আরজি কর-কাণ্ডে সিবিআই-এর ভূমিকায় কতটা আশাবাদী টলিপাড়া? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
আরজি কর-কাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের স্বর রাজ্যের সীমানা পেরিয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। সমাজের বিভিন্ন মহলে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ক্ষোভ। মঙ্গলবার এক দিকে যেমন স্বাস্থ্য দফতর আন্দোলনরত চিকিৎসকদের কর্মরিবতি প্রত্যাহার করার অনুরোধ জানিয়েছে, অন্য দিকে কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম আরজি কর-কাণ্ডে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে মতামত জানালেন টলিউডের বিশিষ্টেরা।
আরজি কর-কাণ্ডে সিবিআই-এর ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেন চন্দন সেন। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বললেন, ‘‘অতীতে এ রাজ্যে সিবিআই-এর ভূমিকা আমরা দেখেছি। লোকসভা ভোটের আগে কী ভাবে কেন্দ্রীয় সংস্থাকে ব্যবহার করা হয়েছিল, সেটাও আমরা জানি। কেন্দ্রীয় সরকারে যত দিন বিজেপি ক্ষমতায় থাকবে, তত দিন কী হবে তা বলা মুশকিল।’’ চন্দনের মতে, চিকিৎসকদের তরফে এবং সমাজমাধ্যমে ওঠা যুক্তিসম্মত প্রশ্নে ঘটনা অন্য স্তরে পৌঁছে গিয়েছে।
আরজি করের ঘটনাকে ‘মর্মান্তিক’ বলে উল্লেখ করলেন চন্দন। তাঁর মতে, নেপথ্যে কোনও গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে। চন্দন বললেন, ‘‘অনেকগুলো প্রশ্ন উঠছে, যার কোনও জবাব নেই। কেন দেরি করে পরিবারকে দেহ হস্তান্তর করা হল? কেন প্রাথমিক ভাবে পরিবারকে জানানো হল যে, মেয়েটি আত্মহত্যা করেছেন? ধৃত অভিযুক্ত ছাড়া আর কেউ এই ঘটনায় জড়িয়ে রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা উচিত।’’
আরজি করের ঘটনা জাতীয় মানচিত্রে রাজ্যের মাথা হেঁট করে দিয়েছে, বলেই মনে করেন অভিনেতা রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘অতিমারির সময় আমরা প্রত্যেকে উপলব্ধি করেছি যে, মানুষের জীবন বাঁচিয়ে স্টার হন চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা। তাঁদের কর্মক্ষেত্রে এ রকম একটা পাশবিক ঘটনা ঘটে গেল আর কেউ টের পেল না! এটা প্রশাসনিক ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছুই নয়।’’
তবে এই ঘটনায় সিবিআইয়ের হস্তক্ষেপকে ইতিবাচক দিক থেকেই দেখতে চাইছেন রাহুল। বললেন, ‘‘অতীত মাথায় রেখেও বলছি, সিবিআই স্বতন্ত্র সংস্থা। বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি নিয়ে চিকিৎসকেরাও লড়ছেন। ফলে এটা সে দিকেও আরও একটা পদক্ষেপ।’’ সোমবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, রবিবারের মধ্যে পুলিশি তদন্তে অগ্রগতি না হলে তিনি তদন্তভার সিবিআই-এর হাতে তুলে দেবেন। আরজি করের ঘটনার দ্রুত তদন্ত করা উচিত বলে মনে করছেন রাহুল। তাঁর কথায়, ‘‘এই ধরনের ঘটনায় সাত দিন অপেক্ষা করার অর্থ, প্রমাণগুলো দুর্বল হয়ে যেতে পারে। সে দিক থেকে দ্রুত সিবিআইয়ের হস্তক্ষেপকে সাধুবাদ জানাচ্ছি।’’
পরিচালক ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরীর মতে, আরজি কর-কাণ্ডে পুলিশের প্রাথমিক পদক্ষেপ এবং ব্যর্থতা সাধারণ মানুষ ও কর্মরত চিকিৎসকদের মধ্যে ক্ষোভ আরও বৃদ্ধি করেছে। ইন্দ্রনীল বললেন, ‘‘সিবিআই-এর কাছে তদন্তভার গিয়েছে, ভাল কথা। কিন্তু তারাও কি খুব বিশ্বাসযোগ্য? গত তিন-চার বছরের পরিসংখ্যান দেখলে এই প্রশ্নই উঠতে পারে।’’ শহর কলকাতার বুকে এ রকম ঘটনা ঘটলে, রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলে চিকিৎসকদের সঙ্গে কী ঘটতে পারে, তা ভেবে শঙ্কিত ইন্দ্রনীল।
আরজি-করের মতো ঘটনায় প্রাথমিক পর্যায়ে সাধারণ মানুষের মনে যে আস্থা তৈরি করা উচিত ছিল, প্রসাশন তা করতে পারেনি বলেই মনে করছেন ‘ছোটলোক’ ওয়েব সিরিজ় খ্যাত পরিচালক। ইন্দ্রনীল বললেন, ‘‘প্রশাসন মানে কিন্তু শুধুই পুলিশ, নেতা বা মুখ্যমন্ত্রী নয়। আরজি করের শীর্ষে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরাও তো প্রশাসনের অংশ। সেখানে তাঁরা যদি বলেন, রাতে ওখানে ঘুমোনোর কী প্রয়োজন! তা অত্যন্ত দুঃখজনক।’’
সিবিআই-এর হাতে তদন্তভার যাওয়ার পর আরজি করের মৃতা চিকিৎসক বিচার পাবেন কি না, সে প্রসঙ্গে এখনই কোনও মন্তব্য করতে চাইছেন না ইন্দ্রনীল। তবে তাঁর কথায়, ‘‘এই ধরনের ঘটনায় যাঁর সঙ্গে অন্যায় হয়েছে, যাঁর পরিবার ভুক্তভোগী, তাঁদের সবার আগে সুবিচার প্রসঙ্গে আশ্বস্ত করাতে হবে। আমরা সেখানে গৌণ।’’
বৃহস্পতিবার ১৪ অগস্ট রাতে শহর-সহ বিভিন্ন জায়গায় সমাজের বিভিন্ন স্তরের মহিলারা জমায়েত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অভিনেত্রী দিতিপ্রিয়া রায় শুরু থেকেই এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত। আনন্দবাজার অনলাইনকে দিতিপ্রিয়া বললেন, ‘‘যারা এই ঘৃণ্য কাজ করেছে, তাদের তো অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আমরা চাইছি, যাতে অন্য কারও মুখ দিয়ে প্রকৃত সত্য আড়াল না করা হয়। যারা এই ঘৃণ্য কাজে মদত দিয়েছে, তাদেরও যেন কঠোর শাস্তি হয়।’’
দিতিপ্রিয়ার প্রশ্ন, অধিকাংশ সময়ে সমাজে মহিলাদের কেন তাঁদের পোশাক বা চালচলন নিয়ে সমালোচিত হতে হয়। অভিনেত্রীর কথায়, ‘‘দিনের পর দিন তো এটাই দেখছি। মহিলাদের পাশাপাশি একটি শিশুকেও তো ধর্ষণ করা হচ্ছে। এটা আমাদের প্রত্যেকের লড়াই এবং আজকে আমরা কেউ নিজেদের সুরক্ষিত মনে করছি না!’’ এরই সঙ্গে অভিনেত্রী যোগ করলেন, ‘‘ভেবে খারাপ লাগছে, যে রাজ্যে আমরা ঘটা করে দুর্গাপুজো করি, যেখানে মায়ের আরাধনা করি, আজকে সেখানেই মহিলাদের সঙ্গে এ রকম ঘটনা ঘটে গেল।’’
আরজি করের ঘটনায় সিবিআই তদন্তে নিয়েও এই মুহূর্তে বিশেষ একটা আশাবাদী হতে পারছেন না দিতিপ্রিয়া। তবে তাঁর দাবি, এই ঘটনায় সিবিআই তদন্ত যেন নিরপেক্ষ হয়। দিতিপ্রিয়া বললেন, ‘‘কোনও পক্ষকে সমর্থন না করে যেন নির্ভুল তদন্ত হয়। মানুষের সামনে যেন প্রকৃত সত্য প্রকাশ করা হয়।’’