‘জ়িরো গ্যালারি’ তৈরি করেছে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন আবাসিক কলেজ। —নিজস্ব চিত্র।
আপনি কি শূন্যের ‘উৎস’ জানেন? ‘শূন্য’ কী ভাবে এল? আপনি কি জানেন যে, শূন্য শুধুমাত্র ‘০’ নয়? আপনি কি জানেন ‘শূন্য’ আবিষ্কারে ভারতীয়দের ভূমিকা? অঙ্কে শূন্যের ব্যবহার কারা প্রথম করেছিলেন?
সমস্ত প্রশ্নের জবাব একটি ছাতার তলায়, থুড়ি একটি গ্যালারির অন্দরে পেয়ে যাবেন আপনি। পরিভাষায় ‘জ়িরো গ্যালারি’। নাম ‘শূন্য শুধু ০ নয়’। তৈরি করেছে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন আবাসিক কলেজ। আঙ্কিকেরা বলছেন, এমন গ্যালারি সারা দেশেই অনন্য।
শূন্যের উৎস সম্পর্কে ধারণা দিতে তৈরি ওই গ্যালারিতে উৎসাহীদের বিবিধ প্রশ্নের জবাব মিলবে। মোট ২১টি স্লাইডে শূন্যের ইতিহাস নিয়ে নানা দুর্লভ ছবি ও তথ্য রয়েছে সেখানে। কয়েকটি প্রাচীন সভ্যতার উদাহরণ দিয়ে শূন্যের উৎস সম্পর্কে বলা হয়েছে। তুলে ধরা হয়েছে শূন্য আবিষ্কারে ভারতীয়দের ভূমিকা। গণিতচর্চার সঙ্গে যুক্ত অনেকের মতে, শূন্য সম্পর্কে জানা-অজানা বিষয় নিয়ে এমন প্রদর্শনী এ রাজ্যের কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এর আগে হয়নি।
গ্যালারিতে তথ্য সংগ্রহের মূল কাজটি করেছেন নরেন্দ্রপুর কলেজের অঙ্ক বিভাগের অধ্যাপক পার্থসারথি মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘শূন্যের আবির্ভাব নিয়ে খুব বেশি আলোচনা লক্ষ করা যায়নি। ১৮ বছর ধরে এই বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ করেছি। এখনকার গণিতশাস্ত্রে ভারতের অবদান জানানোর জন্যই মূলত এই উদ্যোগ।’’
বস্তুত, শূন্যের আকার এবং আকৃতি চিরকাল ছিল। শূন্য সম্পর্কে ধারণা বলতে যা বোঝায়, তার ইতিহাস পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি প্রাচীন। মিশরের পিরামিড থেকে শুরু করে পেরুর ইনকাদের গিঁটবাঁধা দড়ি, ব্যাবিলনীয় সভ্যতা ছুঁয়ে আরব হয়ে ইউরোপে পৌঁছেছিল ‘জ়িরো’। এখন বিশ্ব জুড়ে হিসাব-নিকাশ, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে ‘শূন্য পদ্ধতি’ অগ্রাধিকার পেয়েছে। কিন্তু শূন্যের ‘উৎস’ নিয়ে প্রচুর বিতর্ক রয়েছে। অঙ্কের অধ্যাপক পার্থের কথায়, ‘‘আমরা সেই দৌড়ে যাইনি। এই গ্যালারিতে তথ্য-সহ আলোচনা করা হয়েছে।’’ প্রসঙ্গত, জ়িরো গ্যালারি নিয়ে একটি পডকাস্ট তৈরির ভাবনাচিন্তাও করছে রামকৃষ্ণ মিশন। এর আগে একটি তথ্যচিত্রও তৈরি করা হয়েছিল। যেটি ২০২২ সালের আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয়েছে।
এখন বিশ্বের প্রায় সব দেশের সংখ্যাতন্ত্রেই ‘শূন্য’ রয়েছে। কিন্তু অঙ্কে শূন্য না থাকলে কী হত? যেমন, রোমের সংখ্যাতন্ত্রে শূন্য নেই। তাদের সংখ্যা বলতে বোঝায় I, II, III, IV, V, VI ইত্যাদি। অনেকের মতে, সেই সংখ্যা পদ্ধতিতে অঙ্ক বেশি জটিল হয়ে যায়। তুলনায় শূন্য বা দশমিক পদ্ধতিতে অঙ্ক কষা সহজ। ভারতের গণিতজ্ঞদের মতে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইউরোপ ও আমেরিকা যে উন্নতি করেছে, শূন্যের ভূমিকা ছাড়া তা সম্ভব হত না। নরেন্দ্রপুরের কলেজের ওই গ্যালারিতে দেখানো হয়েছে, শূন্যের ব্যবহার না জানার কারণে যিশুখ্রিস্টের জন্মসাল নিয়েও বিভ্রান্তি রয়েছে। ৭২৫ খ্রিস্টাব্দে বিড নামের এক সাধু ‘ক্যালেন্ডার গণনা’য় যিশুর জন্মের পূর্বে ১ খ্রিস্টাব্দের (এক এডি) আগের বছরকে ১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ (এক বিসি) বলেন। অর্থাৎ, ১-এর আগে শূন্যকে ধরা হয়নি। এমনকি, প্রথম প্রথম ইউরোপও শূন্যকে গুরুত্ব দিতে চায়নি। জ্যামিতি বিদ্যায় পারদর্শী আর্কিমিডিসকে হত্যা করেছিল রোমান সৈন্যদল।
গ্যালারির শুরুতেই রয়েছে মিশরীয় সভ্যতার কথা। সেখানকার চিত্রলিপি থেকে জানা যায়, প্রাচীন কালে তারা ‘চিহ্ন’ দিয়ে সংখ্যা বোঝাত। পরে জানা যায়, মিশরে নীল নদের বন্যা থেকে পিরামিডকে রক্ষা করার জন্য ভূমিতলকে উঁচু করা হত। সেই উচ্চ ভূমিতলে গোলাকার অংশ দেখতে পাওয়া যায়। তা থেকে অনেকে মনে করেন, মিশরীয়রা গণিতবিদ্যায় শূন্যের ব্যবহার না জানলেও তাদের স্থাপত্যশিল্পে শূন্যের ‘আকার’ ছিল। আবার গ্রিকদের মতো গণিতময় সভ্যতায় শূন্যকে সংখ্যার ‘মর্যাদা’ দেওয়া হয়নি। কারণ, গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতে, বিশ্বে সীমাহীন (শূন্য) বলে কিছু হয় না! সেই বিশ্বাস থেকে গ্রিকেরা শূন্যকে দীর্ঘ দিন স্বীকারই করেনি।
যেমন অনেক কাছে গিয়েও ‘শূন্যস্থান’ পূরণ করতে পারেনি ব্যাবিলন। সংখ্যার মাঝে ফাঁক রেখে তারা বিষয়টি বোঝাত। অর্থাৎ, ‘১০১’ লেখার ক্ষেত্রে তারা দু’টি ১-এর মাঝে ফাঁক রাখত। সংখ্যাটা যদি ‘১০০১’ হয় তবে দু’টি ১-এর মধ্যে ফাঁক বেশি থাকত। ফলে যিনি লিখছেন, তিনি ছাড়া বাকিদের ক্ষেত্রে সংখ্যা বোঝা আদৌ সহজ ছিল না। এই সমস্ত তথ্যের পাশাপাশিই নরেন্দ্রপুরের গ্যালারি জানাচ্ছে, দক্ষিণ আমেরিকার পেরু অঞ্চলের ইন্কা সভ্যতার লোকেরা এক বিশেষ ধরনের গিঁটবাঁধা দড়ি বা সুতোর মাধ্যমে সংখ্যা গণনা করতেন।
পার্থসারথি জানাচ্ছেন, শূন্যের উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখা গিয়েছে, মেক্সিকো অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল মায়া সভ্যতা। একমাত্র তারাই শূন্যকে ‘স্বাধীন’ সংখ্যার মর্যাদা দেয়। সেই শূন্যগুলি ছিল ঝিনুকের আকৃতির। তবে খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে সেই সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় শূন্যের ব্যবহার অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েনি। চিনারাও শূন্যের ব্যবহার পুরোপুরি জানত না। বৌদ্ধ পণ্ডিতদের হাত ধরে ভারত থেকে তিব্বত ও চিনে বহু প্রাচীন নথি প্রবেশ করেছে। তার মধ্যে শূন্যও ছিল বলে মনে করা হয়। কারণ, আগে চিনারা হাতির দাঁত বা বাঁশের কাঠির অবস্থান বদল করে সংখ্যার মান বোঝাত। ব্যাবলনীয়দের মতো তারাও ‘শূন্যস্থান’ পূরণ না করে ফাঁকাই রেখে দিত।
শূন্য আবিষ্কার বা শূন্যের ব্যবহারিক প্রয়োগ ভারতেই যে প্রথমে ব্যাপক ভাবে হয়েছিল, নরেন্দ্রপুর আবাসিক কলেজের গ্যালারি থেকে সেই ধারণাই মেলে। পিঙ্গলের ছন্দসূত্রে শূন্যের নানা প্রতিশব্দ ব্যবহার হয়েছে। তবে লিখিত প্রমাণের অভাবে তার সময়কাল নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। মনে করা হয়, শূন্যের কদর প্রথম বুঝেছিলেন ভারতীয়েরা। ভারত পঞ্চম শতাব্দীতে শূন্যের খোঁজ পায়। বখ্শালি পাণ্ডুলিপিতে প্রথম বার শূন্য দেখা যায়। পঞ্চম শতকে ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং গণিতবিদ আর্যভট্ট প্রথম বার শূন্য ব্যবহার করেন। সপ্তম শতকে ভারতীয়ের হাত ধরে শূন্য পায় সংখ্যার মর্যাদা। ৬০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ভারতীয় গণিত ও জ্যোতির্বিদ ব্রহ্মগুপ্ত শূন্য ব্যবহারের নিয়মকানুন বোঝান। তার পরে শূন্য আর নেহাতই প্রতীক হিসাবে থাকেনি। শূন্য দিয়ে যোগ-বিয়োগ-গুণ করা সম্ভব হয়। ভারতীয়দের সেই আবিষ্কার আরবের অধিবাসীরা ব্যাপক ভাবে ব্যবহার করতে শুরু করেন। পরে এটি যুক্ত হয় আরবি সংখ্যা পদ্ধতিতে। সেখান থেকে শূন্য প্রবেশ করে ইউরোপে। কালক্রমে ভারতের শূন্য পশ্চিমে ‘জ়িরো’তে পরিণত হয়।
অ্যারিস্টটল বিশ্বাস করতেন, শূন্য বলে কিছু হয় না। শেষমেশ তাঁর বাসস্থান সেই ইউরোপেও শূন্য জায়গা পায়। শূন্য শুধু ০ নয়! ঠিকই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy