ফাইল চিত্র।
পৃথিবীর তিন ভাগ জল, আর এক ভাগ স্থল। এ কথা কে না জানে! কিন্তু যা জানা নেই, তা হল— ভূপৃষ্ঠের ৭০ শতাংশ জুড়ে থাকা এই সামুদ্রিক জগৎ ঠিক কেমন! মানুষ চাঁদে পৌঁছে গিয়েছে, মঙ্গলের রহস্যভেদ করতে পড়শি গ্রহের মাটিতে নেমেছে রোভার। এমনকি বৃহস্পতি ও শনি গ্রহের কাছেও চলে গিয়েছে মহাকাশযান। কিন্তু পৃথিবীর গভীর সমুদ্রের তলদেশে পা পড়েনি মানুষের। নিজের ‘ঘরের’ খবরই এখনও জানা হয়নি সবটা। তাই গত কয়েক বছর ধরে অজানাকে জানতে অভিযানে নেমেছে আমেরিকান মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র নাসা।
বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, ভূপৃষ্ঠের ৭০ শতাংশ জুড়ে থাকা সমুদ্রের ৮০ শতাংশ অঞ্চলেই এখনও মানুষের পা পড়েনি। মানুষের পাঠানো কোনও যানও পৌঁছতে পারেনি পৃথিবীর সেই দুর্ভেদ্য অঞ্চলে। সমুদ্রের গভীরে এখানে সূর্যের আলো পৌঁছয় না। পরীক্ষামূলক ভাবে একটি মাছকে কিছুটা গভীরে পাঠাতেই সে প্রাণ হারায়। তা হলে এই ‘অন্ধকার জগতে’-র বাসিন্দা কারা, কেমনই বা তার জীবন! সেই রহস্য উদ্ঘাটনে গবেষণা চালাচ্ছে নাসা।
সেই সঙ্গে বিজ্ঞানীদের বক্তব্য, সৌর পরিবারের অন্য কোনও গ্রহে যদি সমুদ্র থাকে, তা হলে তা বোঝা সম্ভব নিজেদের গ্রহটিকে পরীক্ষা করলেই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিস্ময়, ভয়, ঝুঁকিতে ঘেরা এই অভিযানে সেটাই ভাঙতে চায় নাসা।
সমুদ্রের গভীরতম অংশের নাম হেডাল জ়োন। গ্রিক দেবতা হেডিসের নামে এর নাম। হেডিস মাটির নীচে থাকা অন্ধকার জগতের (আন্ডারওয়ার্ল্ড) দেবতা। নামেই স্পষ্ট, পৃথিবীর এই অংশ কতটা দুর্গম। সমুদ্রের গভীরে এই অংশে একাধিক গিরিখাত রয়েছে। সেই খাত এত গভীর যে, গোটা এভারেস্ট ধরে যাওয়ার পরেও জায়গা থাকবে। ১০,০০০ হাজার মিটারেরও বেশি গভীর। এই অঞ্চলের আয়তন অস্ট্রেলিয়ার সমান। এই গভীরতায় জলের চাপ প্রবল। ফলে কোনও মানুষের পক্ষে এখানে যাওয়া অসম্ভব। বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত, কোনও বড় প্রাণীই এখানে বাঁচতে পারবে না। তাঁদের ধারণা, একমাত্র অণুজীবীরা থাকতে পারে এখানে। কিন্তু তা-ও কী ভাবে সম্ভব, সে নিয়ে সন্দিহান গবেষক কুল।
রহস্য সমাধানে হেডাল জ়োনের এমনই এক স্থানে ‘অর্ফিউস’ নামে একটি গবেষণা-যান পাঠাচ্ছে নাসা। পৃথিবীর বুকে প্রাণের গতিবিধি ঠিক কতটা, তা জানাই উদ্দেশ্য। নাসাকে এই গবেষণায় সাহায্য করছে ম্যাসাচুসেটসের ‘উডস হোল ওশেনোগ্রাফিক ইনস্টিটিউট’। গত কয়েক বছরে হেডাল জ়োনে সমুদ্রের তলদেশে একাধিক ‘ল্যান্ডার’ নামিয়েছে সমুদ্র বিজ্ঞানীরা। এই সব ল্যান্ডারে রয়েছে সেন্সর, ক্যামেরা। এই সব যন্ত্রের সাহায্যেই এলাকার মাপজোক করা হয়েছে।
সমুদ্রের তলদেশে যাতায়াতের উপযোগী একটি বিশেষ যান তৈরি করেছেন নাসার জেট প্রোপালসন ল্যাবের ইঞ্জিনিয়াররা। এরই নাম ‘অর্ফিউস’। এটিও প্রাচীন গ্রিক উপকথার এক নায়কের নামে রাখা, যে হেডিসের রাজ্যে ঢুকে বেঁচে ফিরতে পেরেছিল। নাসার মঙ্গলযান পার্সিভিয়ারেন্স রোভারের মতো অত্যাধুনিক নেভিগেশন টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়েছে অর্ফিউসে। সেই সঙ্গে এতে রয়েছে দারুণ শক্তিশালী ক্যামেরা, যা পাথর তৈরি, শেলস বা সমুদ্রের তলদেশের প্রতিটি বৈশিষ্ট্যকে আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারে। ত্রিমাত্রিক মানচিত্র গঠনে সক্ষম যানটি। এর ফলে যে অঞ্চলে অর্ফিউস একবার যাবে, তাকে ভুলবে না। উডস হোল ওশেনোগ্রাফিক ইনস্টিটিউটের সমুদ্র বিজ্ঞানী টিম শ্যাঙ্ক বলেন, ‘‘অর্ফিউস যদি সফল হয়, তা হলে সমুদ্রের এমন কোনও জায়গা থাকবে না, যেখানে যাওয়া যাবে না।’’
তবে এই প্রথম এ ধরনের চেষ্টা করা হচ্ছে, এমন নয়। ২০১৪ সালে অর্ফিউসের পূর্বসুরি ‘নেরিয়াস’-কে পাঠানো হয়েছিল কার্মেডেক খাতে। এটি নিউজ়িল্যান্ডের উত্তর-পূর্বে সমুদ্রের তলদেশে রয়েছে। কিন্তু সমুদ্রের ১০,০০০ মিটার গভীরে পৌঁছতেই এটিতে বিস্ফোরণ ঘটে। ফেটে চৌচির হয়ে যায় নেরিয়াস। জলের অস্বাভাবিক চাপেই এমনটা ঘটে বলে মত বিজ্ঞানীদের। শ্যাঙ্ক বলেন, ‘‘নেরিয়াসকে পাঠানোর ১২ ঘণ্টা পরে দেখা যায়, ওর ছোট ছোট টুকরো জলের উপরে ভেসে উঠছে।’’ শ্যাঙ্ক জানিয়েছেন, নেরিয়াসের থেকে আকারে ছোট অর্ফিউস। ২৫০ কেজি ওজন। তৈরিতে খরচও কম। এমন ভাবেই তৈরি, যাতে একেবারে সমুদ্রের পৃষ্ঠদেশ ছুঁতে পারে, নেমে যেতে পারে সমুদ্রের নীচে থাকা গিরিখাতে। এখন শুধুই শ্যাঙ্কের আশা সত্যি হওয়ার পালা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy