অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বলেছেন এ বার এমন বাজেট হতে চলেছে যা গত ১০০ বছরে কেউ প্রত্যক্ষ করেননি। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
আর কয়েকটা দিন। তার পরেই কেন্দ্রীয় বাজেট। কেমন হবে কর প্রস্তাব? প্রতিবারের মতো তা নিয়ে শুরু হয়ে গিয়েছে জল্পনা। তবে এ বার ব্যাপারটা একটু অন্য রকম। স্বয়ং অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বলেছেন এ বার এমন বাজেট হতে চলেছে যা গত ১০০ বছরে কেউ প্রত্যক্ষ করেননি। এতটাই নাকি অভিনব!
অতিমারির ভয়াবহ সময়ের অনেকটাই এখন অতীত। এই সময়ে দাঁড়িয়ে সরকারের কোনও প্রতিশ্রুতি পর্যালোচনা করতে চাইলে আমাদের পুরো ব্যাপারটা দেখতে হবে ‘ইএসজি’ বা এনভায়রনমেন্ট, সোশ্যাল ও গভর্নেন্স কোশেন্ট-এর প্রেক্ষিতে। অর্থাত্ এই বাজেটের মূল্যায়ন করতে হলে তা পরিবেশ, সামাজিক ও প্রশাসনিক দক্ষতার আতস কাচে খতিয়ে দেখতে হবে। সরকারি প্রতিশ্রুতি বিচার করার সময়ে বরাবরই এনভায়রনমেন্ট বা পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং সামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনা করা হয়ে থাকে। কিন্তু গত এক বছর ধরে অতিমারির মধ্যে যে ব্যাপার না দেখলেই নয়, তা হল সরকার দেশটা চালাচ্ছে কেমন। শাসন ও পরিচালন ব্যবস্থাও পর্যালোচনার মধ্যে আনতে হবে। তবেই বুঝতে পারা যাবে সরকারি কোনও প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে কোনও ষড়যন্ত্র রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে পড়েনি তো!
আমাদের ভাল থাকা, করে-কম্মে খাওয়া, উন্নতি করা ইত্যাদি অনেক কিছুই সম্ভব হয় দেশে সরকার আছে বলে, আইনের শাসন আছে বলে। কিন্তু সরকারের শাসনব্যবস্থাই যদি নড়বড়ে হয়, তবে তো দেশে নৈরাজ্যের সৃষ্টি হবে, বিশৃঙ্খলা মাথাচাড়া দেবে। তাই অনেকেই মনে করেন, দেশে কড়া শাসনব্যবস্থা থাকলে তবেই কোনও বড়সড় বিপর্যয় এলে মোকাবিলা করা সহজ হয় এবং দেশের মানুষ সহজে কঠিন সময় অতিক্রম করতে পারেন। আবার ভাল শাসনব্যবস্থা থাকলে তবেই দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হয়, সম্পদের বিকাশ হয় এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু আমাদের দেশের এখন যা অবস্থা তাতে এ কথা কি আদৌ প্রযোজ্য?
সাম্প্রতিক কৃষক বিক্ষোভের কথাই ধরা যাক। সুপ্রিম কোর্ট মধ্যস্থতাকারী হিসেবে এগিয়ে না আসা পর্যন্ত কৃষকদের বিক্ষোভকে নিয়ে ভাবতেই চায়নি কেন্দ্র। এর আগেও বিভিন্ন বিষয়ে বিরোধীদের কথা শোনার অনীহা নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন উঠেছে। গণতন্ত্রের মূল শক্তি কিন্তু সব মতের সহাবস্থান। সরকার পরিচালনায় আলাপ-আলোচনার ক্ষেত্র উন্মুক্ত রাখা। কিন্তু কোথাও গিয়ে সরকার বিরোধিতা নিয়ে অসহিষ্ণু এই ধারণা ক্রমাগত দৃঢ় হচ্ছে। গণতন্ত্রে বিরোধী যুক্তি নীতি প্রয়োগকে শক্তিশালী করে, নীতির খামতি এড়িয়ে এগতে সাহায্য করে। আর এই কারণেই গণতন্ত্রে বিরোধীদের অবস্থান এতটা জরুরি।
সুশাসনের বজ্র আঁটুনির মাঝেও অনেক সময় ফস্কা গেরো ঘটে যায়। চিনের কথাই ধরা যাক। অভিযোগ, অনেক কড়া নিয়ম মেনে গবেষণা সত্ত্বেও উহান প্রদেশের গবেষণাগারের ভিতরে আটকে রাখা গেল না মারণ ভাইরাসকে। যদি সেটা করা যেত, তা হলেই তো সকলে চিনের দিকে আঙুল তুলত না।
একই যুক্তি দিয়ে আরও একটি বিষয় দেখে নেওয়া যাক। শাসনের চাপ রয়েছে বলেই কিন্তু ওষুধ সংস্থাগুলি বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের জীবনকে ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিয়ে দ্রুতগতিতে, যেমন-তেমন করে টিকা বানিয়ে বাজারে ছেড়ে দিতে পারছে না। কিন্তু শাসনের নিয়ন্ত্রণ যদি না থাকত তা হলে নিজেদের মুনাফার কথা ভেবে, মার্কেট শেয়ার বিবেচনা করে কিংবা বিভিন্ন স্বার্থ যা জনস্বার্থ বিরোধী সেই পথে হেঁটে এমন টিকা আনত যাতে ভালর বদলে মানুষের ক্ষতিও হতে পারত।
সরকারের প্রাথমিক কাজ কিন্তু সুশাসন বজায় রাখা। আশা করা যায়, স্রেফ কৃতিত্ব জাহির করার জন্য কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ হওয়ার আগে কিংবা দু’টি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে নির্বাচনের আগে ভোটারদের আকৃষ্ট করার লক্ষ্য নিয়ে বর্তমান সরকার ‘ধর তক্তা মার পেরেক’ পন্থায় বাজারে টিকা আনবে না।
মাথায় রাখতে হবে, সঙ্কটই কিন্তু প্রশাসনিক দক্ষতার সব থেকে বড় পরীক্ষা। আর বিভিন্ন মহলে গত কয়েক বছর ধরেই ভারতের আর্থিক নীতি পরিচালনার দক্ষতা নিয়ে নানান প্রশ্ন ঘুরে বেড়িয়েছে। বিশ্ব ব্যাঙ্ক ‘গ্লোবাল ইকনমিক প্রসপেক্ট রিপোর্টে’ বলেছে, ভারতে এমন সময়ে অতিমারির ছোবল পড়েছে যখন সেখানে এমনিতেই আর্থিক বৃদ্ধির হার কমতে শুরু করেছে। ২০২০-২১ আর্থিক বছরে আর্থিক সঙ্কোচন ৯.৬ শতাংশ হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। সাংসারিক খরচ এবং ব্যক্তি বিনিয়োগের হারও উল্লেখযোগ্য রকমের কমে গিয়েছে। যা স্বাভাবিক। তবে সুখের কথা বিশ্বব্যাঙ্ক এও মনে করছে যে পরিষেবা ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে ভারতে পরিস্থিতি শুধরোচ্ছে।
একেই তো বৃদ্ধির হার পড়ছিল। সেই অবস্থায় অতিমারির কারণে বাজারের চাকা কাদায় আটকে যায়। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে জুন ছিল ভারতীয় অর্থনীতিতে এই দশকের সবচেয়ে ভয়াবহ। জাতীয় উত্পাদন সঙ্কুচিত হয় ২৩.৯ শতাংশ, যা এক কথায় রেকর্ড। জুলাই মাস থেকে অবশ্য বাজার একটু একটু করে খোলায় সঙ্কোচনের হারও অনেকটাই কমে। তবে ৬ মাস ধরে টানা চলতে থাকা মন্দার প্রভাব যে সুদূরপ্রসারী হবে তা বলাই বাহুল্য।
এই সঙ্কোচনের ফলে উদ্ভুত পরিস্থিতির সঙ্গে যুঝতে না পেরে বহু ছোট-মাঝারি ব্যবসা চৌপাট হয়ে গিয়েছে। আর তার ফলে কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে গিয়েছেন বহু মানুষ। গত বছর ১৮ অগস্ট সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমআইই) যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, শুধুমাত্র জুলাই মাসে আংশিক লকডাউনের মধ্যে কর্মহীন হয়েছেন দেশের ৫০ লক্ষ বেতনভূক চাকরিজীবী। এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাঙ্ক বলছে ২০২০-২১ আর্থিক বছরে ভারতের অর্থনীতির সঙ্কোচন ঘটবে ৯ শতাংশ। ৮ সেপ্টেম্বর ফিচ রেটিংয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয় যে ২০২০-২১ আর্থিক বছরে ভারতের জিডিপি হ্রাস পাবে ১০.৫ শতাংশ, যা কিনা আগে মনে করা হয়েছিল ৫ শতাংশ। এক অভিজ্ঞ অর্থনীতি বিশ্লেষক সম্প্রতি বলেছেন, হ্রাস পাওয়া জিডিপি-র ক্ষতিকে পূরণ করতে ভারতকে ৯০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার পুনরুদ্ধার করতে হবে, ১০ বছরে গ্রোথ বৃদ্ধি হতে হবে ১৫ শতাংশ। কেবলমাত্র তা হলেই আমেরিকার ৫ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতিকে ছুঁতে পারা যাবে!
এই অবস্থায় তাই নির্মলা সীতারামনের ‘অভূতপূর্ব’ বাজেটের কাছে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে যে এটি হবে নিরপেক্ষ। এবং এটি দেশের সমস্ত জাত, ধর্ম, ভাষা, বিশ্বাস, ধনী-নির্ধন মানুষের কাছে সমান ভাবে গৃহীত হবে। এমন বাজেট, যা কেবলমাত্র ভোট-ব্যাঙ্কের দিকে তাকিয়ে তৈরি হয়নি। এমন বাজেট যা প্রতিবেদনের গোড়ায় উল্লিখিত ইএসজি ফ্যাক্টর পূরণ করতে পারবে। এমন বাজেট যা সমস্যাকে এড়িয়ে যাবে না কিংবা কারও উপর জবরদস্তি কিছু চাপাবে না। আবার, বিনিয়োগ, পুনরুদ্ধার এবং বৃদ্ধি আগামী দিনে অধরা থেকে যাবে নাকি নয়া পথ খুঁজে পাবে, সেই দিশাও দিতে পারবে।
(প্রতিবেদক জনসংযোগ বিশেষজ্ঞ এবং প্রাবন্ধিক)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy