Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Impact

পায়ের তলার মাটি সরছে অবসর নেওয়া মধ্যবিত্তের

মধ্যবিত্তের কথা আর কেই বা শুনতে চায়? কিন্তু এ বার বোধহয় সেই সময় আসছে যখন সংবাদমাধ্যমের প্রথম পাতায় ওই মালবাহীর বদলে থাকতেই পারে ভিক্ষোপজীবী মধ্যবিত্তের ছবি।

প্রতীকী চিত্র।

প্রতীকী চিত্র।

সুপর্ণ পাঠক
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০২০ ১৮:১৫
Share: Save:

“দিনে দিনে চাও পদতলে/ ভিখারি বানাও। কিন্তু মনে মনে জানোনি কখনো/ তুমি তো তেমন গৌরী নও।” —শঙ্খ ঘোষ

হয় করোনায় মরব, না হয় খিদেয়। সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় বড় বড় করে ছবি সহ মাল বয়ে জীবন কাটানো মানুষটার ছবি। সেটা ছিল নিভৃতবাসের প্রথম পর্যায়ে। কতিপয় মানুষ যদিও মধ্যবিত্তের কী হবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। কিন্তু যা হয়। মধ্যবিত্তের কথা আর কেই বা শুনতে চায়? কিন্তু এ বার বোধহয় সেই সময় আসছে যখন সংবাদমাধ্যমের প্রথম পাতায় ওই মালবাহীর বদলে থাকতেই পারে ভিক্ষোপজীবী মধ্যবিত্তের ছবি। ফুটপাথে মিলতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের কৃতী ছাত্রের জরাগ্রস্ত মুখ।

ভাবতে কষ্ট হচ্ছে? হয়ত এতটা হবে না। কিন্তু এর কাছাকাছি কোনও দৃশ্য হয়ত ততটা দূরে নয় যতটা আমরা ভাবছি। ফুটপাথে না-হলেও পথে বসার অনুষঙ্গটা কেন জানি না বড্‍ড উপযোগী লাগছে বর্তমান পরিস্থিতিতে। আরও কাছের মনে হচ্ছে আজ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার সুদের অঙ্কটা দেখে। এস বি আই উই কেয়ার নামে বয়স্কদের জন্য নতুন সঞ্চয় প্রকল্প এনেছে। পাঁচ বছরের উপর আমানতে পাওয়া যাবে ৬.৫ শতাংশ সুদ। এটা নাকি বাড়িয়ে করা হল। অথচ জানুয়ারি মাসেই বয়স্ক সঞ্চয় প্রকল্পে সুদ ছিল ৬.৬ শতাংশ। এখনকার থেকে ০১ শতাংশ বিন্দু বেশি।

কেন এই চরম ভাবনা তা ভাবতে একটু পিছিয়ে যেতে হবে। আলোচনার সুবিধার জন্য নেওয়া যাক তাঁদের, যাঁরা বছর খানেক হল অবসর নিয়েছেন। এবং বেসরকারি সংস্থা থেকে। অর্থাৎ পঞ্চাশের শেষের জাতকদের। অবসর নিয়েছেন লক্ষ টাকার উপর বেতন নিয়েই।

আরও পড়ুন: কেন্দ্র নগদ না জোগালে বেকারত্বের সুনামি আসছে দেশে: রাহুল

এঁদের চাকরি জীবন শুরু হয়েছে আশির দশকেই। এবং সাধারণ ঘরেই। তখন মাইনের হাল কী ছিল? কলেজ শিক্ষকের ১৮০০ টাকার মতো। মধ্যতিরিশে যখন মাথার উপর ছাদের চিন্তা তখন গৃহঋণে সুদ ১৬ শতাংশের কাছাকাছি। হাজার ছয়েক টাকা মাইনের বিনিময়ে তখন লাখ দেড়েকের বেশি ঋণ জুটত না। কিন্তু ওই সুদে বেতনের সিংহভাগ চলে যেত। ২০০০ সালের আগে দেশে বেতনের হার ছিল খুবই কম। আর ভবিষ্যতের পুঁজি ছিল মূলত প্রভিডেন্ট ফান্ড আর গ্রাচুইটির টাকা। আজকের অবসরভোগীরা কিন্তু ওই স্বল্প আয়ে উচ্চ চিন্তাকেই শ্রেয় মনে করে বড় হতে বাধ্য হয়েছেন।

আরও পড়ুন: হিসেব আগে, না কথা আগে? করোনা মোকাবিলায় বিভক্ত বিজ্ঞান

হ্যাঁ। স্বল্প স্বঞ্চয় প্রকল্পে সুদ ছিল ১১ শতাংশ। কিন্তু রাখার মতো উদ্বৃত্ত থাকত না। টেনেটুনে বিমা প্রকল্প। যা কিছু হয়েছে তা মোটামুটি হয়েছে ওই ২০০০ সালের পরেই। আচ্ছা না হয় ধরলাম পঞ্চাশের শেষের জাতক অবসর নিয়েছেন এ বছরই। ধরুন এক কোটি টাকা নিয়েই। তো এই ছয় শতাংশ সুদে বছরে তাঁর আয় কত হবে? ছয় লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা। অর্থাৎ মাসে ৫৪ হাজার টাকার একটু বেশি। এবং এই আয় কমতেই পারে আগামীতে। আপাতত যদিও আয় সংরক্ষণের স্বার্থে সুদের হার এই প্রকল্পে ধরে রাখার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। কারণ আপনার আয় ধরে রাখা বা সামাজিক সুরক্ষা নিয়ে নিবিষ্ট চিন্তা ও তার প্রয়োগ কোনও দিনই দেখা যায়নি।

চিন্তায় মধ্যবিত্ত। ফাইল চিত্র।

এবার আপনি একটি বিশেষ জীবন যাপনে অভ্যস্থ। সরকারি হাসপাতালে আপনি চিকিৎসার কথা ভাবতে পারেন না। দেশ জুড়ে কেরল ছাড়া কোনও সরকারই যে তা ভাবেনি, তা তো এই কোভিড কেলেঙ্কারিতেই স্পষ্ট। তাই আপনার একটি চিকিৎসা বিমা করা আছে। কিন্তু ৬০ বছরের পরে আপনার বিমার প্রিমিয়ামের অঙ্কও বাড়বে। সাত থেকে আট লক্ষ টাকার পারিবারিক বিমা করেছেন। এত দিন হয়ত হাজার তিরিশের মতো বছরে দিতেন। এ বার তা এক ধাক্কায় বাড়বে।

সেখানেই শেষ নয়। মার্শ ইন্ডিয়ার হিসাব অনুযায়ী দেশে চিকিৎসার খরচ বাড়ছে ১৮ শতাংশ হারে। আর আপনার আয় কমছে। করেছিলেন সাত লক্ষ টাকার বিমা, আইসিসিইউ বা নিবিষ্ট চিকিৎসার প্রয়োজন হলে ও’ টাকা ফুৎকারে উড়ে যাবে।

শুরু করেছিলাম করোনার প্রসঙ্গ তুলেই। কিন্তু ভাবতে তো সত্যিই খারাপ লাগে যে বার্ধক্যে আপনি হাসপাতালে আর আপনার পরমাত্মীয় শুধু আর্থিক টানেই আপনার মৃত্যু কামনা করছে!

আর এটা এড়াতেই আপনার বিমার অঙ্ক বাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। শুধু হাসপাতালের খরচ মেটানোর ব্যবস্থা করতেই বছরে আপনাকে লক্ষ টাকার বিমার প্রিমিয়ামের ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থাৎ মাসে ১০ হাজারের কাছাকাছি। হাতে থাকবে ৪০ হাজার টাকা। একটা ছোট গাড়ি রেখেছেন। তার রক্ষণাবেক্ষণ। কাজের লোক। সব দিয়েথুয়ে মধ্যবিত্ত আপনি কিন্তু নিঃস্ব। তবে মধ্যবিত্তের অহং নিয়ে হাত পাততে পারবেন না। বাবা-মা বেঁচে থাকলে বা ছেলের উচ্চশিক্ষার ঋণে এখনও নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য লড়াইয়ে ব্যস্ত সন্তান থাকলে তো আরও চমৎকার!

আর একই সঙ্গে খরচ বাড়ছে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যেরও। আর আপনার কিন্তু আয় কমছেই! সরকার কি এটা নিয়ে খুব চিন্তিত? মনে হয় না। ভারতে ১৩৮ কোটি মানুষের মধ্যে ১০ কোটির মতো বুড়ো মানুষ। ভারতে জনসংখ্যার অনুপাতে মধ্যবিত্তের সংখ্যা ৩ শতাংশ। এই অনুপাতই যদি মধ্যবিত্ত মানুষের অবসরের হিসাবে কাজে লাগাই তা হলে ১০ কোটির মধ্যে ৩০ লক্ষের মতো বয়স্ক মানুষ মধ্যবিত্ত আয়ের অবস্থান থেকে অবসর নিয়েছেন। ভোটের পাওয়ার হিসাবে এঁদের অঙ্ক খুব বড় নয় বলেই কি কেউ সে ভাবে ভাবেন না এঁদের নিয়ে!

আজ এই ৩০ লক্ষ কিন্তু বিপন্ন। এর বাইরেও কিন্তু আরও অনেকেই আছেন, ওই ১০ কোটির হিসাবে যাঁরা শুধু সুদেই বাঁচেন। সেই অঙ্কটা ঠিক কত তা বলা মুশকিল। বেশ কয়েক কোটি তো হবেই। সুদের সামান্য হেরফেরেই এঁদের আয় অক্ষুন্ন রাখা যায় না কি? সংখ্যাটা খুব বড় নয় বলেই। যাঁরা পারেন তাঁদের সুদ আরও অল্প কমিয়ে এঁদের আয়টা অক্ষুন্ন রাখার প্রচেষ্টা কি সত্যিই অসম্ভব? বিশেষ করে এই দেশে যেখানে সামাজিক সুরক্ষার সত্যিই কোনও বালাই নেই। মাথায় রাখা ভাল, ভোটের হিসাবে অকিঞ্চিৎকর হলেও জনমত তৈরিতে এঁদের ভূমিকা কিন্তু সামান্য নয়। বাঁচোয়া একটাই— এঁদের অহং। কিন্তু কত দিন?

অন্য বিষয়গুলি:

Interest rate
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy