Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
Nirmala Sitharaman

প্রকৃতিকে অবজ্ঞার ফল করোনা, অর্থনীতিকে নতুন করে ভাবতে হবে

অতিমারির চাপে বিশ্ব জুড়ে নাভিশ্বাস। আর এই নাভিশ্বাসের কারণেই ২০২০ আমাদের ইতিহাসে কালো বছর নামেই পরিচিত হয়ে থাকবে।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

বাসুদেব গুহ খাসনবিশ
বাসুদেব গুহ খাসনবিশ
শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০২১ ১৭:০৫
Share: Save:

অতিমারির চাপে বিশ্ব জুড়ে নাভিশ্বাস। আর এই নাভিশ্বাসের কারণেই ২০২০ আমাদের ইতিহাসে কালো বছর নামেই পরিচিত হয়ে থাকবে। অথচ বেশ কয়েক বছর ধরেই বিজ্ঞানীরা কিন্তু এই অতিমারির সম্ভাবনা নিয়ে ক্রমাগতই আমাদের সাবধান করে আসছিলেন। কারণ, জ়ুনোটিক প্যাথোজেন-এর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। জ়ুনোটিক প্যাথোজেন হল সেই জীবাণু যা পশুর দেহ থেকে মানুষের দেহে সংক্রমিত হচ্ছে। যেমন করোনা ভাইরাস। আর এর মূলে রয়েছে মানুষের হাতে ক্রমাগত প্রকৃতির ধ্বংস হয়ে যাওয়া। এখন তো অনেকেই বলছেন যে মানুষের সব থেকে বড় শত্রু মানুষই। অ্যানথ্রপসিন বা মানবকেন্দ্রিক যুগ এক এমনই সময়, যখন মানুষের চাহিদাই নির্ধারণ করছে পৃথিবীর পরিবেশকে। আর তাই অভিযোগের আঙুলও উঠেছে মানুষ অর্থাৎ আমাদের দিকেই। বলা হচ্ছে, আমাদের ধ্বংসের রাস্তা আমরাই তৈরি করছি।

ইউএনডিপি (রাষ্ট্রপুঞ্জের উন্নয়ন কর্মসূচি)-র হিউম্যান ডেভলপমেন্ট বা মানবোন্নয়ন রিপোর্ট প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯০ সালে। মেহবুব উল হক এবং অমর্ত্য সেন-এর যৌথ প্রয়াসে প্রকাশিত এই কাজটির মূল প্রতিপাদ্য ছিল, যে কোনও রাষ্ট্রের মূল সম্পদই হল তার নাগরিক। তাই, আর্থ-সামাজিক পরিবেশ এমন হওয়া উচিত যা প্রতিটি নাগরিককে নিজের জন্য দীর্ঘ, সুস্থ ও সৃজনশীল জীবন গড়ে তোলার অধিকার দেবে। কিন্তু আমাদের শুধু আর্থিক চাহিদার চাপে হারিয়ে যাচ্ছে উন্নয়নের অন্যতম এই লক্ষ্যটিই। এই ভাবনার জায়গা থেকেই তৈরি হয়েছিল হিউম্যান ডেভলপমেন্ট ইন্ডেক্স বা মানবোন্নয়ন সূচক। উন্নয়নের নিরিখে আমরা যাতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের নাগরিকের তুলনামূলক অবস্থান যাচাই করতে পারি তা দেখতেই তৈরি হয়েছে এই সূচক।

অতিমারি যে ভাবে আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে তার প্রেক্ষিতেই ইউএনডিপি এ বার এই সূচককে বিস্তৃত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তৈরি করা হয়েছে নতুন সূচক পি-এইচডিআই। এই নতুন সূচকে যোগ হয়েছে আর্থ-সামাজিক জীবনের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। প্রথাগত সূচকে উন্নয়ন মাপতে মাথা পিছু আয়, শিক্ষা আর স্বাস্থ্যকেই মাপকাঠি করা হয়। কিন্তু নতুন সূচকে এবার মাথাপিছু দূষণ ছড়ানোর হিসাবকেও ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।

তার ফল? বহু দেশ, যারা প্রথাগত হিসাবে সিঁড়ির উপরের ধাপে ছিল, নতুন সূচকে এক ধাক্কায় তারা বহু নীচে চলে গিয়েছে। এমনকি সেই সব দেশ যাদের পুরনো উন্নয়নের সূচকে একদম প্রথম সারির সদস্য হিসাবে গণ্য করা হত, তারা তাদের কৌলিন্য হারিয়ে বসেছে। ভারতে মাথা পিছু কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছড়ানোর পরিমাণ যখন বছরে ২ টন, তখন অস্ট্রেলিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই অঙ্ক ১৬ টনের উপরে। কিন্তু একটা দেশে কম হলে এই সমস্যার সমাধান হবে না। এই দায় কিন্তু বিশ্বের প্রতিটি দেশকে এক যোগে মেটাতে হবে। এই নতুন সূচক আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে কেন মানবাধিকারের প্রসার ও পরিবেশ দূষণ রোধ উন্নয়নের জন্য জরুরি।

কিন্তু তা কী ভাবে হবে? এই নতুন রিপোর্ট তাই জোর দিয়েছে আমাদের প্রত্যেকের- নাগরিকের, সরকারের, আর্থিক বাজার, রাজনৈতিক নেতৃত্বের এবং নাগরিক সমাজের নেতৃত্বের বহুধা বিস্তৃত দায়ের উপর। তিনটি ক্ষেত্রে জরুরি ভিত্তিতে নীতি বদল করে হস্তক্ষেপ করা জরুরি। আর্থিক ক্ষেত্রে নতুন নীতিতে যাকে বলা হচ্ছে গ্রহের উপর চাপ (প্ল্যানেটরি প্রেসার) তা কমাতে হবে; পণ্য ও পরিষেবার দামে পরিবেশ ও সমাজের ক্ষতিকে খরচ হিসাবে ধরতে হবে এবং এই কাজে বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রকে হাত মেলাতে হবে।

আর্থিক বাজার আর্থিক সম্পদ বণ্টন করে। নাগরিকের সঞ্চয় ও সংস্থার সম্পদ বিনিয়োগের স্রোতে টেনে আনে। তাই আর্থিক বাজারের নীতি এমন ভাবে বদলাতে হবে যাতে বিনিয়োগের স্রোত এমন খাতে না বয় যাতে পৃথিবীর উপর চাপ, যাকে গ্রহ-চাপ বলা হচ্ছে তা বাড়ে। এটা করতে গেলে শুধু পরিবেশ বান্ধব বিনিয়োগকে উৎসাহ দেওয়াই যথেষ্ট নয়। যে বিনিয়োগ গ্রহ-চাপ বাড়ায়, পরিবেশের ক্ষতি করে তাকে আটকাতে হবে তা সে দণ্ডমূলক ব্যবস্থা করেই হোক বা অন্য ভাবে। এ ব্যাপারে সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলির ও কেন্দ্রীয় মুদ্রা নিয়ন্ত্রক সংস্থার (শীর্ষ ব্যাঙ্কের মতো) কিন্তু বিশেষ ভূমিকা আছে। তবে এটাও ঠিক যে পরিবর্তন হচ্ছে। যেমন কোভিডের সময় পেট্রোলিয়াম নিষ্কাশন ও পরিশোধন সংস্থাগুলির শেয়ার কিন্তু ইউরোপীয় শেয়ার বাজারে যে ভাবে পড়েছিল তার হার গড়পরতা হিসাবের থেকে অনেক বেশি। প্রাথমিক ভাবে এটা ভাবার যথেষ্ট কারণ আছে যে সব সংস্থার ব্যবসায় কার্বন দূষণ বেশি হয় তাদের মধ্যে আর্থিক সংস্থাগুলো আগামী দিনে বড় কোনও সম্ভাবনা আর দেখছে না।

একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, আজকের বাজারে এখনও পণ্য বা পরিষেবার দামে কিন্তু গ্রহ-চাপকে খরচ হিসাবে দেখা হয় না। মাথায় রাখতে হবে, পণ্য এবং পরিষেবার দামই কিন্তু আমাদের আর্থিক সিদ্ধান্তের মূল নির্ধারক। দামই তো চাহিদার প্রাথমিক নির্ধারক। পেট্রোলিয়ামের মতো খনিজ জ্বালানি উল্টে নানান ভর্তুকি পেয়ে থাকে, পরিবেশ দূষণের অন্যতম অপরাধী হওয়া সত্ত্বেও। ২০১৯ সালে বিশ্ব জুড়ে পেট্রোলিয়ামের উপর বিভিন্ন রাজকোষ থেকে দেওয়া ভর্তুকির অঙ্ক ছিল ৩১ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। ডলার পিছু ৭৩ টাকা দাম ধরলে এই অঙ্কটা দাঁড়ায় ২৩ লক্ষ ১৪ হাজার ১০০ কোটি টাকায়!

এই ভর্তুকির কারণেই কিন্তু পরিবেশ বান্ধব জ্বালানির রাস্তায় হাঁটতে চাইছি না আমরা। আমাদের উপর এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ খরচ যেটা চাপছে তার অঙ্ক কিন্তু বিশাল- ৫.২ লক্ষ কোটি ডলার ছিল ২০১৭ সালের হিসাব। যা ছিল বিশ্বের গড় জাতীয় উৎপাদনের ৬.৫ শতাংশ! খনিজ বা জীবাশ্ম জ্বালানির উপর ভর্তুকি তুলে দিলেই ২০১৫ সালের হিসাবে কার্বন দূষণ কমত ২৮ শতাংশ আর প্রাণ বাঁচত ৪৬ শতাংশ মানুষের। আর এই ভর্তুকির লাভ তুলছে উন্নয়নশীল দেশগুলির সব উচ্চবিত্ত পরিবার। অর্থাত্ এই ভর্তুকি শুধু গ্রহ-চাপই বাড়াচ্ছে না, বাড়াচ্ছে বৈষম্যও।

গ্রহ বাঁচাতে একক কোনও রাষ্ট্রের নীতি-হস্তক্ষেপ অবস্থার পরিবর্তন করতে পারবে না। এর জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত পদক্ষেপ। এই ধরণের সম্মিলিত পদক্ষেপ কী করতে পারে তা কিন্তু আমরা জানি। ১৯৮০ সালে গুটিবসন্ত থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছিলাম এই সম্মিলিত পদক্ষেপের কারণেই।অথবা ভাবুন ওজ়োন স্তর বাঁচাতে মন্ট্রিয়েল প্রোটোকলের কথাই। প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী উষ্ণায়ন কমাতে পদক্ষেপ সফল হলেও ২০৫০ সালের মধ্যে যদি আমরা গ্রিন হাউজ় গ্যাস বিকিরণকে শূন্যে না নামাতে পারি তা হলে কিন্তু বিপদ এড়ানো মুশকিল হতে পারে। যেটা মাথায় রাখা প্রয়োজন সেটা হল আমাদের পৃথিবীকে বাঁচাতে সঠিক আর্থিক উৎসাহের ভূমিকা।

ভারতে ২০০৮ সালে ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান অন ক্লাইমেট চেঞ্জ বা এনএসিসি চালু হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই যে জরুরি তার প্রথম সরকারি স্বীকৃতির প্রমাণ ছিল এটাই। যদিও আন্তর্জাতিক স্তরে জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানোর নানান প্রস্তাবে আন্তর্জাতিক স্তরে নানান মতবিরোধ থেকেই গিয়েছে। কিন্তু ভারতে দূষণহীন শক্তি ব্যবহারের প্রবণতা উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়ছে। ভারতে ইউএনডিপি-র অ্যাকসিলারেটর ল্যাব প্রকল্পেও জৈব বর্জ্য থেকে জ্বালানি তৈরির নানান প্রযুক্তির উদ্ভাবন হচ্ছে।

আসলে আর্থিক বৃদ্ধির ফল সমাজের আর্থিক ভাবে সব থেকে নীচের স্তরের মানুষের কাছে পৌঁছতেই হবে। না হলে পরিবেশ রক্ষাকারী উৎপাদন ও ভোগ সম্ভব নয়। অন্যথায় বৈষম্য বাড়বে। গ্রামীণ ভারতে প্রকৃতি নির্ভর উৎপাদন প্রক্রিয়ায় উৎসাহ দেওয়াও কিন্তু এ ক্ষেত্রে একটা নীতি হস্তক্ষেপ হতে পারে যাতে বৈষম্য কমতে পারে।

(লেখক ইউএনডিপি-র ভারতে নিযুক্ত অর্থনীতিবিদ)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE