মার্গারিটা গ্রাচেভা
টেলিভিশন স্টুডিয়োর চড়া আলোর নীচে বসে দশ ঘণ্টা পার হয়ে যেত। গার্হস্থ্য হিংসার একের পর এক নৃশংস অভিজ্ঞতার কথা শুনে চলতেন তিনি। ২৮ বছরের মেয়েটির নাম মার্গারিটা গ্রাচেভা। গার্হস্থ্য হিংসা নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে রাশিয়ার একটি টিভি চ্যানেল বছর তিনেক আগে একটি অনুষ্ঠান শুরু করে। মার্গারিটা ছিলেন সেই অনুষ্ঠানের অন্যতম সঞ্চালক।
মার্গারিটাকে ওই দায়িত্বে বেছে নেওয়ার কারণ, তিনি নিজে ছিলেন নারকীয় গার্হস্থ্য হিংসার শিকার। তাঁর দু’টি হাত কুপিয়ে কেটে নিয়েছিল তাঁর প্রাক্তন স্বামী। বাঁ হাতটি জোড়া দেওয়া গেলেও ডান হাতটি চিরতরে হারান মার্গারিটা। কৃত্রিম হাত বসিয়ে দেওয়া হয় তাঁর জন্য। পশ্চিমবঙ্গের রেণু খাতুনের হাত কেটে নেওয়ার ঘটনা শুনে শিহরিত অনেকেরই নতুন করে মনে পড়ে গিয়েছে মার্গারিটার কথা। রেণু যে ভাবে অসীম মনের জোরে বাঁ হাতে কলম ধরা শুরু করেছেন, অনেকটা সেই ভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন মার্গারিটা। তাঁকে দেখে রাশিয়ার বহু মহিলা সাহস পেয়েছেন, নিজেদের কথা খুলে বলেছেন, জীবনে লড়াই করার প্রেরণা পেয়েছেন। মার্গারিটার শো ছিল রাশিয়ার টিভিতে এই জাতীয় বিষয় নিয়ে প্রথম রিয়েলিটি শো। মার্গারিটা নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছিলেন, রাশিয়ার সমাজ ও প্রশাসন, উভয় স্তরেই গার্হস্থ্য হিংসা নিয়ে সংবেদনশীলতায় অনেকখানি ঘাটতি আছে। শো-এর প্রস্তাবটা আসায় তিনি হ্যাঁ বলতে তাই দেরি করেননি। দু’বছর আগের ক্ষত তখনও দগদগে তাঁর শরীরে, মনে।
২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসের কথা। মার্গারিটার তখনকার স্বামীর নাম ছিল দিমিত্রি গ্রাচেভ। ঈর্ষা আর ক্রোধে অন্ধ হয়ে একদিন সে মার্গারিটাকে গাড়িতে চাপিয়ে টেনে নিয়ে যায় সেন্ট পিটার্সবার্গের বাড়ি থেকে বেশ খানিক দূরে একটা বনের মধ্যে। তার পর ঝাঁপিয়ে পড়ে কুড়ুল নিয়ে। কুড়ুলের ৪০টি কোপের আঘাত বহন করেছিল মার্গারিটার শরীর। ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল দু’টি হাত। বরফের উপরে পড়েছিল বলে একটি হাত পরে তুলে নিয়ে জোড়া দেওয়া সম্ভব হয়। মার্গারিটার অভিযোগ, এটা কোনও আকস্মিক ঘটনা ছিল না। দিমিত্রি তার আগেও বেশ কয়েক বার তাঁকে ছুরি নিয়ে শাসিয়েছে। দুই সন্তানের মা মার্গারিটা পুলিশকে জানিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু লাভ হয়নি। পুলিশের বাঁধা বুলি ছিল, সত্যি সত্যি তো আর ছুরি মারেনি দিমিত্রি! দু’টি হাত ছিন্ন করে সেই নিষ্ক্রিয়তার দাম দিতে হয়েছিল মার্গারিটাকে। দিমিত্রির জেল হয় ১৪ বছরের জন্য।
রাশিয়ার আইন ব্যবস্থায় বড় রকমের শারীরিক ক্ষতি না হওয়া ইস্তক গার্হস্থ্য হিংসাকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হয় না। যে সব স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এই সব বিষয় নিয়ে কাজ করে, তাদের অহরহ ‘পশ্চিমি চর’ হিসেবে দেখা হয়। মার্গারিটার শো-এ এসে এলেনা ভার্বার মা যেমন জানিয়েছিলেন, এলেনা অনেকবার তাঁর পুলিশ স্বামীর ঊর্ধ্বতনদের কাছে গিয়ে তাঁর দুর্দশার কথা বলেছিলেন। স্বামীর পেনশন আটকে যাবে বলে তাঁরা কেউ বিষয়টা নিয়ে এগোতে চাননি। মানিয়ে নেওয়ার পরামর্শই দিয়েছিলেন। ফল? একদিন স্বামী এলেনাকে ৫৭ বার কুপিয়ে কাজে বেরিয়ে গেল। মৃত এলেনা রক্তে ভেসে গেলেন। আবার মার্গারিটার শো-তেই এসেই আর একটি মেয়ে মনে জোর আনলেন। তাঁকে বারবার খুন করার হুমকি দিচ্ছিল স্বামী। শো-এ এসে আইনজীবী, কাউন্সেলর সকলের সঙ্গে কথা বলে সাহস জোটালেন মেয়েটি। সন্তানকে নিয়ে ঘর ছেড়ে মহিলা আশ্রমে গিয়ে উঠলেন।
মার্গারিটা এটাই চেয়েছিলেন। দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে সুখে ঘর করা শুধু নয়। জীবনের একটা অন্য মানে খুঁজতে চেয়েছিলেন। টিভি শো তাঁকে সেই রাস্তা দিয়েছিল আর তাঁকে কেন্দ্রে রেখে আরও অনেককে চলার পথ দেখিয়েছিল। মার্গারিটা গ্রাচেভা থেকে রেণু খাতুন, লড়াই চলছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy