আরজি কর-কাণ্ডে লিখলেন অঞ্জন দত্ত। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
আমার মনখারাপ। কিছুই ভাল লাগছে না। আজকে আমি যে কথা বলব, সেটা এই শহরের এক জন নাগরিক হিসেবে। আজ আমি কোনও শিল্পী বা কোনও খ্যাতনামী হিসেবে কথা বলতে চাই না। আমি কলকাতা শহরটাকে ভালবাসি এবং আজ আমি লজ্জিত!
কলকাতার নাগরিক হিসেবে আজ আমার নিজেকে বিপদগ্রস্ত মনে হচ্ছে। তার থেকেও বড় কথা, যা দেখছি বা আশপাশ থেকে যা শুনছি— সেখানে এই রকম জঘন্য একটা অপরাধকে কী ভাবে আড়াল করার চেষ্টা করা হচ্ছে, তা দেখে আমার মনে আরও ক্ষোভ জমা হচ্ছে। অপরাধ হল, মানছি। কিন্তু সেটাকে ক্ষমতা দিয়ে চেপে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, এটা তো কোনও ভাবেই কাম্য নয়। প্রথমে বলা হল অসুস্থতা, তার পর আত্মহত্যা। আরও পরে ধর্ষণ! কী হচ্ছেটা কী!
আমি বিরক্ত। এত দিন এই শহরটাকে ভালবেসে থেকে গিয়েছি। কিন্তু আমার এই শহরটাকে আর ভাল লাগছে না। আজ আমার ভয় করছে! আমার পরিবারের জন্য ভয় করছে। আমি একজন স্বামী হিসেবে চিন্তিত, একজন বাবা হিসেবে চিন্তিত, একজন শ্বশুর হিসেবে চিন্তিত। সমস্ত বিষয়ের মধ্যে এখন রাজনীতি ঢুকে যাচ্ছে! অপরাধকে আড়াল করতে চাইতে ক্ষমতা। এই রকম দুর্নীতি আমি কিছুতেই কল্পনা করতে পারছি না। হতে দেওয়া যাবে না। এই অব্যবস্থা চলতে পারে না। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে রাজ্যবাসীর।
আমি অনেকের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারছি, চিকিৎসা জগতের মধ্যেই নাকি দুর্নীতি রয়েছে। তার থেকে আর জি করের ঘটনায় অনেকেই ‘ষড়যন্ত্র’ তত্ত্ব খুঁজছেন। হতেই পারে। আমারও মনে প্রশ্ন, আমিও সত্য জানতে চাই। অন্যায়ের বিচার না করে সেটাকে চেপে যাচ্ছে কী করে? আমার শহরে কি তা হলে একটা হত্যা হয়ে যেতে পারে আত্মহত্যা? তার পর দেখলাম, অকুস্থলের পাশের ঘরে সংস্কারের কাজ চলছে! কেন? জবাব দিতে হবে প্রসাশনকে। শুধু চিকিৎসাক্ষেত্র নয়, কেন সমাজের প্রতিটি স্তরে মানুষ স্বাধীন, সুরক্ষিত ভাবে চলাফেরা করতে পারবে না? এর জবাবও প্রশাসনকেই দিতে হবে। আমার ভয় করছে, আমি শঙ্কিত। খোদ কলকাতা শহরে এ রকম একটা অপরাধ হলে, পশ্চিমবঙ্গের শহরতলি এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে না জানি প্রতি দিন কত অপরাধ আমাদের দৃষ্টির আড়ালে রয়ে যায়।
হাই কোর্টের নির্দেশে আরজি করের তদন্ত ভার সিবিআইকে দেওয়া হয়েছে। আমি এখানে আশাবাদী। কারণ আমি বাকি সকলের মতোই এই অপরাধের দ্রুত বিচার চাই। মঙ্গলবার, অপর্ণা সেন আরজি করে গিয়েছেন। আমি যেতে পারিনি, আমি লজ্জিত। কিন্তু এটাও ঠিক আমি তো সেখানে গিয়ে কিছু করতেও পারব না।
এখন কোনও কিছু হলেই দেখি গান লেখা বা ছবি করার কথা বলেন! কিন্তু এক জন শিল্পী হিসেবে আরজি করের ঘটনা আমার কাছে কোনও গান লেখার অনুপ্রেরণা হতে পারে না! আমি এই নিয়ে কোনও ছবিও তৈরি করতে চাই না! আমি এক জন নাগরিক হিসেবে এর বিচার চাই।
সমাজমাধ্যম থেকে জেনেছি, বুধবার রাতে শহরের বিভিন্ন জায়গায় মহিলারা জমায়েত করছেন। আমি আপনাদের সাধুবাদ জানাই। আমি পুরুষদেরও আহ্বান করছি আপনাদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে প্রতিবাদে শামিল হতে। আরও একটা জিনিস আমার খুব ভাল লেগেছে। কোনও রাজনৈতিক দল বা রংকে আপনারা জমায়েতে প্রবেশ করতে দেবেন না বলে জানিয়েছেন। খুব ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। এই পদক্ষেপের জন্যও ধন্যবাদ আপনাদের। প্রমাণ হয়ে গেল, এখনও আমার শহর তা হলে রাজনীতির বাইরে বেরিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদে শামিল হতে পারে। আমি গর্বিত। আরও একটা অনুরোধ, যেন কেউ মারামারি বা ধাক্কাধাক্কি না করেন। বাঙালির প্রতিবাদ নাকি এখন ফেসবুকে! ভাল লাগছে দেখে, আজ মহিলাদের আহ্বানে প্রতিবাদের যে স্বর চড়া হতে শুরু করেছে, এই বাঙালিকে নিয়ে আমি গর্বিত।
আমার এখন ৭০ বছর বয়স। আমি সধারণত কোনও মিছিলে হাঁটি না। আমি সুশীল সমাজ বুঝি না। কিন্তু আজ আমি কোনও তারকা নই। একজন নাগরিক হিসেবেই আপনাদের মধ্যে হাজির হতে ইচ্ছে করছে। হয়তো আজ রাতেই আপনাদের সঙ্গে দেখা হবে। যদি আজ আমি যাই, তা হলে কোনও তারকা নয়, একজন বাবা, এক জন স্বামী একজন শ্বশুর হিসেবেই আজ আপনাদের প্রতিবাদে শামিল হব।
আমার কলকাতা সাহসী। আমার কলকাতা চুপ থাকতে পারে না। আগামী কাল স্বাধীনতা দিবস। তার আগেই এ রকম প্রতিবাদ সত্যিই শহর কলকাতা তথা এ রাজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হয়ে রয়ে যাবে।
(সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত)