শমি চক্রবর্তী
রানির দেশ এখন যে বাঙালিনীকে নিয়ে সরগরম, তাঁর রাজনীতিতে হাতেখড়ি মূলত বাবা-মায়ের জন্যই। বিশিষ্ট সেই মানবাধিকার কর্মী শমি ওরফে শর্মিষ্ঠা চক্রবর্তী জানিয়েছেন, ডাইনিং টেবিলে বসে মানবাধিকার আর রাজনীতি— এই দুই নিয়েই প্রতিনিয়ত চর্চা হতো তাঁদের। শমি অবশ্য তখন জানতেন না, এই সব আলোচনাই আগামী দিনে তাঁর ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
বছর ৪৭-এর শর্মিষ্ঠা এখন হাউস অফ লর্ডসে মনোনীত সদস্য। তাঁর মনোনয়ন নিয়েই তোলপাড় ব্রিটেনের রাজনীতি। তবে শমি এই মুহূর্তে ও সবে বিচলিত নন। ১৯৬৯ সালে ১৬ জুন উত্তর পশ্চিম লন্ডনের কুইন্সবেরিতে জন্ম তাঁর। বাবা-মা নাম রেখেছিলেন শর্মিষ্ঠা। পঞ্চাশের দশকে কলকাতা ছেড়ে যাঁরা পাড়ি দেন ব্রিটেনে। শমির বাবা পেশায় ছিলেন অ্যাকাউন্ট্যান্ট। মা একটি স্টোরে সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। হ্যারোয় বেন্টলি উড নামে একটি স্থানীয় স্কুলে পড়াশোনা। কালে কালে শমি পৌঁছবেন লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস-এ আইনের পাঠ নিতে।
মানবাধিকার বা রাজনীতির মতো বিষয়ে আগ্রহ কী ভাবে তৈরি হলো? কথায় কথায় শমি ফিরে দেখেন, বছর ১২-র ছোট্ট মেয়েটিকে। বাবা-মায়ের সঙ্গে এক দিন টিভি-তে খবর দেখতে দেখতে ইয়র্কশায়ারের পিটার সাটক্লিফ নামে এক ‘সিরিয়াল কিলার’-কে নিয়ে কথা হচ্ছিল। ছোট্ট শমির মনে হয়েছিল, এমন নিষ্ঠুর মানুষের ফাঁসিই হওয়া উচিত। তখন তাঁর বাবা শমিকে বোঝান, কারও জীবন কেড়ে নেওয়া কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে। তিনি বলেন, কেউ সাংঘাতিক অপরাধ করলেও তাকে সব সময় ফাঁসি দেওয়া যায় না। কারণ কোর্টের কাছেও কখনও ভুল প্রমাণ হাতে আসতে পারে এবং একটি নিরপরাধ মানুষ ফাঁসিকাঠের বলি হতে পারে।
শমি বলেন, বাবার সেই কথাগুলোই জীবন পাল্টে দিয়েছিল তাঁর। মানবাধিকার নিয়ে ভাবনাচিন্তার শুরু বোধহয় সেই কথার সূত্র থেকেই। জীবনে বড় প্রভাব ফেলেছিল হার্পার লি-র বই ‘টু কিল আ মকিং বার্ড’-ও। যেখানে কৃষ্ণাঙ্গ এক ব্যক্তি ধর্ষণ না করেও চক্রান্তের শিকার হন। এ ছাড়াও মার্টিন লুথার কিঙ্গ এবং নেলসন ম্যান্ডেলার প্রভাব তো ছিলই। ১৯৯৪ সালে আইন নিয়ে কাজকর্ম শুরু হয় শমির। দু’বছর পরে হোম অফিসে আইনজীবী হিসেবে যোগদান। ’৯৫-এ মার্টিন হপার নামে এক আইনজীবীকেই বিয়ে। ২০১৪ সালে সে সম্পর্কে ইতি। রয়েছে এক ছেলে।
২০০১ সালে ৯/১১-র ঠিক এক দিন আগে ব্রিটেনের অন্যতম মানবাধিকার সংগঠন লিবার্টি-তে যোগ দেন শমি। এর পরে তাঁর দুনিয়াটা দ্রুত পাল্টে যেতে শুরু করে। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেই বলেছিলেন, ‘‘৯/১১-র মতো ঘটনার পরেই বুঝেছিলাম, সরকার সন্ত্রাস মোকাবিলায় আটঘাট বেঁধে নামবে। আর তাতে জোর ধাক্কা খাবে মানবাধিকার।’’ সেই সময়েই আবার অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন শমি। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করার জন্য দ্বৈত দায়িত্ব যেন চেপে বসেছিল তাঁর কাঁধে। ২০০৩ সালে অনেক হোমরা-চোমরা ব্যক্তিকে হারিয়ে লিবার্টির অধিকর্তা হন শমি। ছোট চুলের কাজল পরা চোখের বাঙালি মেয়েটি লিবার্টিকে ব্রিটেনের প্রথম সারির মানবাধিকার সংগঠনে পরিণত করেন কিছু দিনেই।
ব্রিটেনে সন্ত্রাস দমন আইনের আওতায় রাজনৈতিক বন্দিদের বেশি সময় আটকে রাখার জন্য (২৮ দিনের পরিবর্তে ৪২ দিন) সক্রিয় হওয়ায় লেবার সরকারের বিরুদ্ধে একাধিক বার সরব হয়েছেন শমি। এ ভাবেই একটা সময়ে ব্রিটেনের টিভি চ্যানেলে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন তিনি। ২০০৫ সালের ব্রিটেনের একটি রেডিও চ্যানেলের ‘পিপল হু রান ব্রিটেন’ ভোটে রুপার্ট মার্ডক এবং টনি ব্লেয়ারের মতো ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছেন। এই সময় থেকেই রাজনীতির অলিন্দে আনাগোনা শুরু শমির। ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও এক সময় তাঁর নাম উঠে এসেছিল। শুধু আইন-মানবাধিকার নয়, ব্রিটেনের এই বাঙালি কন্যার উৎসাহ রয়েছে ফিল্ম নিয়েও। ছবি পরিচালনা করবেন বলেও ভেবেছিলেন এক বার। ২০১৪ সালে লিখেছেন বই, ‘অন লিবার্টি’। এ বছর ছেড়ে এসেছেন সেই সংস্থা।
এ হেন শমিকে নিয়ে বিতর্ক কেন?
লেবার পার্টিতে ইসলাম এবং ইহুদি ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ রয়েছে কি না বুঝতে একটি রিপোর্ট তৈরি করতে হয়েছিল শমিকে। তাতে তিনি জানান, ওই দলের বিরুদ্ধে এমন কোনও অভিযোগ নেই। রিপোর্ট দেওয়ার পরেই লেবার নেতা জেরেমি করবিন হাউস অব লর্ডসে মনোনীত করেন শমিকে। কিন্তু আগে করবিনই বলেছিলেন, হাউস অব লর্ডসে সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত কাউকে মনোনীত করা হবে না। তা সত্ত্বেও শমিকে কেন মনোনয়ন দেওয়া হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তবে শমির নাম মনোনীত করেছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনও। শমির আগে এই সম্মান পেয়েছেন আরও এক বাঙালি মহিলা, বাংলাদেশের পলা উদ্দিন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy