Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

মুশকিল আসান

নিয়ম করে প্রিমিয়াম গোনা সত্ত্বেও হয়তো চরম বিপদের দিনে জীবন বিমার সুবিধা দিতে গড়িমসি করছে সংস্থা। স্বাস্থ্য বিমার পর্যাপ্ত কভারেজ থাকা সত্ত্বেও বেঁকে বসছে চিকিৎসার খরচ দিতে। কিংবা ধরুন, বাড়ি-গাড়ির মতো অন্য সাধারণ বিমা নিয়েও সমস্যা হচ্ছে বিস্তর। বিমা ওম্বাডসম্যানের দরজায় কড়া নাড়ার পরামর্শ দিলেন প্রজ্ঞানন্দ চৌধুরীনিয়ম করে প্রিমিয়াম গোনা সত্ত্বেও হয়তো চরম বিপদের দিনে জীবন বিমার সুবিধা দিতে গড়িমসি করছে সংস্থা। স্বাস্থ্য বিমার পর্যাপ্ত কভারেজ থাকা সত্ত্বেও বেঁকে বসছে চিকিৎসার খরচ দিতে। কিংবা ধরুন, বাড়ি-গাড়ির মতো অন্য সাধারণ বিমা নিয়েও সমস্যা হচ্ছে বিস্তর।

শেষ আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

বিমা কোনও স্বল্প মেয়াদি পরিকল্পনা নয়। সারা বছর ধরে বিন্দু বিন্দু অর্থ সঞ্চয় করে জমা দিতে হয় এর প্রিমিয়াম। আর বিমা তো মোটে একটা নয়! রকমারি জীবন বিমার পাশাপাশি রয়েছে স্বাস্থ্য বিমা, দুর্ঘটনা বিমা। কারও কারও বাড়ি-গাড়ি বিমাও। এত ধরনের বিমার প্রিমিয়াম সারা বছরে বিভিন্ন সময়ে দেওয়ার জন্য আজকাল তো রীতিমতো লগ্নি পরিকল্পনা করতে হয়। কারণ বিমা এখন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। পরিবারের সদস্যদের সুরক্ষিত রাখার চাবিকাঠি।

কিন্তু বছরের পর বছর সেই টাকা লগ্নি করে যদি বিপদের মুহূর্তে কিংবা মেয়াদ শেষের পরে অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির মধ্যে পড়েন? কোনও কারণে যদি আটকে যায় জীবন বিমার টাকা? অথবা ধরা যাক, স্বাস্থ্য বিমার টাকা দিতে অস্বীকার করছে বিমা সংস্থা! কিংবা হয়তো দেখা গেল, যে সব সুবিধা পাওয়া যাবে বলে সংশ্লিষ্ট বিমা সংস্থা গোড়ায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, পলিসি কেনার পরে তার অনেকগুলিই পাচ্ছেন না! তখন?

মনে রাখবেন, এমন পরিস্থিতি আকছার না ঘটলেও নজিরবিহীন নয়। জীবন বিমার টাকা না দেওয়ার জন্য যে সব কারণ বিমা সংস্থা দেখাচ্ছে, তা শুনে মাথায় হাত গ্রাহকের আত্মীয়দের। অথচ সংশ্লিষ্ট বিমা সংস্থার কাছে সমাধান চেয়েও ফল মিলছে না। এমন পরিস্থিতিও তৈরি হয় কখনও-সখনও। স্বাস্থ্য বিমা, গাড়ি বিমার মতো সাধারণ বিমা এবং জীবন বিমার দাবি মেটানো নিয়ে এই ধরনের অনেক সমস্যায় পড়তে হয় গ্রাহককে।

সে ক্ষেত্রে কী করবেন? দৌড়বেন আদালতে? ক’জনেরই বা সেই সময় কিংবা সামর্থ রয়েছে? এই পরিস্থিতিতে গ্রাহকের পাশে দাঁড়ানোর জন্য রয়েছেন ইনশিওরেন্স ওম্বাডসম্যান বা বিমা লোকপাল। নিখরচায় এবং নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে গ্রাহক বিচার পেতে পারেন তাঁর দফতরে। ওম্বাডসম্যানের ভূমিকা, কখন কী ভাবে তাঁর দ্বারস্থ হওয়া যায়, অভিযোগ জানানোর সময়ে কোন কোন বিষয় মাথায় রাখতে হবে, সে ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনাই আজকের উদ্দেশ্য।

সারা দেশে ১৭টি

সারা দেশে বিভিন্ন রাজ্যে এখন বিমা ওম্বাডসম্যানের মোট ১৭টি দফতর রয়েছে। প্রত্যেকের জন্য এলাকা নির্দিষ্ট করা রয়েছে। অভিযোগকারীকে তাঁর বসবাসের ঠিকানার ভিত্তিতে নির্দিষ্ট ওম্বাডসম্যানের কাছে অভিযোগ জানাতে হবে। কলকাতার ওম্বাডসম্যানের দফতরের আওতায় রয়েছে পুরো পশ্চিমবঙ্গ এবং আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। সেই দফতরে যোগাযোগের ঠিকানা, ই-মেল আইডি এবং ফোন নম্বর সঙ্গের সারণিতে দেওয়া রইল।

বিমা ওম্বাডসম্যান কী?

বিমা ওম্বাডসম্যান একটি আধা বিচারবিভাগীয় কর্তৃপক্ষ। তার শীর্ষ পদাধিকারীকেই আদতে ওম্বাডসম্যান বলা হয়। বিমা সংক্রান্ত অভিযোগের সমাধানের জন্য তাঁর অধীনে একটি দফতর থাকে। কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের আর্থিক পরিষেবা দফতর এই ব্যবস্থাটি তৈরি করেছে। বিমা নিয়ন্ত্রক আইআরডিএ-র অধীনেই বিমা ওম্বাডসম্যান কাজ করেন। তাঁর দায়িত্ব হল, বিমা সংস্থার সঙ্গে ওই সংক্রান্ত বিষয়ে গ্রাহকের কোনও বিরোধ তৈরি হলে তার মীমাংসা করা।

ওম্বাডসম্যানের ক্ষমতা

• আগেই বলা হয়েছে, ওম্বাডসম্যান একটি আধা বিচারবিভাগীয় কর্তৃপক্ষ। তাঁর রায় বিমা সংস্থা মানতে বাধ্য।

• অবশ্য সেই রায় নিয়ে অভিযোগ থাকলে, সংস্থাগুলি হাইকোর্টে যেতে পারে। তবে তার নীচের কোনও আদালতে যেতে পারবে না তারা। তা ছাড়া আদালতকে অভিযোগ জানাতে হবে রিট পিটিশনের মাধ্যমে।

• কলকাতায় বিমা ওম্বাডসম্যানের দফতর চালু হয়েছিল ২০০০ সালে। তার পর থেকে এ পর্যন্ত চার বার বিমা সংস্থাগুলি ওম্বাডসম্যানের রায়ের বিরুদ্ধে আদালতে গিয়েছে। প্রত্যেক বার ওম্বাডসম্যানের রায়ই বহাল রেখেছে আদালত।

• বিমা সংস্থাগুলি ওম্বাডসম্যানের রায় মানতে বাধ্য থাকলেও, গ্রাহক কিন্তু মানতে বাধ্য নন। তিনি সব সময়েই ওই রায়ের বিরুদ্ধে নিম্ন ও উচ্চ আদালত, ক্রেতা সুরক্ষা আদালত-সহ যে কোনও উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে বিচার চেয়ে আবেদন জানাতে পারেন।

অভিযোগ কখন

• জীবন বিমা কিংবা সাধারণ বিমার দাবি যদি সংশ্লিষ্ট বিমা সংস্থা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে (আইআরডিএ-র নির্ধারিত সময়সীমা) না মেটায়, তা হলে গ্রাহক ওম্বাডসম্যানের কাছে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন।

• বিমা সংস্থা যদি দাবির পুরো অথবা আংশিক ভাবে না মেটায়, তা হলেও অভিযোগ করা যাবে।

• বিমার পলিসি অনুযায়ী প্রিমিয়াম মেটানো নিয়ে কোনও সমস্যা তৈরি হলেও এই দফতরে কড়া নাড়া যায়।

• বিমা বিক্রির সময়ে অথবা তার পরে বিমার শর্তের ভুল ব্যাখ্যা করা হলেও অভিযোগ জানাতে পারেন।

• পলিসি চালু থাকাকালীন যে সমস্ত পরিষেবা দেওয়া হবে বলে বিমা সংস্থা বা তার এজেন্ট প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, পরে সেই পরিষেবা না দেওয়া হলেও তা বলা যেতে পারে।

• প্রিমিয়াম জমা দেওয়ার পরেও পলিসি ডকুমেন্ট গ্রাহককে না দিলে।

• অনেক সময়েই দেখা যায়, পলিসি কেনার জন্য যে প্রস্তাবে গ্রাহক সই করেছিলেন, তার বদলে তাঁকে অন্য পলিসি দেওয়া হয়েছে। এই ধরনের ক্ষেত্রে বিমা ওম্বাডসম্যানের কােছ অভিযোগ জানাতে পারেন গ্রাহক।

• ১৯৩৮ সালের বিমা আইনে, আইআরডিএ-র নির্দেশ বা সার্কুলারে পলিসি সংক্রান্ত বিষয়ে গ্রাহকের যে সব সুবিধার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তা নিয়ে বিমা সংস্থার সঙ্গে বিরোধ বাধলে গ্রাহক ওম্বাডসম্যানের কাছ অভিযোগ জানাতে পারেন।

কোন অভিযোগ গ্রাহ্য হবে না

ওম্বাডসম্যানের দ্বারস্থ হওয়ার আগেই যদি গ্রাহক আদালত, ক্রেতা সুরক্ষা আদালত বা আরবিট্রেটরের কাছে অভিযোগ দায়ের করে থাকেন এবং তা যদি বিচারাধীন হয় অথবা আদালত যদি রায় দিয়ে থাকে, তা হলে সেই অভিযোগ ওম্বাডসম্যান আর গ্রাহ্য করবেন না।

গ্রাহকের করণীয়

• কোনও অভিযোগ নিয়ে প্রথমেই ওম্বাডসম্যানের দ্বারস্থ হওয়া যাবে না। অভিযোগের সুরাহার জন্য আগে সংশ্লিষ্ট বিমা সংস্থার কাছে লিখিত ভাবে সমস্যার কথা জানাতে হবে।

• যে দিন বিমা সংস্থা সেই অভিযোগ হাতে পাবে, তার পর থেকে এক মাসের মধ্যে যদি তারা সুরাহা না করে সেটি বাতিল করে দেয় অথবা অভিযোগের উত্তরই না দেয়, তবে ওম্বাডসম্যানের কাছে অভিযোগ জানাতে পারবেন। তবে তা করতে হবে পরবর্তী এক বছরের মধ্যে।

• অভিযোগের যে সুরাহা বিমা সংস্থা করবে, তাতে গ্রাহক সন্তুষ্ট না হলেও অবশ্য তিনি ওম্বাডসম্যানের দ্বারস্থ হতে পারেন।

• ওম্বাডসম্যানের কাছে অভিযোগ জানালে সংশ্লিষ্ট বিরোধের বিষয়ে ওম্বাডসম্যান হস্তক্ষেপ করতে পারেন— সেই মর্মে গ্রাহককে লিখিত সম্মতিপত্রে সই করতে হবে। তবেই তাঁর অভিযোগ নিয়ে বিচার করবেন ওম্বাডসম্যান। একই ভাবে সম্মতি নেওয়া হয় বিমা সংস্থারও।

অভিযোগের পদ্ধতি

• প্রথমে দেখতে হবে, গ্রাহক কোন ওম্বাডসম্যানের আওতায় পড়ছেন।

• গ্রাহক নিজে অথবা তাঁর কোনও উত্তরাধিকারী বা নমিনির মাধ্যমে লিখিত ভাবে ওম্বাডসম্যানের কাছে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন।

• কোনও আইনজীবীর মাধ্যমে ওম্বাডসম্যানের কাছে যাওয়া যায় না।

• এখানে অভিযোগ জানাতে গ্রাহককে কোনও ফি দিতে হয় না।

জানাতে হবে

• অভিযোগকারীর নাম, ঠিকানা, বিমা সংস্থার নাম ও তার সংশ্লিষ্ট শাখা।

• অভিযোগের বিস্তারিত বিবরণ।

• অভিযোগ প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় নথি। গ্রাহক কী ধরনের ক্ষতির শিকার হয়েছেন, তার বিবরণ।

• ওম্বাডসম্যানের কাছে কী বিচার ও সংস্থার কাছে কত ক্ষতিপূরণ চাইছেন, তা অভিযোগপত্রে লিখতে হবে।

• প্রয়োজন অনুযায়ী ওম্বাডসম্যান অতিরিক্ত নথি চাইতে পারেন।

সমাধান কী ভাবে

• প্রায় সব ক্ষেত্রেই ওম্বাডসম্যান প্রথমে চেষ্টা করেন গ্রাহক এবং বিমা সংস্থাকে এক টেবিলে বসিয়ে আলোচনার মাধ্যমে আপসে অভিযোগের মীমাংসা করতে। সেই চেষ্টা ব্যর্থ হলে, তিনি দু’পক্ষের লিখিত এবং মৌখিক বয়ান, মামলার নথি ইতাদি বিচার করে রায় ঘোষণা করেন।

• আপসে অভিযোগের সমাধান হলে গ্রাহক কী কী সুবিধা পাবেন এবং বিমা সংস্থাকে কী কী (ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি) দিতে হবে, সে ব্যাপারে ওম্বাডসম্যান তাঁর সুপারিশ এক মাসের মধ্যে উভয় পক্ষকে জানিয়ে দেন।

• মধ্যস্থতা করার জন্য দু’পক্ষের লিখিত সম্মতি পাওয়ার দিন থেকে এক মাস সময় হিসেব করা হয়।

• বিমা সংস্থাকে ১৫ দিনের মধ্যে সুপারিশ কার্যকর করতে হবে।

• কিন্তু এই পথে হেঁটে আপসে মীমাংসা না হলে দু’পক্ষের জমা দেওয়া নথি এবং শুনানির সময়ে দেওয়া মৌখিক বয়ান বিচার করে ওম্বাডসম্যান তিন মাসের মধ্যে রায় দেবেন। সমস্ত নথি ওম্বাডসম্যানের হাতে পৌঁছানোর পর থেকে ওই তিন মাস সময় হিসেব করা হবে।

• রায় হাতে পাওয়ার পরে বিমা সংস্থাকে ৩০ দিনের মধ্যে তা কার্যকর করতে হবে।

ক্ষতিপূরণের পরিমাণ

গ্রাহকের যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, ক্ষতিপূরণের অঙ্ক কখনও তার বেশি হবে না। ওম্বাডসম্যানের কাছে এর সর্বোচ্চ অঙ্কও আবার ৩০ লক্ষ টাকা। বিমা সংস্থা যদি আগে কিছু টাকা মিটিয়ে থাকে, তা বাদ দিয়েই ক্ষতিপূরণের হিসেব কষা হবে।

মনে রাখবেন, ওম্বাডসম্যানের কাছে অভিযোগ দায়েরে খরচ লাগে না। আইনজীবীও নিয়োগ করা যায় না। গ্রাহক নিজে বা তাঁর মনোনীত ব্যক্তিই শুধু বক্তব্য জানাতে পারেন।

অন্য বিষয়গুলি:

Tips Policy Ombudsman
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE