বার্টন ক্রমে ‘দিশি’ হয়ে যাচ্ছেন— এই মর্মে অভিযোগ তোলা হয় সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে। তখন রিচার্ড বেশ কিছু বাঁদর পুষে তাদের ভাষা ‘রপ্ত’ করার চেষ্টা করছিলেন। এই সময়ে তাঁর বিভিন্ন ধর্মের প্রতি আগ্রহ জন্মায়। তিনি প্রথমে নাগর ব্রাহ্মণ হন, তার পর শিখ ধর্ম গ্রহণ করেন, পরে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন এবং সুফিদের কাদিরিয়া সিলসিলার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে।
ইসলামে তাঁর ব্যুৎপত্তি এমন জায়গায় পৌঁছয় যে, তিনি সম্পূর্ণ কোরান মুখস্থ বলতে পারতেন। ১৮৫৩ সালে রিচার্ড মক্কা ও মদিনা ভ্রমণের পরিকল্পনা করেন ও মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া হয়ে তিনি কায়রো পৌঁছন। সেই সময় তিনি নিজের পরিচয় দিতেন ‘মির্জা আবদুল্লাহ্ বাশরি’ হিসেবে। এক সুফি দরবেশের ছদ্মবেশে তিনি আরবের ইয়াম্বুতে পৌঁছন তার পরে ‘জাইর’ ছদ্মনামে মক্কা নগরীতে প্রবেশ করেন।
সোমালিল্যান্ড অভিযানের তিক্ত অভিজ্ঞতা মুছে ফেলে রিচার্ড আফ্রিকার এক অজানা অঞ্চলে প্রবেশের কথা ভাবেন। আফ্রিকার হ্রদ অঞ্চলকে ইউরোপীয়দের সঙ্গে পরিচয় করান তিনিই। বিপুল অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে তিনি টাঙ্গানাইকা হ্রদে পৌঁছন ১৮৫৮ সালে। অনেক কষ্ট স্বীকার করে তাঁর নেতৃত্বাধীন অভিযাত্রী দল ভিক্টোরিয়া হ্রদে পৌঁছে সেটিকে নীল নদের উৎস হিসেবে চিহ্নিত করে।
ভৌগোলিক অভিযাত্রী হিসেবে রিচার্ডের খ্যাতি আজও অমলিন। কিন্তু তার চেয়েও বেশি বিখ্যাত হয়ে রয়েছে তাঁর পাণ্ডিত্য ও লেখালেখি। বার্টনই প্রথম মিশরে থাকাকালীন সন্ধান পান আরব্য রজনীর গল্পমালার। তিনি সেগুলি সংগ্রহ করতে শুরু করেন এবং ১৭ খণ্ডে ‘দ্য বুক অব দ্য থাউজ্যান্ড অ্যান্ড ওয়ান নাইটস’ নামে তা প্রকাশিত হয় (১০খণ্ড মূল ও তার সংযোজন আরও সাত খণ্ড)।
রিচার্ড বার্টনের সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ হিসেবে ধরা হয় ‘কামসূত্র’ অনুবাদ। তিনি ইংল্যান্ডের সমাজে প্রাচ্যদেশীয় ‘ইরোটিক’ সাহিত্য আলোচনার জন্য ‘কামসূত্র সোসাইটি’ প্রবর্তন করেন। এই কাজে তাঁর সহযোগী ছিলেন ফ্রস্টার ফিৎজেরাল্ড আরবুথনট নামের এক ইংরেজ প্রাচ্যবিদ। সমকালীন আইনের চোখ এড়িয়ে এই সোসাইটির সদস্যরা নিজেদের মধ্যে প্রাচ্যদেশীয় যৌনভাবনা ও দর্শনের চর্চা চালিয়ে যান।
রিচার্ডের আরও এক উল্লেখযোগ্য কাজ হল ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’-র ইংরেজি অনুবাদ। সেই গ্রন্থ ‘বিক্রম অ্যান্ড দ্য ভ্যাম্পায়ার’ নামে প্রকাশিত হয়। এই অনুবাদ আজও পশ্চিমী বিশ্বে বিশেষ ভাবে আদৃত। সংস্কৃত ভাষাকে তিনি নিজের মাতৃভাষার মতোই জানতেন। শেষ জীবনে বার্টন কূটনৈতিক কাজে পশ্চিম আফ্রিকা সহ বহু দেশে একা থাকতেন। এই সময়েই তাঁর স্বাস্থ্যভঙ্গ ঘটে।
ইটালির ত্রিয়েস্তে বাসকালে ১৮৯০ সালে রিচার্ড হৃদরোগে প্রয়াত হন। যদিও তিনি অসংখ্য বার ধর্ম পরিবর্তন করেছিলেন, তবু স্ত্রী ইসাবেলার ইচ্ছায় রোমান ক্যাথলিক মতেই তাঁর অন্ত্যেষ্টি সম্পন্ন হয়। শেষ বয়সে বার্টন নিজেকে ‘নিরীশ্বরবাদী’ বলতেন। ইসাবেলার প্রয়াণের পর রিচার্ডের কবর স্থানান্তরিত হয়। দক্ষিণ পশ্চিম লন্ডনের মর্টলেকের এক সমাধিক্ষেত্রে তাঁদের দু’জনেরই সমাধি নির্মাণ করা হয়।
স্যর রিচার্ড বার্টনকে বিশ্বসাহিত্য বহু বিচিত্র উপায়ে মনে রেখেছে। আর্জেন্টিনার কালজয়ী সাহিত্যিক হোর্হে লুইস বোর্হেস তাঁর প্রখ্যাত গল্প ‘আলেফ’ শুরুই করেছিলেন রিচার্ড আবিষ্কৃত এক আয়নার কথা বলে, যে আয়নায় গোটা ব্রহ্মাণ্ড প্রতিফলিত হয়। বোর্হেসের এই গল্প পুরোটাই কল্পিত। কিন্তু স্যর রিচার্ড ফ্রান্সিস বার্টন যে এক অতুলনীয় ‘দার্শনিক’ ছিলেন, তারই সাক্ষ্য বহন করে এই শ্রদ্ধার্ঘ্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy