রিয়া গাঙ্গুলি গুহ, দ্য ওয়াও ফ্যাক্টর
নব্বইয়ের দশক। বয়সে নিতান্তই ছেলেমানুষ। পোশাক আশাকে আশেপাশের অন্য বাচ্চাদের থেকে একদম আলাদা। কারণ ছোটবেলা থেকে তাঁর ঝোঁকটা ওয়েস্টার্ন স্টাইলেন পোশাকের ওপর। তাই স্বাদটাও অন্যদের থেকে একদম আলাদা। সেই সময়ের বাচ্চা মেয়েদের সুন্দর কুচিওয়ালা, চুমকি দেওয়া ড্রেস তার মন ভোলাতে পারত না কখনই। ছোট্টবেলার সেই সময় থেকেই অত্যাধুনিক, ট্রেন্ডি ফ্যাশনের ওপর মন মজে রিয়ার। বাবা-মাও সেই পছন্দে সায় দিতেন খুব। সেই সময়, কলকাতার সব জায়গায় মেয়েদের ওয়েস্টার্ন ফ্যাশনের তেমন দোকান ছিল না। তাই অগত্যা বাচ্চা ছেলেদের প্যান্ট, টি শার্টই কেনা হত। প্রাইমারি স্কুলের বাকি বাচ্চারা যখন পায়ে কেডস পড়ত, তখন থেকেই রিয়ার পায়ে হোয়াইট স্নিকার। সেই ধরনের স্নিকারের চল তখন প্রায় ছিলই না। বাড়ির জামাকাপড়ের ক্ষেত্রেও রিয়ার পছন্দ অনুযায়ী কেনা হত ছেলেদের হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি।
একটু বড় হতেই মনে যখন বসন্তের ছোঁয়া লাগে তখন আর এইসব ছেলেদের পোশাকগুলো ভাললাগত না রিয়ার! কিন্তু মেয়েদের সেই সময়ের চলতি জামা কাপড়গুলোও একদম পছন্দের ছিল না। চোখ খুঁজে বেড়াত ফ্যাশনেবল ওয়েস্টার্ন ড্রেস।
সেই সময় গার্লস জিন্স টপের খোঁজে বাবার সঙ্গে রিয়া যেতেন পার্ক স্ট্রিট, এসপ্লানেডের কিছু দোকানে। যাদের ফ্যাশন দেখে এক কথায় মন ভরে যেত রিয়ার। ব্যাগ ভরে হত পয়লা বৈশাখ আর পুজোর শপিং। টম বয় লুক থেকে সেই প্রথম ফ্যাশনেবল ট্রেন্ডি গার্ল লুকে আসা। তার পর থেকেই সব সময়ে হালফিলের ফ্যাশনের বাইরে গিয়ে নিজেকে অন্যরকম একটা লুক দেওয়ার ইচ্ছা মাথায় চড়ে বসে রিয়ার। শুরু হয় বিভিন্ন রকমের ফেব্রিক যোগাড় করে, গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে, টেলরকে দিয়ে মনের মতো পোশাক বানানো। পোশাক তৈরির এক সুপ্ত বীজ বোধ হয় বপন হয়েছিল সেই সময়েই।
এর পর পড়াশুনা শেষ করে ছোটবেলার প্রেমিকের হাত ধরে রিয়া পাড়ি দেন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। মুম্বই শহরে দু’জনের নতুন চাকরি জীবনে পকেটে টানাটানি ভীষন। কিন্তু ফ্যাশন স্ট্রিট সারাক্ষণ হাতছানি দিত রিয়ার মনের মধ্যে। কিনতে না পারলেও মুম্বইয়ের বড় বড় মলগুলিতে গিয়ে উইন্ডো শপিংয়েই যেন মন ভরে যেত। মনের কোথাও একটা বিশ্বাস ছিল নচিকেতার সেই বিখ্যাত গানের লাইন, ‘আসবে আমাদেরও দিন’এর পর স্বামীর চাকরী সূত্রে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বদলি আর প্রতিবার নতুন জায়গায় বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর চ্যালেঞ্জ। এ ভাবেই জীবন চলছিল রিয়ার।
বিভিন্ন সময়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক,সংসারিক, মানসিক ওঠানামার মধ্যে নিজেকে খাপ খাওয়াতে খাওয়াতে রিয়ার কখনও মনে হয়নি যে নিজের অস্তিত্ব ভুলে সে শুধু স্বামীর পরিচিতিতেই জীবন কাটিয়ে দেবে। তাই প্রতিটা শহরে গিয়ে কিছু না কিছু কাজের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করাটা রিয়ার স্বভাব হয়ে দাঁড়ায়।
ইন্টারনেট যখন থেকে মাথাচাড়া দিয়ে সবার জীবনে এক অন্য দিশা এনে দিচ্ছে, তখন থেকে রিয়ার শুরু হয় নিজের অফিসের পাশাপাশি অনলাইন সেলিং বিজনেস। গুরুগ্রামে রিয়া তখন একটি সংস্থার হিউম্যান রিসোর্স হেড। কিন্তু রিয়ার মন বলছিল নিজের মতো করে এমন কিছু করতে যাতে সংসার সামলে, ছোট্ট মেয়েকে যথাযথ সময় দিয়ে নিজের সৃষ্টিশীলতা আর দক্ষতার পরিচয় দিতে পারা যায়। ইচ্ছায় বাদ সাধছিল ভিনরাজ্যে থাকার অনিশ্চয়তা! কারণ বহুজাতিক সংস্থায় উচ্চপদে থাকার দরুন যে কোনও রাজ্যেই স্বামীর স্থায়িত্বের কোনও নির্দিষ্ট সময় মাপা ছিল না। তাই সেই ইচ্ছা পূরণ করতেই সেই সময়ের নিশ্চিত চাকরি ছেড়ে আবার অনিশ্চিত কেরিয়ারের খোঁজে নিজের রাজ্যে, নিজের শহরে মেয়েকে নিয়ে ফিরে আসেন রিয়া। সেখান থেকে জীবন যেন এক নতুন মোড় নেয়।
রিয়া বুঝতে পারেন যে, এত দিনে নিজের শহরের চারিদিকে ফ্যাশন যেন আজ তার মনের মতো তাল মেলাচ্ছে। নব্বইয়ের দশকে খুঁজে খুঁজে বের করা ওয়েস্টার্ন ফ্যাশন এখন কত সহজলভ্য আর আশেপাশের মানুষেরও স্বাদ পাল্টেছে। মাথায় চেপে বসল নিজের ব্যবসা শুরু করার ইচ্ছা। অন্যদের কাছ থেকে নিজের সাজপোশাকের বা পছন্দের সবসময় এত প্রসংশা পেতেন যে একবারের জন্য রিয়াকে আর ভাবতে হয়নি কী হবে তার নতুন রুটিরুজি।
নিজের শহরে নিজের ভাষায় অনেক বেশি স্বচ্ছন্দে শুরু হয়ে গেল নিজের ব্র্যান্ড। ব্যবসা শুরুর প্রথম দিকটাও তেমন সহজ ছিল না। বিভিন্ন প্রতিকূলতা আর ওঠাপড়ার মধ্যেই জন্ম হল ‘দ্য ওয়াও ফ্যাক্টর’এর। সব কিছু হয়তো আজও অতটা সহজ নয়, যতটা আত্মবিশ্বাসী দেখায় নিজের ব্র্যান্ডকে যখন রিয়া নিজেই প্রতিনিধিত্ব করেন ফেসবুক লাইভে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে। কিন্তু মনে সেই বিশ্বাস নিয়ে আজও এগিয়ে যাওয়া : ‘আসবে আমাদেরও দিন’, ছুটে বেড়ানো আরও - আরও ভাল কিছু করার আশায়।
নিজের এই ব্র্যান্ড রিয়াকে শুধু আর্থিক জোরই এনে দেয়নি, দিয়েছে সামাজিক পরিচয় ও সন্মান। নিজে স্বনির্ভর হওয়ার পাশাপাশি রিয়া সাবলম্বী করতে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন এক এন.জি.ও-র মহিলাদের দিকে। তাঁর স্বপ্নের নকশাকে বাস্তবের রূপ দেন তাঁরা। দেশ বিদেশের বিভিন্ন কালেকশনের পাশাপাশি আজ ‘দ্য ওয়াও ফ্যাক্টর’এর ঝুলিতে আছে নিজেদের ডিজাইন করা কিছু নতুন জিনিস যা মুগ্ধ করেছে বহু ক্রেতার মন। সমসাময়িক লেডিজ ফ্যাশনের সঙ্গে সঙ্গে আগামী দিনের গার্লস ফ্যাশন নিয়েও নিত্য আলোচনা চলে নিজের মেয়ের সঙ্গে। নিজেকে ট্রেন্ড সম্বন্ধে আপডেটেড রাখার এটা এক অন্যতম উপায় তাঁর। কুরুশের কাজের নিত্য অনুধাবনে আজ নিজেকেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে গণ্য করেন রিয়া। হয়ত সেই কারণেই ফেসবুক সেলিং প্ল্যাটফর্মে তাঁর পরিচিতি 'ক্রশেট কুইন' হিসাবে।
বিজনেস প্ল্যাটফর্ম অনলাইন হওয়ার দরুণ সারা দেশে পৌঁছে যাচ্ছে ‘দ্য ওয়াও ফ্যাক্টর’ এর ওয়েস্টার্ন পোশাক। এমনকি এই ব্র্যান্ড দেশের বাইরের ক্রেতাদেরও মন জয় করেছে বহুবার। রিয়ার ‘দ্য ওয়াও ফ্যাক্টর’ এর এক্সক্লুসিভ কালেকশনে পাওয়া যায় কুরুশের কাজের বিভিন্ন ওয়েস্টার্ন জামাকাপড়। এ ছাড়া নানান রকমের দেশি ফেব্রিক দিয়ে ডিজাইন করা বিদেশি স্টাইলের ড্রেসে দেখা যায় নানা নতুনত্বের ছোঁয়া। রিয়ার এই কালেকশন মূলত পাওয়া যায় বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্মে এবং নিজের বাড়িতেই খোলা এক অফলাইন আউটলেটে। তার এই লড়াই বহু নারীর কাছে অনুপ্রেরণা। তাঁদের পথ দেখিয়েই তিনি আজ ‘সর্বজয়া’।
এই প্রতিবেদনটি 'উই মেক আস' -এর সঙ্গে আনন্দবাজার ব্র্যান্ড স্টুডিয়ো দ্বারা যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy