প্যাংগং হ্রদ লাগোয়া এলাকায় সেনা সমাবেশ। -ফাইল ছবি।
আকসাই চিন নিয়ে ভারত ও চিনের টানাপড়েন নতুন কোনও ঘটনা নয়। যেমন নতুন নয় অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে চিনা দাবি। বস্তুত চিন ও ভারতের মধ্যে ৩ হাজার ৪৪৮ কিলোমিটার লম্বা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বার বারই খবরের শিরোনাম হয়েছে চিনা সেনা আচমকা নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে ভারতীয় এলাকায় ঢুকে পড়ায়। উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে দু’দেশের সম্পর্কে। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার দু’পারেই। ’৬২-র ভারত-চিন যুদ্ধের পর ২০১৭-য় ডোকলামই ছিল সবচেয়ে বড় উত্তেজনার ঘটনা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেই ডোকলামের পর এ বারই বৃহত্তম উত্তেজনার ঘটনা ঘটল দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে। নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে অনেক বেশি সংখ্যায় চিনা সেনা ঢুকে পড়েছে ভারতীয় এলাকায়। আর অনেক বেশি এলাকা দিয়ে তারা ঢুকেছে। চিনা সেনাদের মনোভাবও অনেক বেশি আক্রমণাত্মক। গালওয়ান উপত্যকার মতো তারা এমন সব এলাকায় ঢুকে পড়েছে, যে অঞ্চলগুলি নিয়ে দু’দেশের মধ্যে কোনও দিনই কোনও বিরোধ ছিল না। এমনকী, তাদের টহল দিতে দেখা গিয়েছে ভারতীয় সেনা চৌকি ‘কেএম১২০’-র আশপাশেও।
কেন এ বারের এই উত্তেজনা?
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, মূলত দু’টি কারণে এ বার উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে পূর্ব লাদাখে।
প্রথমত, ডোকলামের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী ভারতীয় এলাকা থেকে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় পৌঁছনোর সড়কপথ ও আনুষঙ্গিক পরিকাঠামো বানিয়ে ফেলেছে। যার ফলে পূর্ব লাদাখের কাছে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা ভারতীয় সেনাদের কাছে আর ততটা দুর্গম হয়ে থাকেনি। ভৌগোলিক কারণেই চিনা ভূখণ্ড থেকে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা পর্যন্ত সহজে পৌঁছনোর কাজটা চিনা সেনাদের পক্ষে করে ফেলাটা ততটা সম্ভব হয়নি। এটা বেজিংয়ের উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
দ্বিতীয়ত, এ বার চিন বেশি উদ্বিগ্ন গিলগিট-বাল্টিস্তান এলাকা নিয়ে। যা পড়ে চিন ও পাকিস্তানের মধ্যে নির্মীয়মান অর্থনৈতিক করিডরে। আর পড়ে লাদাখে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সরকার সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যকে ভেঙে জম্মু, কাশ্মীর ও লাদাখকে তিনটি কেন্দ্রশাসিত এলাকায় পরিণত করার পর থেকেই বেজিংয়ের উদ্বেগ আরও বেড়ে গিয়েছে। কারণ, এর ফলে, চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরে ভারতীয় লাদাখের ‘বাগড়া’টা বেজিংয়ের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
কিরঘিজস্তানে প্রাক্তন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত পি স্তোবদান বলেছেন, ‘‘চিন পাকিস্তানের সঙ্গে অর্থনৈতিক করিডর বানাচ্ছে ভারত মহাসাগরে নিজের সামরিক প্রভূত্ব সার্বিক ভাবে গড়ে তুলতে। তাই লাদাখকে নিজের হাতে রাখার দরকার বেজিংয়ের। সে জন্যই এ বার যে কোনও ভাবে লাদাখে ঢুকে পড়তে চাইছে চিন। লাদাখের উপর তার কর্তৃত্ব পুরোপুরি কায়েম করতে চাইছে।’’
আরও পড়ুন- গালওয়ানে সেনা তৎপরতা চিনের, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় যুদ্ধ পরিস্থিতি
আরও পড়ুন- লাদাখ সীমান্তে সেনা জড়ো করছে চিন, সঙ্ঘাতের পরিস্থিতি
২০১৭ ও ২০১৮-য় চিনে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বে থাকা গৌতম বাম্বাওয়ালে জানাচ্ছেন, ডোকলামের ঘটনা থেকে চিনও অনেক কিছু শিখেছে। ওরা জানত, সংবাদমাধ্যমে ঢাকঢোল না পিটিয়ে পূর্ব লাদাখে সেনা ঢোকালে ভারত চিনের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করবে। তাই এ বার সেনা ঢুকিয়েই বেজিং বলতে শুরু করে, এলাকায় গত ৫ মে থেকে যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে, তার কারণ, ভারতীয় সেনারাই। তারাই ঢুকে পড়েছিল চিনা এলাকায়। তাদের পিছু হঠাতেই পূর্ব লাদাখে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে প্রায় ২৫০ চিনা ও ভারতীয় সেনা। যা গড়ায় পরের দিন পর্যন্ত। দু’পক্ষের মধ্যে বৈঠকের পরে কিছুটা স্বস্তি ফেরে এলাকায়। কিন্তু তার তিন দিনের মাথায় গত ৯ মে উত্তর সিকিমে ফের সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে শতাধিক ভারতীয় ও চিনা সেনা। যদিও বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র অনুরাগ শ্রীবাস্তব সেই সময় চিনা অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছিলেন।
প্যাংগং হ্রদ এলাকায় ঢুকে পড়েছে চিনা সেনা। -ফাইল ছবি।
বাম্বাওয়ালের কথায়, ‘‘এ বার আগের চেয়ে অনেক সংযত থাকতে পেরেছি। বার বারই বলে এসেছি, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা মেটানো হোক। কিন্তু বেজিং সে ব্যাপারে কোনও আগ্রহ দেখায়নি। অথচ, এই সমস্যার সমাধানের একমাত্র রাস্তাই হল দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক আলোচনা।’’
তবে ম্যাসাটুসেট্স ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক টেলর ফ্রাভেলের বক্তব্য, ‘‘এ বার বেজিং কোনও হুমকি দেয়নি। কোনও কড়া কড়া কথা বলেনি। শুধু এটাই বুঝিয়ে দিয়েছে, ভারত যে ভাবে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা পর্যন্ত পৌঁছনোর কাজটা আগের চেয়ে অনেকটা সহজ করে ফেলেছে, চিন সেটা আদৌ মেনে নিতে পারেনি। তাই পাল্টা চাপ সৃষ্টি করতে নিয়ন্ত্রণরেখায় তাদেরও কর্তৃত্ব কায়েম করতে সচেষ্ট হয়েছে। আর সে জন্যই যে গালোয়ান উপত্যকা নিয়ে এত দিন কোনও বিরোধই ছিল না দু’দেশের মধ্যে, এ বার সেই গালোয়ানেই প্রচুর সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছে বেজিং। কারণ, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার কাছে এই গালোয়ান পর্যন্ত সড়কপথ বানিয়ে ফেলেছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। তৈরি করে ফেলেছে আনুষঙ্গিক পরিকাঠামোও।’’
এ বারের অনুপ্রবেশ কি আগের চেয়ে আলাদা?
২০১৪ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত চিনে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বে থাকা অশোক কে কণ্ঠ মনে করেন, এ বার চিনা সেনারা যে ভাবে ঢুকে পড়েছে পূর্ব লাদাখের বিভিন্ন এলাকায় আগে তেমনটা ঘটতে দেখা যায়নি।
কণ্ঠ জানাচ্ছেন, প্রথমত, এর আগে এত বেশি সংখ্যায় চিনা সেনা এত অল্প সময়ে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে ভারতীয় এলাকায় ঢুকে পড়েনি।
দ্বিতীয়ত, এ বার চিনা সেনারা অনেক বেশি সংখ্যক ভারতীয় এলাকায় ঢুকে পড়েছে, যা এর আগে কখনও হয়নি। তারা গালোয়ানের মতো একটি নতুন এলাকায় ঢুকেছে।
তৃতীয়ত, তারা ওই সব এলাকায় তাঁবু খাটাচ্ছে, বাঙ্কার বানাচ্ছে।
চতুর্থত, চিনা সেনাদের মনোভাবও এ বার অনেক বেশি আগ্রাসী।
চিনে প্রাক্তন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত মনে করছেন, এ বার যে শুধুই কয়েকটা ভারতীয় এলাকায় ঢুকে চিনা সেনা উত্তেজনা সৃষ্টি করতে চাইছে, তা নয়; বরং তাদের এই প্রচেষ্টার ইঙ্গিত মিলেছে অনেক বৃহত্তর এলাকা জুড়ে। আর এটা করার জন্য চিনা সেনাদের কাছে বেজিংয়ের কোনও স্পষ্ট বার্তা নেই, এটা মনে করাটা বিচক্ষণতার কাজ হবে না।
ফ্র্যাভেলের ধারণাটা অবশ্য কিছুটা ভিন্ন। তাঁর কথায়, ‘‘চিনের উহানে কোভিড-১৯-এর উৎপত্তি ও তার জেরে চিনা অর্থনীতির পিছু হটায় কিছুটা দমে যাওয়া বেজিংয়ের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল কোনও সীমান্তে তার শক্তিপ্রদর্শনের। এ বার পূর্ব লাদাখের ঘটনা ঘটেছে হয়তো তারই প্রেক্ষিতে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy