গায়ক ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতা ভিক্টর হারা ও তাঁর স্ত্রী জোন।—ছবি সংগৃহীত।
এক জনের কণ্ঠে গান। অপর পক্ষের হাতে ‘গান’। একেবারে সম্মুখ সমর!
দু’দিকের শব্দই থেমে গিয়েছে কয়েক দশক আগে। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের গলায় প্রতিবাদের হাতিয়ার হয়ে ফিরে এসেছে কিছু গান। চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোর রাস্তায় লাখ লাখ কণ্ঠে এখন আবার বেঁচে উঠেছেন ভিক্টর হারা। যাঁর রেখে যাওয়া গানের সূত্রে বাঁধা পড়েছিল এই বাংলাও।
অভ্যুত্থান ঘটিয়ে আউগুস্তো পিনোশের বাহিনী যখন চিলির ক্ষমতা দখল নিচ্ছে, সেই সময়েই খুন হন শিক্ষক, গায়ক ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতা হারা। চিলি স্টেডিয়ামে ১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর হারা-হত্যার বীভৎস স্মৃতি নিয়ে দেশ ছেড়েছিলেন তাঁর স্ত্রী জোন। আর এই জোনের সুবাদেই বাংলায় গণনাট্য সঙ্ঘ বার করতে পেরেছিল ‘খোলা জানালার গান’।
বাংলায় অনুবাদে হারার সুরের ডালির প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে তাঁর গান বাঁচানোর লড়াইটা একটু শুনে নেওয়া যাক। ভায়োলেটা পেরার কাছ থেকে লোকগানে হাত পাকিয়েছিলেন হারা। গান বাঁধতেন, সুর করতেন, গাইতেন। চিলির প্রেসিডেন্ট হয়ে সালভাদর আইয়েন্দে তাঁর বামপন্থী সরকারে হারাকে কিছু দায়িত্বও দিয়েছিলেন। আইয়েন্দের সরকারকে ফেলে ক্ষমতা দখলের সময় পিনোশে বাহিনী মরিয়া হয়ে খুঁজছিল হারাকে। প্রায় ৫ হাজার মানুষকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় চিলি স্টেডিয়ামে। হারাকে চিনে ফেলার পরে তাঁকে স্টেডিয়ামের ভিতরে একটি চেয়ারে বসতে দেয় বাহিনীর জওয়ানেরা। সামনের টেবিলে রাখা ছিল তাঁর প্রিয় গিটার। বন্দুকের বাঁট দিয়ে প্রথমে থেঁতলে দেওয়া হয় হারার হাতের আঙুল। তার পরে ‘শোলে’র গব্বর সিংহের কায়দায় হুকুম— এই বার তোর ওই গান গেয়ে দেখা!
অসহ্য যন্ত্রণা নিয়েই উঠে দাঁড়িয়েছিলেন হারা। শুরু করেছিলেন তাঁদের তৎকালীন পার্টির জন্য লেখা গান। পিনোশে বাহিনীকে চমকে দিয়েই স্টেডিয়ামে আটক পাঁচ হাজার কণ্ঠ যোগ দেয় সেই গানে। তার পরে আচমকাই গুলির শব্দ। স্বৈরাচারী শাসকের ৪৬টা বুলেট ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল হারার দেহ। একটা গণ-কবরে ফেলে দেওয়া হয়েছিল তাঁর ক্ষত-বিক্ষত দেহ।
এর পরে কী ভাবে পাওয়া গেল তাঁর গান? গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গীত বিভাগের দায়িত্বপ্পাপ্ত কঙ্কন ভট্টাচার্যের কথায় শোনা যাক— ‘‘ওঁর সব গান পিনোশের লোকজন নষ্ট করে ফেলত। কোনও ভাবে পোশাকের মধ্যে লুকিয়ে হারার স্ত্রী জোন ও কয়েক জন কিছু রেকর্ড সঙ্গে নিয়ে পালাতে পেরেছিলেন। জোন আদতে ব্রিটিশ। ইংরেজি অনুবাদ করে তিনিই হারার গান ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। তাঁর পাঠানো গান থেকেই আমরা ‘খোলা জানালার গান’ অ্যালবাম করতে পেরেছিলাম।’’
জোন এখন ব্রিটেন এবং আমেরিকায় ঘুরে-ফিরে থাকেন। জোন ও তাঁর সঙ্গীদের সঙ্গে দীর্ঘদিন যোগাযোগ ছিল কঙ্কনবাবুর। পরে ক্যাসেটও পাঠিয়েছিলেন কলকাতায়। কঙ্কনবাবুর কথায়, ‘‘কাছাকাছি তুলনা করলে বলা যায়, হারা অনেকটা আমাদের হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো। দুর্ধর্ষ গলা। গণসঙ্গীত, লোকসঙ্গীত যেমন গাইতেন, তেমনই আধুনিক রোমান্টিক গানেও স্বচ্ছন্দ।’’
চিলির রাস্তায় এখন যে ‘রাইট টু লিভ ইন পিস’ শোনা যাচ্ছে, সেই গান হারা লিখেছিলেন ভিয়েতনামের যোদ্ধাদের জন্য। যেখানকার যে আন্দোলনের জন্যই কলম ও গিটার ধরেছেন হারা, সেখান থেকেই আবার বাংলায় অনূদিত হয়ে এসেছে গান প্রতিবাদে শান দিতে। কঙ্কনবাবুরা বলছেন, প্রতিবাদের সুর কবে আর দেশ-কাল-ভাষার গণ্ডি মেনেছে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy