সাধারণ চাকুরে সুরজিৎ ঘোষের মায়ের প্রয়োজন পেসমেকারের। কম করে এক লক্ষ পঁচিশ হাজার টাকা খরচ। কিন্তু চিকিৎসার জন্য ইতিমধ্যেই হাজার চল্লিশেক টাকা খরচের পরে তাঁর হাত খালি। দিশাহারা সুরজিৎবাবুকে আশার আলো দেখায় বেসরকারি ঋণ সংস্থা, যারা শুধুমাত্র চিকিৎসার জন্যই ধার দেয়।
মুম্বইবাসী সুরেশ শর্মা ছোট একটি জুতোর দোকান চালান। মেয়ের পায়ে অপারেশনের জন্য ৬০ হাজার টাকা এক সঙ্গে খরচ করার সামর্থ্য নেই। সে যাত্রায় ওই একই সংস্থা চিকিৎসার খরচ ঋণ হিসেবে দিয়েছিল।
দুর্গাপুরের সুরজিৎ ঘোষ বা মুম্বইয়ের সুরেশ শর্মার সমস্যা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ভারতে প্রতি বছর চার কোটি মানুষ চিকিৎসার বিপুল খরচ বহন করতে গিয়ে দারিদ্রসীমার নীচে চলে যান। বিভিন্ন সমীক্ষা অনুযায়ী বছর বছর এই সংখ্যা বাড়ছে। বিমার মতো সামাজিক-আর্থিক নিরাপত্তার আওতায় থাকা মানুষের সংখ্যা এখনও নেহাতই কম। দেশ জুড়ে বিমার প্রিমিয়াম গড় জাতীয় আয়ের কত শতাংশ, সেই হিসেব কষেই বিমার প্রসার কতটা, তা বোঝা যায়। ২০১৪ সালে তা ছিল ৩.৯ শতাংশ, যা এ বছর আরও কমে দাঁড়িয়েছে ৩.৩ শতাংশ।
এই ঘাটতি খুলে দিচ্ছে নতুন ব্যবসার সুযোগ, যে-ব্যবসার চোখ বিত্তবানদের দিকে নয়। মেডিক্যাল লোন বা চিকিৎসা খাতে ঋণ দেওয়ার ব্যবসায় মূল ক্রেতা কম রোজগেরে মানুষ। সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, এই বাজারের মাপও বিশাল, দেশের গড় জাতীয় আয়ের প্রায় তিন শতাংশ ।
সুরজিৎ ঘোষ ও সুরেশ শর্মার মতো মানুষের হাত ধরেই ব্যবসা শুরু করেছে মুম্বইয়ের সংস্থা ‘আরোগ্য ফিনান্স’। এই সোশ্যাল স্টার্ট-আপ সংস্থার দুই কর্ণধার জোস পিটার ও ধীরাজ বাত্রার দাবি, শুধু ব্যবসায়িক লাভ নয়, যাঁদের হাতে চিকিৎসার জন্য টাকা নেই, তাঁদের কাছে স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দিতেই সংস্থার জন্ম। যে-সব পরিবারের মোট মাসিক আয় ৭৫০০ থেকে ২০ হাজারের মধ্যে, তারাই আরোগ্য ফিনান্সের পরিষেবা পেতে পারে। দেশের ৫৫ কোটি মানুষ এই আয়ের আওতায় পড়েন। আর, সেই বাজারের দিকে নজর রেখেই ময়দানে নেমেছে আরোগ্য।
তবে চিকিৎসা বাবদ ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আরোগ্য ফিনান্স প্রথম সংস্থা নয়। সরকারি স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া ও টাটা ক্যাপিটালের মতো বেসরকারি সংস্থারও চিকিৎসার জন্য ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু তা সাধারণের নাগালের বাইরে বললেই চলে। স্টেট ব্যাঙ্কের শর্ত অনুযায়ী ঋণ পেতে সরকারি বা লাভজনক বেসরকারি সংস্থার কর্মী হতে হবে। ১০ বছর চাকরি থাকাও বাধ্যতামূলক। রয়েছে এমওয়াইএ হেলথ ক্রেডিট-এর মতো সংস্থাও, যে-সংস্থার সঙ্গে টাটা ক্যাপিটাল ও অন্যান্য ঋণদাতা সংস্থার গাঁটছড়া রয়েছে। তবে সে ক্ষেত্রেও রয়েছে বিভিন্ন শর্ত। যেমন ন্যূনতম ঋণের পরিমাণ ৭৫ হাজার টাকার উপরে হতে হবে। আর ঋণ পাওয়ার আগে ‘প্রসেসিং ফি’ বাবদও মোটা টাকা দিতে হবে। যা নিম্নবিত্ত পরিবারের পক্ষে দেওয়া কঠিন।
আর এই ঘটি-বাটি বিক্রি করে চিকিৎসার টাকা জোগানোর সমস্যা দূর করতেই নতুন ব্যবসায়িক মডেল তৈরি করেছে আরোগ্য। সংস্থার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জোস পিটার জানান, দু’লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেন তাঁরা। মাসিক ১ শতাংশ সুদের বিনিময়ে ঋণ দেওয়া হয়। তবে হিসেব করে নেওয়া হয়, যাতে মাসিক রোজগারের ২৫ শতাংশের বেশি না-হয় মাসিক কিস্তি। কোনও বন্ধক না-রেখেই এই ঋণ দেওয়া হয়।
সে ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যবসায় ঝুঁকি থেকে যায়। টাকা ফেরত না-পাওয়ার এই ঝুঁকি এড়াতে সাইকোমেট্রিক টেস্ট করছে সংস্থা। অর্থাৎ ঋণের ঝুঁকি মূল্যায়ন করতে ঋণগ্রহীতাদের মনের গতিবিধি যাচাই করে নেওয়া হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গ থেকেই এই সংস্থার যাত্রা শুরু। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ, মহারাষ্ট্র, গুজরাত, দিল্লি, কর্নাটক, তামিলনাড়ু ও কেরলে ব্যবসা করছে আরোগ্য ফিনান্স। বিহার, ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশার কিছু অংশেও ব্যবসা ছড়িয়েছে। ইতিমধ্যেই প্রায় ৮ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে তারা। পাঁচ বছরে ১০ লক্ষ পরিবারকে ঋণ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগোচ্ছে সংস্থা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy