বুধবার সর্বোচ্চ আদালত আসামিদের আপিল খারিজ করে দেওয়ার পরে দেরি করল না বাংলাদেশ সরকার। শনিবার রাতেই ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হল একাত্তরে গণহত্যার দুই নায়ক বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও জামাতে ইসলামির সাধারণ সম্পাদক আলি আহসান মহম্মদ মুজাহিদকে। দিনভর নাটকের পর শেষ পর্যন্ত এই ফাঁসি কার্যকর হয় কি না, তা জানতে উৎসুক ছিলেন দেশজোড়া মানুষ। সময় নষ্টের কোনও অছিলা আসামিদের পক্ষে বাদ রাখা হয়নি। এমনকী বেনজির ভাবে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষাও করেন তাঁরা। কিন্তু রাতেই সেই আর্জি খারিজ হয়ে যাওয়ার পরে ফাঁসির রায় কার্যকর করতে সব বাধা কেটে যায়। ফাঁসি হয়ে যাওয়া মাত্র উল্লাসে ফেটে পড়ে বাংলাদেশ। রাতেই মশাল মিছিল বার করে ঢাকা পরিক্রমা করে গণজাগরণ মঞ্চের সদস্যরা। মিছিল বেরোয় বাংলাদেশের ছোটবড় প্রায় সব শহরেই। পাশাপাশি তাঁদের নেতা মুজাহিদের ফাঁসির প্রতিবাদে সোমবার হরতাল ডেকেছে জামাতে ইসলামি।
আগের খালেদা জিয়া সরকারের দুই প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন সাকা ও মুজাহিদ। ঢাকায় বুদ্ধিজীবীদের গণহত্যার মাথা মুজাহিদ ছিলেন খালেদার সমাজকল্যাণ মন্ত্রী। আর চট্টগ্রাম থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে উজাড় করার নায়ক সাকা চৌধুরী ছিলেন মন্ত্রী পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর সংসদীয় উপদেষ্টা। গণহত্যা ও মানবতা-বিরোধী অপরাধে দু’জনকেই প্রাণদণ্ড দিয়েছিল আন্তর্জাতিক আদালত। সুপ্রিম কোর্টও তা বহাল রাখে। তার পরেও সেই রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আপিল করেছিলেন দুই আসামি। বুধবার সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্রকুমার সিন্হার নেতৃত্বে চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ সেই আবেদনও খারিজ করে। এর পরে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন জানানোর সুযোগ ছিল দুই আসামির। কিন্তু তা নিয়ে প্রচুর নাটক করেন সাকা ও মুজাহিদ। আগে তাঁরা মৌখিক ভাবে জানিয়েছিলেন, প্রাণভিক্ষা চাইবেন না। কিন্তু আজ ফাঁসির তোড়জোড় শুরুর পরে জেল পরিদর্শনে যাওয়া দুই ম্যাজিস্ট্রেটকে তাঁরা জানান, রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন। এ খবর শুনে সাকার পরিবার বিস্ময় প্রকাশ করেন। মুজাহিদের ছেলে ও জামাতের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সরকার মিথ্যে কথা বলছে। কেউ প্রাণভিক্ষা চাননি। কিন্তু রাতে রাষ্ট্রপতির দফতর থেকে জানানো হয়, সাকা ও মুজাহিদের প্রাণভিক্ষা নামঞ্জুর করা হল। এর পরেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ঘোষণা করেন, রাতেই ফাঁসির পরে আসামিদের দেহ গ্রামের বাড়িতে কবর দেওয়া হবে। নিজের দুই মন্ত্রীর ফাঁসির তোড়জোড় শুরু হওয়া মাত্র দীর্ঘ লন্ডন সফর কাটছাঁট করে এ দিনই ঢাকায় ফিরে এসেছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। বিএনপি-র পক্ষে বলা হয়েছে, দেশে সঙ্কটময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়াতেই তাঁদের নেত্রী চিকিৎসা স্থগিত রেখে দেশে ফিরলেন।
একাত্তরে আল বদর সংগঠনের প্রধান মুজাহিদ স্বাধীনতাপন্থী বাঙালি বিশিষ্ট জনেদের ‘খতম তালিকা’ তৈরি করে দিয়েছিলেন সহযোগী পাকিস্তানি সেনাদের। পরাজয়ের আগে সেই তালিকা ধরে বিশিষ্ট অধ্যাপক, শিল্পী, লেখক ও চিকিৎসকদের বাড়ি থেকে তুলে এনে খুন করে পাক সেনারা। তখনও মুজাহিদ তাঁদের চিনিয়ে দিতে সেনাদের সঙ্গে ছিলেন। পরে জামাতে ইসলামির শীর্ষ নেতা হন মুজাহিদ। এখনও তিনি দলটির সাধারণ সম্পাদক।
অন্য দিকে বাহিনী তৈরি করে চট্টগ্রামকে সংখ্যালঘু-শূন্য করার অভিযান চালান সাকা চৌধুরী। অভিযোগ, সংখ্যালঘুদের মাথা কেটে আনলে তিনি পুরস্কারের ঘোষণা করেছিলেন। রাউজানে নিজের হাতে গুলি করে খুন করেছিলেন কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের মালিক বৃদ্ধ নূতনচন্দ্র সিংহকে। একটি দখল করা বাড়িতে ‘টর্চার ও কিলিং ক্যাম্প’-ও চালাতেন সাকা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তিনি প্রথমে পাকিস্তান ও পরে ব্রিটেনে চলে যান। জিয়াউর রহমানের আমলে দেশে ফিরে বিএনপি-তে যোগ দেন সাকা। এরশাদ তাঁকে মন্ত্রী করেন। খালেদা তাঁকে সংসদীয় উপদেষ্টা করেন। খালেদার আমলে চট্টগ্রামে ধরা পড়া আলফার জন্য পাঠানো ১০ ট্রাক অস্ত্র যে জাহাজে করে এসেছিল, সেটিরও মালিক ছিলেন সাকা চৌধুরী।
এ দিন সকালে ফাঁসির তোড়জোড় শুরু হওয়ার খবর পেয়েই চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়ক অবরোধ করে মুক্তিযোদ্ধারা জানান, সাকা চৌধুরীর মৃতদেহ তাঁরা রাউজানের মাটিতে কবর দিতে দেবেন না। গণজাগরণ মঞ্চও বিকেল থেকে শাহবাগ চত্বরে অবস্থান শুরু করেন। ফাঁসির পরেও উল্লাসে ফেটে পড়ে মিছিল বার করেন তাঁরা। গণ্ডগোল রুখতে ঢাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর করা হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy