আজ এক দিকে বৈঠক চলেছে, অন্য দিকে যুদ্ধ। এ দিনও খারকিভে রাশিয়ার শেলিংয়ে ১১ জন সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। এ পর্যন্ত যুদ্ধে ইউক্রেনের শ’খানেক বাসিন্দার প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে রয়েছে ৭টি শিশু। ইউক্রেন প্রশাসনের দাবি, কিভের বাইরে মাইল খানেক দীর্ঘ রুশ কনভয় জড়ো হয়েছে আজ।
গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
কথামতোই আজ বেলারুস সীমান্তে বসেছিল রাশিয়া-ইউক্রেন শান্তি বৈঠক। দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা চলেছে, চলেছে যুদ্ধও। তবে সমাধান এখনও স্পষ্ট নয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ফের বৈঠক বসবে। দুই দেশই এখন তার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে শোনা গিয়েছে।
এ দিনের শান্তি বৈঠকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কির প্রতিনিধিরা দাবি করেছেন, অবিলম্বে সংঘর্ষবিরতি ঘোষণা করতে হবে। ইউক্রেন থেকে সম্পূর্ণ ভাবে সরিয়ে নিতে হবে রুশ সেনাবাহিনীকে। শুধু তা-ই নয়, ক্রাইমিয়া ও ডনবাস এলাকাকেও রুশ সেনা-মুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। বৈঠক শুরুর আগে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছিলেন, ‘‘কথা হোক আগে। সমঝোতায় পৌঁছতে আমরা কী ভাবছি, সে নিয়ে এখনই কিছু বলব না।’’ বৈঠক শেষেও রাশিয়া কী চায়, সে নিয়ে বাইরে টুঁ শব্দটি করেনি ক্রেমলিন। দ্বিতীয় পর্যায়ের বৈঠকের আগে মস্কোয় ফিরে গিয়েছে রুশ প্রতিনিধিদল। ইউক্রেনীয়রাও কিভে ফিরেছেন। শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনার পরে তাঁরা ফের বেলারুস সীমান্তের বৈঠক-স্থলে ফিরবেন।
এ যুদ্ধের মাত্রা এখন ভিন্ন। পাঁচ দিন হল ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছে রাশিয়া। কিন্তু তাদের পরিকল্পনা মতো চলেনি কিছুই। প্রবল বিক্রমে রুশ বাহিনীকে আটকে দিয়েছে ইউক্রেনের সেনা। ইউক্রেনবাসীকে ‘নাৎসি অত্যাচার থেকে মুক্ত’ করতে চেয়েছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। কিন্তু তাঁর সে দাবিও বিফলে গিয়েছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছে ইউক্রেনের সাধারণ মানুষও। এবং সর্বশেষ, রণক্ষেত্রে এসে না দাঁড়ালেও বর্তমানে ইউক্রেনের পাশে ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, জাপানের মতো শক্তিরা। বিশ্বমঞ্চে কার্যত কোণঠাসা রাশিয়া। পশ্চিমকে ‘মিথ্যার সাম্রাজ্য’ বলে আজ ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট। একের পর এক আর্থিক নিষেধাজ্ঞায় জেরবার তাঁর দেশ। সেই সঙ্গে চলছে লাগাতার সাইবার হানা। ইউক্রেনে হামলার প্রতিবাদে বহু দেশ নিজেদের আকাশসীমায় রুশ বিমানের প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলিও। এ জন্য আজ জেনিভায় রাষ্ট্রপুঞ্জের দফতরে যাওয়া বাতিল করতে হয়েছে রুশ বিদেশমন্ত্রী লাভরভকে। এই ‘অপমানের’ জবাবে রাশিয়াও ৩৬টি দেশের জন্য তাদের আকাশপথ বন্ধ করে দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ইউরোপের দেশগুলি ও কানাডা।
এখানেই শেষ নয়। রাশিয়ায় উপস্থিত আমেরিকানদের দ্রুত সে দেশ ছেড়ে চলে যেতে পরামর্শ দিয়েছে ওয়াশিংটন। রাশিয়ার বন্ধু দেশ বেলারুসেও তাদের দূতাবাস বন্ধ করে দিয়েছে আমেরিকা। মস্কোর দূতাবাস থেকেও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বহু কর্মীকে। ‘ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি’ (আইওসি) আজ রাশিয়া ও বেলারুসের অ্যাথলিটদের সমস্ত আন্তর্জাতিক স্পোর্টস টুর্নামেন্টে যোগ দেওয়ার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। তারা একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে, গোটা বিশ্বের খেলোয়াড়দের মধ্যে ‘একতা’ বজায় রাখতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।
শুধু বাইরে নয়, ঘরেও সমালোচনার শিকার পুতিন। নিজের দেশেরই সমর্থন নেই তাঁর কাছে। গত কয়েক দিন ধরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধ-বিরোধী বিক্ষোভে নামছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। গ্রেফতার হচ্ছেন, পুলিশের অত্যাচারে জখম হচ্ছেন, তার পরেও তাঁরা ভিড় করছেন রাস্তায়। যুদ্ধ থামানোর দাবিতে সই সংগ্রহ চলছিল রাশিয়ায়। সূত্রের খবর, ১০ লক্ষের বেশি সই-সহ পিটিশন জমা পড়েছে প্রেসিডেন্টের দফতরে।
এই পরিস্থিতিতে শোনা যাচ্ছে, মস্কোও চায় সমঝোতায় পৌঁছতে। এ যুদ্ধে তাদেরও কম ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ইউক্রেনের দাবি, তাদের প্রতিঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন চার হাজারের বেশি রুশ সেনা। যুদ্ধে ব্যয় হয়েছে কোটি কোটি ডলার। ইউক্রেনের দাবি অনুযায়ী, রাশিয়ার ১৪৬টি ট্যাঙ্ক, ২৭টি যুদ্ধবিমান, ২৬টি হেলিকপ্টার ধ্বংস করেছে তারা। কিন্তু প্রবল আগ্রাসনেও গত চার দিনে ইউক্রেনের কোনও গুরুত্বপূর্ণ শহর দখল করতে পারেনি রাশিয়া। তারা শুধু দক্ষিণ-পূর্ব ইউক্রেনের দু’টো ছোট শহর কব্জা করেছে। বাকি সর্বত্র প্রবল বাধার মুখে পড়েছে রুশরা।
গত কাল প্রবল বেপরোয়া হয়েই দেশের পরমাণু অস্ত্র নিয়ন্ত্রক পর্ষদকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে লড়ার জন্য প্রস্তুত হতে নির্দেশ দেন পুতিন। তাঁর বক্তব্য ছিল, নেটোর আগ্রাসী মনোভাব ও তাঁদের বিরুদ্ধে একের পর এক আর্থিক নিষেধাজ্ঞা বেআইনি ভাবে চাপিয়ে দেওয়ার জন্য এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছেন তিনি। ও দিকে বেলারুস জানায়, পরমাণু হামলা হলে যুদ্ধে তাদের মাটি রাশিয়াকে ব্যবহার করতে দেবে তারা। পরিবর্তে বেলারুসের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কাকে আরও ক্ষমতা পাইয়ে দেবে মস্কো। ১৯৯৪ সাল থেকে বেলারুসের প্রেসিডেন্ট পদে রয়েছেন লুকাশেঙ্কো। সংবিধান বদলে ২০৩৬ সাল পর্যন্ত তাঁর গদিতে বসার পাকাপাকি ব্যবস্থা করতে সাহায্য করবেন পুতিন। দু’দেশের এই জোটে পরমাণু যুদ্ধের আতঙ্ক ছড়ায় নিমেষে। ঘটনাচক্রে, এর পরেই জ়েলেনস্কি শান্তি-আলোচনায় বসার জন্য সম্মতি প্রকাশ করেন।
আজ এক দিকে বৈঠক চলেছে, অন্য দিকে যুদ্ধ। এ দিনও খারকিভে রাশিয়ার শেলিংয়ে ১১ জন সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। এ পর্যন্ত যুদ্ধে ইউক্রেনের শ’খানেক বাসিন্দার প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে রয়েছে ৭টি শিশু। ইউক্রেন প্রশাসনের দাবি, কিভের বাইরে মাইল খানেক দীর্ঘ রুশ কনভয় জড়ো হয়েছে আজ। তাদের সঙ্গে বেলারুসের সেনাও যোগ দিতে পারে বলে খবর রয়েছে ইউক্রেনের কাছে। তবে নেটোর দাবি, লোকবলের অভাব দেখা দিয়েছে রুশ বাহিনীতে। যুদ্ধে হাজার খানেক রুশ সেনার মৃত্যু হয়েছে। যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় রসদের অভাবও ভোগাচ্ছে তাদের। তাদের কাছে যথেষ্ট জ্বালানি নেই, অস্ত্র নেই। এমনকি খাদ্যাভাবও দেখা দিয়েছে। নেটোর এক কর্তা বলেন, ‘‘একাধিক সমস্যা। ওদের কাছে যথেষ্ট ডিজ়েল নেই। ফলে সেনার অভিযানের গতি ক্রমশ কমছে। তবে সব চেয়ে বড় সমস্যা হল, কোথাও একটা নৈতিক বোধ ও বিচারে ভুগছে রুশ বাহিনীও।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy