে দেশ পত্রিকার জন্য নেওয়া কিশলয় ঠাকুরের এক সাক্ষাৎকারে।

কুড়ি বছর টানা অধ্যাপনা না করার কারণে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পেনশন থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন গীতশ্রী। এ দিকে তবলার জাদুকর হীরেন্দ্রকুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো তিনিও যে গুরুর কাছে প্রতিজ্ঞা করে বসে আছেন— আসরে সঙ্গীত পরিবেশনের জন্য কদাপি অর্থ নেবেন না। শেষ জীবনে আর্থিক অনটনের কারণে সে প্রতিজ্ঞা রাখা হয়নি প্রচারবিমুখ মানুষটির। সংসারে জড়াননি নিজেকে, দানধ্যান ভক্তিতেই বিশ্বাস রেখেছেন। আনন্দময়ী মায়ের নামগান ছিল আত্মার আশ্রয়।

সঙ্কলনে রয়েছে সাদা-কালো ও রঙিন ছবি, গানের খাতার পৃষ্ঠা, শিল্পীর রেকর্ডের প্রচ্ছদ। লিখেছেন সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রদীপকুমার ঘোষ, নির্মাল্য বন্দ্যোপাধ্যায়, উমা চট্টোপাধ্যায়, সুরজিৎ সেন, কঙ্কনা মিত্র, সুজাতা মিত্র, সুনন্দা সান্যাল, কৃষ্ণপ্রিয়া দাসী ও অজন্তা রায়চৌধুরী। আছেন ছাত্রছাত্রী, গবেষক, অধ্যাপক। সবার স্মৃতিচারণে উঠে এসেছে শিল্পীর সাধনাদীপ্ত জীবনের নির্যাস। উমা চট্টোপাধ্যায় ও অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত বইটি পড়তে পড়তে সেই ঋজু অথচ কোমল কণ্ঠটি ভেসে ওঠে।

অন্য বিষয়গুলি:

book review Book
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy