ছবি: এএফপি।
চিন আঁতুড় হওয়ায় করোনাভাইরাসের প্রকোপে ছিঁড়তে বসেছে বহু পণ্যের জোগান-শৃঙ্খল (সাপ্লাই চেন)। বিশ্ব ঘরবন্দি হতে বাধ্য হওয়ায় প্রতিদিন আরও বেশি করে ধাক্কা খাচ্ছে চাহিদা। অথচ তা দেখেও বাড়ি থেকে বেরিয়ে কেনাকাটায় উৎসাহ দিতে পারছে না কোনও দেশের সরকারই। আঁচ করা যাচ্ছে না কত দিন ধরে কত দেশকে এমন ‘হাত-পা বাঁধা অবস্থায়’ এই শত্রুর মুখোমুখি হতে হবে তা-ও। মূলত এই ত্র্যহস্পর্শেই এই মুহূর্তে বিশ্ব অর্থনীতি ত্রস্ত বলে ধারণা অনেক বিশেষজ্ঞের। যদিও তারই মধ্যে ভারতের জন্য ভেসে ওঠা সামান্য সুযোগও যাতে না-ফস্কায়, কেন্দ্রকে তা নিশ্চিত করার পরামর্শ দিচ্ছেন তাঁরা।
কম খরচে, এক লপ্তে বিপুল পরিমাণ পণ্য উৎপাদনের ঢালাও পরিকাঠামো থাকায় চিনে কারখানা নেই, এমন বহুজাতিকের দেখা মেলা ভার। তাই করোনাভাইরাসের কামড় সেই দেশের ঘাড়েই প্রথম পড়ায় চোট পেয়েছে সেই পণ্য তৈরি। আবার ওই দেশে তৈরি অনেক পণ্যকে যন্ত্রাংশ হিসেবে ব্যবহার করে অন্যান্য দেশেও তৈরি হয় আরও বহু পণ্য। সেই সবই এখন বিশ বাঁও জলে।
লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সের অধ্যাপক মৈত্রীশ ঘটকের কথায়, ‘‘বিশ্ব অর্থনীতিতে এই অতিমারীর প্রভাব পড়তে বাধ্য। ...পণ্য, শ্রম ও পরিষেবার যে ধারা বিশ্বায়িত অর্থনীতির ধমণী দিয়ে বয়ে চলে, তা ধাক্কা খেতে বাধ্য। জোগান-শৃঙ্খলে এই ব্যাঘাতের প্রভাব কত দূর গড়াবে, তা বলা শক্ত।’’
দুনিয়ায় করোনার কামড়
রাষ্ট্রপুঞ্জ: করোনার ত্রাসে বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষতির বহর দাঁড়াতে পারে ২ লক্ষ কোটি ডলার। বৃদ্ধির হার নামতে পারে ২.৫ শতাংশের নীচে।
আইএমএফ: বৃদ্ধির হার নেমে যেতে পারে ০.১-০.২ শতাংশ বিন্দু।
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক: বৃদ্ধির পূর্বাভাস ছাঁটাই ০.১%। এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলিতে তা হোঁচট খেতে পারে ০.২%-০.৫%।
মুডি’জ: বৃদ্ধির হার কমতে পারে ০.১%- ০.৪%।
আইএইচএস মার্কিট: ২০২০ সালেই বৃদ্ধি গোত্তা খেতে পারে ০.৪% পর্যন্ত।
আশঙ্কা
• একাধিক সমীক্ষায় দাবি, ২০০৮ সালের বিশ্বজোড়া মন্দার পরে করোনার আক্রমণেই সব থেকে বেশি ধাক্কা খাবে বিশ্ব অর্থনীতি।
• চিন সমস্যার আঁতুড়। সব চেয়ে বেশি আক্রান্ত ইউরোপ। ধাক্কা মার্কিন অর্থনীতিতেও। ফলে সঙ্কটের সুনামি থেকে বাঁচা শক্ত।
• একেই চাহিদার পালে হাওয়া না-থাকায় ঝিমোচ্ছিল ভারত-সহ বহু দেশের অর্থনীতি। এখন বিমান পরিবহণ, হোটেল থেকে শপিং মল— প্রায় সর্বত্র চাহিদায় টান পড়বে আরও বেশি।
• চিন কেন্দ্রস্থল হওয়ায় ছিঁড়ে যাবে বহু পণ্যের জোগান-শৃঙ্খলও (সাপ্লাই চেন)। ফলে উভয় সঙ্কট।
• সমস্যায় কবে, কী ভাবে রাশ পড়ানো যাবে, এখনও তা অস্পষ্ট। ফলে সঙ্কট শেষ পর্যন্ত কত বড় আকার নেবে, তা আঁচ করতে না-পারার কারণেই আতঙ্ক আরও বেশি।
দিল্লি স্কুল অব ইকনমিক্সের অধ্যাপক আদিত্য ভট্টাচার্যের আশঙ্কা, এই প্রভাব থাকবে বহু দিন। তাঁর কথায়, ‘‘করোনার ছায়া সরলে জোগান-শৃঙ্খল হয়তো ঠিক হবে। কিন্তু কম খরচের হাতছানিতে এই যে অন্য দেশে উৎপাদন আউটসোর্স করার মাসুল গুনতে হচ্ছে এত সংস্থাকে, তার প্রভাব হতে পারে সুদূরপ্রসারী।’’ তাঁর আশঙ্কা, এর পরে এত ঝুঁকি না-নিয়ে উৎপাদনের বড় অংশ নিজেদের দেশে ফেরাতে চাইবে বহু সংস্থা। ফলে ধাক্কা খেতে পারে ভারতের বিশ্বের রফতানি হাব হয়ে ওঠার স্বপ্নও।
শুধু জোগান নয়, পাল্লা দিয়ে টান চাহিদাতেও। জমায়েত বারণ। বহু দেশে রাস্তাঘাট ফাঁকা। শপিং মল, সিনেমা হলে তালা। ধুঁকছে বিমান পরিবহণ, হোটেল, পর্যটনের মতো পরিষেবা। সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-ক্যালকাটার অধ্যাপক জ্যোৎস্না জালানের মতে, ‘‘মানুষ রাস্তায় না-বেরোলে বিক্রি হবে কী ভাবে? কে চড়বেন বিমানে? হোটেলেই বা থাকবেন কে? আবার এই চাহিদায় মন্দার প্রভাব পড়বে অর্থনীতির বাকি ক্ষেত্রেও।’’ আশঙ্কা, এমনিতেই চাহিদার ভাটায় ঝিমিয়ে ছিল ভারত-সহ বহু দেশের অর্থনীতি। এর উপরে নতুন করে তা ধাক্কা খেলে, ফের তার প্রভাব কাটাতে বিস্তর কসরৎ করতে হবে। ঠিক যে ভাবে মার্কিন-চিন বাণিজ্য যুদ্ধের ধাক্কা না-কাটতে এই নতুন সঙ্কটের মোকাবিলা করতে হবে বিশ্ব বাণিজ্যকে।
সাধারণত চাহিদায় ভাটা দেখলে, মানুষের হাতে টাকা জুগিয়ে তাকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করে সরকার। সুদ ছাঁটাই করে শীর্ষ ব্যাঙ্ক। কিন্তু সেই সব দাওয়াইও প্রযোজ্য নয় এ ক্ষেত্রে। কারণ, অসুখ ছড়ানো ঠেকাতে আপাতত যথাসম্ভব ঘরবন্দি থাকা ও অপ্রয়োজনীয় সফর বাতিল করতে বলছে প্রায় সব দেশ। মৈত্রীশের কথায়, ‘‘নাগরিকদের স্বাস্থ্য ও সুরক্ষার থেকে বড় কিছু নয়। তাই সরকারের সেই দিকেই সব চেয়ে বেশি নজর দেওয়া উচিত। তা বাদ দিলে এই মুহূর্তে খুব কিছু করার আছে বলেও মনে হয় না।’’ আর এই মুহূর্তে কিছু করার রাস্তা সে ভাবে খোলা না-থাকাই বিশ্ব অর্থনীতির (বিশেষত প্রায় সব শেয়ার বাজারের) রক্তচাপ বাড়াচ্ছে, আশঙ্কা অনেকের।
দিল্লি স্কুল অব ইকনমিক্সের অধ্যাপক দিব্যেন্দু মাইতিরও মতে, এই মুহূর্তে সরকারের হাত-পা বাঁধা। রোগে বাঁধ দেওয়াই অগ্রাধিকার। কিন্তু এই যে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম ফের জলের দরে নামার সুবিধা মিলছে, কেন্দ্রের তাকে কাজে লাগানো উচিত বলে মত তাঁর। তিনি বলেন, ‘‘প্রথম দফায় ক্ষমতায় এসে দীর্ঘ দিন অশোধিত তেলের দাম কম থাকার সুবিধা সে ভাবে ঘরে তুলতে পারেনি মোদী সরকার। এই সঙ্কট ফের সেই সুযোগ সামনে এনেছে।’’ এই খাতে বাঁচানো টাকা উৎপাদনের আঁতুর হয়ে ওঠা, কাজের সুযোগ তৈরি ও সেই সূত্রে চাহিদা চাঙ্গা করার কাজে লাগানো উচিত বলে জানান তিনি। করোনা প্রতিরোধে আলাদা তহবিল তো বটেই,
এই সঙ্কট সামলে অর্থনীতির চাকায় গতি ফেরাতে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধিতে জোর দিচ্ছেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক ফিনান্স অ্যান্ড পলিসির অধ্যাপক লেখা চক্রবর্তীও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy