ভয়ঙ্কর শীতের আন্টার্কটিকা। এখন মাসের পর মাস সূর্যহীন আকাশের আন্টার্কটিকা। শুধুই রাত। তাপমাত্রা -৭৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট। এ আন্টার্কটিকা এখন অগম্য। আর তারই মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন দক্ষিণ মেরু গবেষণা কেন্দ্রের দু’জন। বড়সড় ঝুঁকি নিয়েই তাঁদের উদ্ধার করতে চলল দুই বিশেষ বিমান।
চলল তো বটে। কিন্তু ওই রকম আবহাওয়ায়, হিমাঙ্কের অনেক নীচে থাকা ওই ভয়াল ঠান্ডায়, ঘন অন্ধকার ভেদ করে, বিমান নামানো এবং উদ্ধার করে ফিরে আসাটা সহজ তো নয়ই, বরং বেশ বিপদের। এ সব জেনেই উদ্ধার কাজে চলেছেন দুই বিমানের আট জনের দল।
ষোল-সতেরো বছর আগেও এ ধরনের উদ্ধার অভিযান অসম্ভব ছিল। ১৯৯৯ সাল। দক্ষিণ মেরুর এই অ্যামান্ডসেন-স্কট গবেষণাগারের চিকিত্সকের ডান স্তনে গজিয়ে ওঠা মাংসপিণ্ড ধরা পড়েছিল এমন শীতকালেই। সেই চিকিত্সক নিজেই সেই মাংসপিণ্ড থেকে টিস্যু সংগ্রহ করে নিজেই বয়োপসি করেন। ধরা পড়ে ক্যানসার। নিজেই নিজের কেমোথেরাপি শুরু করেন তিনি। কোনও উপায় ছিল না ফিরে আসার। তার ছ’মাস পর আবহাওয়া বদলালে, শীত কমলে, ফিরিয়ে আনা হয়েছিল তাঁকে।
জনমানবহীন, দুর্গম দক্ষিণ মেরুতে এই মার্কিন গবেষণাগারটি গড়ে ওঠে ষাট বছর আগে। ছ’মাসের বেশি এখানে সূর্যের আলো পড়ে না। তার মধ্যে তিন মাস, মার্চ থেকে জুন, টানা নিকষ কালো রাত্রি। এমন এলাকায় গিয়ে বসবাসের তুলনায় পাণ্ডবদের বনবাসও কিছু নয়। লোক নেই, জন নেই। গাছপালা থাকা সম্ভব নয়। কয়েকটা মাত্র প্রজাতির মেরুদণ্ডী প্রাণীর বাস। শীত বাড়তে বাড়তে এক সময় তাপমাত্রা নেমে আসে -১২৮ডিগ্রি ফারেনহাইটে (প্রায় -৮৯ডিগ্রি সেলসিয়াস)। এই দুর্গম নির্জন প্রদেশে বসেই গবেষণার কাজ করে চলেছেন এক দল মানুষ। শুধু আমেরিকাই নয়, দক্ষিণ মেরুতে গবেষণা কেন্দ্র তৈরি করেছে আরও অনেক দেশ।
আরও পড়ুন: বাড়ির দরজায় টোকা অতিথির, দরজা খুলতেই অবাক মালিক!
কী হয় এই সব গবেষণা কেন্দ্রে? আমেরিকার এই অ্যামান্ডসেন-স্কট গবেষণাকেন্দ্রটা চালায় সে দেশের পোলার প্রোগ্রাম ফর ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন। পরিবেশ, জলবায়ু, আবহাওয়া পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা চলে এখানে। আছে দুটো রেডিও টেলিস্কোপ যা দিয়ে ব্রহ্মাণ্ডের আদি সময়কে খুঁজে চলেছেন এক দল গবেষক। আছে আইস কিউব নিউট্রিনো অবজারভেটরি যা দিয়ে পরমাণুর গভীরের সব কণাদের গতিবিধি, আচার ব্যবহার নজর করা হয়। নির্জন প্রান্তরে বসে এ ভাবেই চলে বিজ্ঞানের মহাযজ্ঞ।
কিন্তু অসুখবিসুখ তো আছে! কেউ অসুস্থ হলে তার জন্য আছেন বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরাও। কিন্তু বড় কিছু হলে? উড়িয়ে নিয়ে আসতে হয় দেশে। কিন্তু সময়টা যদি শীতকাল হয় তবে ব্যাপার গুরুতর। অত সহজ নয় এ সময় কাউকে ওখানে গিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। এই মার্কিন গবেষণাগারের ষাট বছরের ইতিহাসে এর আগে মাত্র দু’বার দু’জনকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে শীতকালে। তাও পুরোটা নির্বিঘ্নে হয়নি। আসলে ১৯৯৯ সালে সেন্টারের চিকিত্সকের সেই ক্যানসার ধরা পড়ার পর থেকেই বিষয়টা মাথায় ঢোকে সকলের। কিছু একটা উপায় বার করতে হবে!
উপায়টা প্রথম বের করা হয় ২০০১ সালে। শীত পড়ে গেছে। এপ্রিল মাস। মাস দেড়েক আগে চলে গেছে মরসুমের শেষ বিমান। এমন সময় প্রচণ্ড পেটে ব্যথা শুরু হল চিকিত্সক শেমেনস্কির। ধরা পড়ল প্যাংক্রিয়াটাইটিস। ঠিক হল তাঁকে যে কোনও ভাবেই হোক ফিরিয়ে আনতে হবে। শেমেনস্কি অবশ্য জেদ ধরলেন তিনি ফিরবেন না। নিজের চিকিত্সা নিজেই করবেন। চিকিত্সা শুরুও করলেন শেমেনস্কি। কিন্তু বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা মত দিলেন, যে সময় আবার ওখানে বিমান যাতায়াত শুরু হবে সেই পর্যন্ত, অর্থাত্ আরও ছ’মাস, তিনি বেঁচে থাকবেন কি না সন্দেহ! শুধু তো শেমেনস্কির বিপদ নয়, বিপদ গবেষণাগারের বাকি ৪৯ জন কর্মীরও। শেমেনস্কি অসুস্থ থাকলে বা আরও খারাপ কিছু ঘটে গেলে বাকিদের চিকিত্সা করবে কে? তাই পাঠাতেই হবে ডাক্তার। একই সঙ্গে ফিরিয়ে আনা হবে শেমেনস্কিকে। কিন্তু কী ভাবে?
পরের অংশ পড়তে ২ ক্লিক করুন
প্রথমেই যোগাযোগ করা হল মার্কিন বায়ুসেনার সঙ্গে। কিন্তু হাত তুলে দিল বায়ুসেনা। অত ঠান্ডায় কাজ করার মতো বিমান তাদের নেই। আসলে আন্টার্কটিকার শীতকালের ঠান্ডায় বিমানের জ্বালানি জমে জেলির মতো ঘন হয়ে যায়। জমে যায় গ্রিজও।
খোঁজ পাওয়া গেল কানাডার এক বিমান সংস্থার যাদের হাতে থাকা ওট্টার বিমান নাকি -১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইটেও কাজ করতে পারে। খুব অল্প জ্বালানিতে চলে এই বিমান। প্রচণ্ড ঠান্ডাতেও জ্বালানি গরম করে রাখার ব্যবস্থা ভাল। কিন্তু তবুও শীতের দক্ষিণ মেরুতে প্রথম বিমান নিয়ে নামাটা ঘোর দুশ্চিন্তার বই কি!
কেউ কখনও যা করেনি সেই দায়িত্বই নিয়ে ফেললেন পাইলট লুটিট। রওনা দিলেন দক্ষিণ মেরুর দিকে। ঘন অন্ধকারে কয়েক ঘণ্টা চলার পর হঠাত্ নীচে মিলল আলোর দেখা। দক্ষিণ মেরুর অস্থায়ী রানওয়েতে ব্যারেলের গ্যাসোলিন জ্বালানোর ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন গবেষণাগারের কর্মীরা। সেই আলো দেখে নামতে শুরু করল বিমান। নেমে পড়ল বরফে। বিকল্প চিকিত্সককে নামানো হল নীচে, তুলে নেওয়া হল শেমেনস্কিকে।
এই পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। কিন্তু বিমান ওড়াতে গিয়েই বুকটা ছ্যাত করে উঠল পাইলটের। এগোন যাচ্ছে না। কী হল? দু’ধরনের গোলমাল ধরা পড়ল। বিমানের স্কি আটকে গেছে বরফে। আর ডানার জয়েন্টের গ্রিজ জমে প্রায় কঠিন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য এ সব সামলে উড়ল বিমান। ফিরিয়ে আনা গেল শেমেনস্কিকে।
দু’বছর পর ফের এমন শীতকালেই গল ব্লাডার ইনফেকশন হল এক কর্মীর। প্রথম বারের কো-পাইলট মার্ক ক্যারিকে সঙ্গে নিয়ে আবার একই ভাবে বিমান চালিয়ে গেলেন লুটিট। উদ্ধার করে আনলেন রোগীকে।
তার পর এক যুগের উপর আর এমন কোনও জরুরি প্রয়োজন পড়েনি। ফলে কনকনে অন্ধকারে দুর্গম দক্ষিণ মেরুতে যাওয়ার আর কোনও ঝুঁকি নিতে হয়নি। নিতে হচ্ছে এ বার। পোলার প্রোগ্রামস ফর ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের ডিরেক্টর কেলি ফকনার জানাচ্ছেন, গবেষণা কেন্দ্রের দুই কর্মী অসুস্থ পড়েছেন। ওখানে রেখে চিকিত্সা সম্ভব নয়। তাই উদ্ধার করে আনতে হচ্ছে দু’জনকেই।
সব ঠিকঠাক চললে আগামী রবিবার তৃতীয়বারের জন্য শীতের আন্টার্কটিকায় নামতে চলেছে কোনও বিমান। একটা নয়, এক সঙ্গে রওনা হবে দুটো ছোট্ট ওট্টার বিমান। প্রতি বিমানে থাকবেন একজন পাইলট, একজন কো-পাইলট, একজন ইঞ্জিনিয়ার এবং একজন ডাক্তার। দুটো বিমানই অবশ্য শেষ পর্যন্ত যাবে না। অনেক আগে অ্যাডিলেড দ্বীপে ব্রিটিশ গবেষণাকেন্দ্র রোথেরায় অপেক্ষা করে থাকবে একটি বিমান। নজর থাকবে অন্যটার উপর, যে উড়ে যাবে আরও গভীরে, পৃথিবীর একদম ‘তলায়’। এবং উদ্ধার করে আনবে দুই অসুস্থকে। যদি কোনও গোলমাল হয়, ছুটে যাবে দ্বিতীয় বিমান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy