(বাঁ দিকে) নপসিংদীর স্কুলছাত্র, ১৫ বছর বয়সী তাহমিদ ভুইয়াঁ। ফেসবুকে ছেলের সঙ্গে ছবি পোস্ট করেছেন ফারহান ফৈয়াজ়ের মা (ডান দিকে উপরে)। ঢাকা টাইমসের সাংবাদিক মেহেদি হাসান(ডান দিকে নীচে)। ছবি: ফেসবুক।
ছেলের রক্তাক্ত দেহ বুকে নিয়ে মা জানতে চাইছেন, ‘তুই মোর ছাওয়াক চাকরি না দিবু না দে, কিন্তু মারলু ক্যানে!’ হাসপাতালে কিশোরের নিথর দেহের উপরে আছাড়িপিছাড়ি আর এক মা। আন্দোলনরত ছাত্রের হাতে জাতীয় পতাকা, রক্ত ঝরছে তা থেকেও। ঢাকার হাসপাতালের মর্গে সার সার দেহ, রাবার বুলেটের ঘায়ে ফেটে গিয়েছে তাদের বুক-পেট।
সমাজমাধ্যমে এ রকম অজস্র ছবি তুলে ধরছে বাংলাদেশে গত কয়েক দিন ধরে চলা পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের সংঘর্ষের ভয়াবহতা। ৬... ৯.... ২০... ৩২...। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে নিহতের সংখ্যা। তাদের অধিকাংশই পড়ুয়া, কেউ কেউ স্কুলের গণ্ডিও পেরোয়নি।
যেমন, তাহমিদ ভুইয়াঁ। ১৫ বছরের তাহমিদ নরসিংদীর এনকেএম হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র ছিল। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে পুলিশ ও বিজিবির সঙ্গে ছাত্রদের সংঘর্ষের মাঝখানে পড়েছিল ছেলেটি। রাবার বুলেট লাগে বুকে। চামড়ার তলায় চাপচাপ রক্ত, নাকে নল লাগানো স্পন্দনহীন তাহমিদের ছবি ভাইরাল হয়েছে সমাজমাধ্যমে। তার স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও সাবেক ছাত্রদের একটাই প্রশ্ন— ‘পুলিশ, ভাইটাকে মারলে কেন!’ নিহত হয়েছে নরসিংদীর আর এক পড়ুয়া, ১৮ বছর বয়সি ইমন-ও। চট্টগ্রামে নিহতদের মধ্যে রয়েছে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী, ১৮ বছর বয়সি মোহাম্মদ ইমাদ।
ঢাকার ধানমন্ডি এলাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত রেসিডেনশিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্র, ১৮ বছর বয়সি ফারহান ফৈয়াজ়ের মা ফেসবুকে ছেলের সঙ্গে একটি ছবি পোস্ট করে লিখেছেন— ‘এই আমার ফারহান। ও এখন মৃত। আমার বিচার চাই।’ আর এক পুত্রহারা মায়ের হাহাকার— ‘আমার ছেলেকে চাকরি না হয় না দিবি, কিন্তু ওকে মারলি কেন’— সমাজমাধ্যমে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। মায়ের আর্ত চিৎকারকে সম্বল করে বাংলাদেশের তরুণ কবি সাদাত হোসাইন লিখেছেন, ‘যে মায়ের চোখ, সমুদ্র শোক, কন্যার শ্বাস... সে মায়ের কোল, শূন্য আঁচল, ভরে যাবে কীসে!’
এ বারের ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম প্রতীকী মুখ আবু সাইদ। পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছেন বেগম রোকেয়া কলেজের ইংরেজি বিভাগের ২২ বছর বয়সি এই পড়ুয়া। হাতে বাঁশের লাঠি নিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, আবুর সেই ছবি গত কালই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল।
আর্মি আইবিএ কলেজের ম্যানেজমেন্ট পড়ুয়া মীর মুগ্ধ গত ৩০ মে তাঁর ফেসবুক পোস্টে লিখেছিলেন ‘আনন্দ’ ছবির সেই বহুশ্রুত সংলাপ— ‘বাবুমশাই, জ়িন্দগি বড়ি হোনি চাহিয়ে, লম্বি নহি’। গত কয়েক দিন ধরে সমানে ছাত্র আন্দোলনের সমর্থনে ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছিলেন। দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের উদ্দেশে তাঁর বার্তা ছিল, ‘রাজনীতির রং লাগিয়ে আমাদের আন্দোলনকে ছোট করবেন না’। মীরের শেষ পোস্ট ছিল আজ বিকেলবেলায়। সন্ধেবেলা জানা যায়,পুলিশের গুলিতে বিদ্ধ হয়েছেন মীর।
নিহতদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা টাইমসের সাংবাদিক মেহেদি হাসান-ও। বয়স ২৮। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পরে যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকা থেকে তাঁকে আনা হয়েছিল বলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের জরুরি বিভাগের চিকিৎসকেরা জানান। তাঁর শরীরে ছররা গুলির ক্ষত ছিল। মেডিক্যালে আজ মেহেদি-সহ ছ’জনের মৃতদেহ নিয়ে আসা হয়েছে বলে হাসপাতাল সূত্রের খবর।
রাবার বুলেট মারণাস্ত্র নয়, পুলিশের এই দাবি নস্যাৎ করে বাংলাদেশের মর্গে মর্গে দেহের সংখ্যা বাড়ছে। অসমর্থিত সূত্রের খবর, নিহতের সংখ্যা ৪০ পেরিয়েছে। পুলিশের গুলিতে জখম চার জনকে ঢাকার কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চার জনকেই মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা। সমাজমাধ্যমে একাধিক বার শেয়ার করা ছবিতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যাচ্ছে, তাঁদের বুক ও পেটের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে। শুধু গুলি নয় অভিযোগ, লাঠির ঘা ও ধারাল অস্ত্র দিয়ে কোপানোও হচ্ছে কিশোর ও তরুণ ছাত্রদের। ‘এ ভাবে মারতেছে কেন বাচ্চাগুলোকে!’— প্রশ্ন সবার মুখে।
নিরুত্তর ঢাকার রাজপথ। উত্তর নেই গ্রামবাংলার আলপথেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy