অলঙ্করণ: শৌভিক দেবনাথ
করোনাভাইরাসকে গুরুত্ব না দেওয়ার ফল ভুগতে হবে— এমন সাবধানবাণী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বহুবার দিয়েছেন আমেরিকার বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের সতর্কবার্তা ছিল মূলত আমেরিকাবাসীর স্বাস্থ্যের কথা ভেবে। কিন্তু রাজনৈতিক ভাবেও যে তার এমন মাসুল দিতে হবে রিপাবলিকানদের, তা হয়তো ভাবেননি ট্রাম্প নিজেও। আমেরিকার ভোট পর্যবেক্ষকদের সিংহভাগ মোটামুটি এক মত, অন্য অনেক কারণের সঙ্গে ট্রাম্পের ভোটবাক্সেও কোভিড ‘সংক্রমণ’।
আর সাত সমুদ্র তেরো নদী পারে আমাদের দেশে নীতীশ কুমারের ক্ষেত্রেও কি একই কথা বলা চলে? অধিকাংশ ভোট পরবর্তী সমীক্ষায় কিন্তু নীতীশ কুমার, তথা এনডিএ জোটের হারের পূর্বাভাস। ভোট পরবর্তী সমীক্ষা সব সময় মিলে যায় এমন নয়, কিন্তু প্রায় সব সমীক্ষাতেই নীতীশের পিছিয়ে পড়ার ইঙ্গিতে অশনি সঙ্কেত দেখছে জেডিইউ-বিজেপির জোট। চূড়ান্ত ফল ১০ নভেম্বর। কিন্তু তার আগেই সমীক্ষার এই ফল বিশ্লেষণে বসে অনেকেই কিন্তু মনে করছেন, এনডিএ জোটের অন্যতম ‘ঘাতক’ হয়ে উঠতে পারে করোনাভাইরাস।
কেন? একটি সংবাদ মাধ্যমে সাক্ষাৎকারে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘করোনা অতিমারির সময় জেডিইউ এবং মোদী সরকার কী কাজ করেছে, বিহারের ভোটাররা তা ভুলে যাননি।’’ নীতীশ সদর্থক অর্থে বললেও সেটাই কিন্তু আজ ‘আয়রনি’র মতো মনে হচ্ছে অনেকের। নীতীশ ওই সাক্ষাৎকারে দাবি করেছিলেন, রাজ্যে প্রতিদিন জাতীয় গড়ের চেয়ে বেশি কোভিড টেস্ট হচ্ছে বিহারে। ‘পজিটিভিটি রেট’ বা সংক্রমণের হার মোটামুটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। সুস্থতার হার প্রায় ৯৬ শতাংশ। এ ছাড়া লকডাউনে কাজ হারানো শ্রমিকদের ১০০০ টাকা করে আর্থিক সাহায্য় দিয়েছে রাজ্য সরকার। বিনামূল্যে চাল-ডাল দেওয়া হয়েছে তাঁদের। বন্দোবস্ত করা হয়েছে কর্মসংস্থানের।
কিন্তু তার আগে? বিহারের ভোটাররা সত্যি ভুলে যাননি মোদীর জনতা কার্ফু, নোটবন্দির মতো ২১ দিনের সময় নিয়ে ৭৮ দিন লকডাউন, কার্যত কোনও পরিকল্পনা না করে আচমকা লকডাউন ঘোষণা, তালি-থালি বাজিয়ে ‘করোনা বিতাড়ন’-এর দাওয়াইয়ের মতো হুজুগে আবেগের বহিপ্রকাশ। অথচ লকডাউনে মাইলের পর মাইল হেঁটে ঘরমুখী পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে কি নির্মম উদাসীনতা। পরে আবার ফাঁস হয়েছে, ওই সময় কত শ্রমিকের মৃ্ত্যু হয়েছে, তার হিসেবই নেই কেন্দ্রের কাছে।
বিহারবাসী ভোলেননি, লকডাউনের সময় আটকে পড়া পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরাতে যে মুখ্যমন্ত্রী সবচেয়ে বেশি বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁর নাম নীতীশ কুমার। এমনকি, পশ্চিমবঙ্গ-সহ অন্যান্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা নিজেদের রাজ্যের শ্রমিকদের বাসে করে ফেরানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরেও নীতীশ তাঁর রাজ্য বিহারের মধ্যে দিয়ে প্রথম দিকে পরিযায়ী শ্রমিকদের বাস পর্যন্ত চালাতে দিতে রাজি ছিলেন না। মাথায় রাখতে হবে দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিযায়ী শ্রমিক কিন্তু বিহার রাজ্যে। লকডাউনে আটকে পড়া শ্রমিকদের সংখ্যাও ছিল বিহারেরই সবচেয়ে বেশি।
এই ছবির প্রতিফলন কি বিহারের ভোটবাক্সে পড়েছে? উত্তর মিলবে ১০ নভেম্বর।
ভোট পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বিহারের ভোটবাক্সে তার প্রভাব পড়েছে অবধারিত ভাবেই। দু’দিন পর ফল ঘোষণায় ভোট পরবর্তী সমীক্ষার ফল মিলে গেলে কিন্তু বলা যেতেই পারে, নীতীশের ভোটবাক্সও ‘করোনা পজিটিভ’।
আরও পড়ুন: এইচওয়ান-বি এবং অন্যান্য় ভিসা বৃদ্ধির সম্ভাবনা উজ্জ্বল হতে পারে বাইডেন জমানায়
আমেরিকার প্রসঙ্গে আসা যাক। চিনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি, উদ্বাস্তু আটকাতে সীমান্ত সুরক্ষিত করা, এইচওয়ানবি ভিসা স্থগিত করে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্তে ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকানদের বিরাগভাজন হওয়ার মতো ইস্যু ছিল। কিন্তু সে সব ছাপিয়ে কার্যত করোনাভাইরাসই হয়ে উঠেছে নির্বাচনের সবচেয়ে বড় ইস্যু। সেই ইস্যুই কার্যত ট্রাম্পের জয়ের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে ট্রাম্পের। ওয়াশিংটনে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং ভোট বিশ্লেষক জো গার্সটেনসন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম বিবিসিকে বলেছেন, ‘‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে ভাবে করোনাভাইরাসের মোকাবিলা করছেন, অধিকাংশ আমেরিকার নাগরিক তাতে খুশী নন।’’
অধ্যাপক গার্সটেনসনের মতে, “শুধু যে দলীয় সমর্থনের প্রশ্নে মতামতে ভিন্নতা রয়েছে তাই নয়, এলাকা ভিত্তিতেও জনমতের পার্থক্য দেখা গিয়েছে। যে এলাকার মানুষ কোভিডে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন বা অতিমারির কারণে ক্ষতি বেশি হয়েছে, সেখানকার মানুষ বেশি ক্ষিপ্ত হয়েছেন ট্রাম্পের উপর।’’
আরও পড়ুন: ভারতীয় মায়ের কৃষ্ণাঙ্গ মেয়ে হোয়াইট হাউসে, ইতিহাসে ঢুকলেন কমলা হ্যারিস
উইসকনসিনের কথাই ধরা যাক। এই রাজ্যটি বরাবরই রিপাবলিকানদের ঘাঁটি। এ বছরের গোড়ার দিকেও সেখানে ট্রাম্পের সমর্থন ছিল নজরকাড়া। কিন্তু অক্টোবরে সেখানে সংক্রমণ লাগামছাড়া মাত্রায় বাড়তে থাকায় ট্রাম্পের জনমতে শুধু ভাটা পড়েনি, পুরোপুরি ঘুরে গিয়েছে। ভোটের কিছু দিন আগেই সর্বশেষ জনমত সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে এই রাজ্যে বাইডেনের জনপ্রিয়তায় ট্রাম্পের চেয়ে ১৭ শতাংশে এগিয়ে বাইডেন। ফল, রিপাবলিকানদের কাছ থেকে উইসকনসিন ছিনিয়ে নিয়ে জিতেছেন বাইডেন। আমেরিকার ভোট পদ্ধতিতে ১০টি ইলেক্টোরাল কলেজের ভোট থাকা একটি রাজ্যের ফলাফল বিপক্ষে গেলে সামগ্রিক চিত্রটা কী ভাবে পাল্টে যেতে পারে, তার ফল বুঝতে পারছেন ট্রাম্প। কারণ ১০টি ভোট হাতছাড়া হওয়ার অর্থ আসলে মোট সংখ্যায় ২০ পিছিয়ে পড়া।
অতিমারির কারণে যেখানে ক্ষতি বেশি হয়েছে, সেখানকার মানুষ বেশি ক্ষিপ্ত হয়েছেন ট্রাম্পের উপর।
ট্রাম্পের ভাইরাসকে গুরুত্ব না দেওয়া এবং তার জেরে ভোটে প্রতিকূল পরিস্থিতির তত্ত্ব খারিজ করতে পারেননি আমেরিকার নাগরিকরাও। ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকার নাগরিক বাঙালি পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায় দীর্ঘদিন ধরে ডিজিটাল ট্র্যান্সফরমেশন এবং টেকনোলজি স্ট্র্যাটেজি নিয়ে গবেষণার সঙ্গে যুক্ত। ‘হাউ ডি মোদী’ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনার বড় দায়িত্বেও ছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘মাস্ক পরব না, বিজ্ঞানীদের কথা শুনব না, এটা ট্রাম্পের বিপক্ষে গিয়েছে, এ কথা বলাই যায়। নিজে না পরা এক রকম, কিন্তু তাতে জনগণকেও উদ্বুদ্ধ করা তাঁর পক্ষে জয়ের রাস্তা কঠিন করে দিয়েছে।’’ আমেরিকা প্রবাসী আর এক বাঙালি বাবলি চক্রবর্তীর মতে ট্রাম্পের হারের সবচেয়ে বড় কারণই করোনা। তিনি বলেন, ‘‘শুধু যে গুরুত্ব দেননি তাই নয়, রীতমতো অস্বীকার করেছেন এবং মিথ্যে কথা বলে গিয়েছেন। আমি স্কুলে কাজ করি। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই আমাদের জানানো হয়েছিল, ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। চিন বা এশিয়ার দেশ থেকে যাঁরা আসছেন, তাঁদের পরীক্ষা করে ঢোকাতে হবে। অথচ উনি (ট্রাম্প) লকডাউন ঘোষণা করেছেন মার্চে। আমরা মাস্ক পরেছি বলে অনেকে আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করেছেন। তাই আমার মনে হয়, ট্রাম্পের হারের সবচেয়ে বড় কারণ কোভিড।’’ ভোটের সময় আমেরিকার নাগরিকদের নিয়ে আমেরিকার জনগণের মতামত নিয়েছিল বিবিসি। সেখানেও সিংহভাগের মত, কোভিড ইস্যু ঠিক মতো সামলাতে পারেননি ট্রাম্প।
কিন্তু ভোটপর্বের গোড়া থেকেই কি এমন পরিস্থিতি ছিল? আমেরিকার বিভিন্ন ভোট পূর্ববর্তী জনমত সমীক্ষা কিন্তু তেমনটা বলছে না। রিপাবলিকানদের দখলে থাকা রাজ্যগুলিতে ট্রাম্পের পক্ষে বিপুল জনসমর্থন ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রকোপ যত বেড়েছে, জনমত কমতে শুরু করেছে ট্রাম্পের পক্ষে।
করোনাভাইরাসের প্রকোপ যত বেড়েছে, জনমত ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যেতে শুরু করেছিল।
উহান থেকে সারা বিশ্বে কোভিড-১৯ ভাইরাস গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার কিছু দিনের মধ্যেই মোট আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যায় শীর্ষে আমেরিকা। জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসেব অনুযায়ী রবিবার পর্যন্ত সে দেশে মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৯৮ লক্ষ ৮৭ হাজারেরও বেশি। প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছেন ৮০ হাজারের বেশি মানুষ। আক্রান্তের সংখ্যা কোটিতে পৌঁছনো এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। মৃত্যু হয়েছে প্রায় ২ লক্ষ ৩৭ হাজার মানুষের।
তবু ভাইরাসকে পাত্তাই দেননি ট্রাম্প। মাস্কে তাঁর বরাবরের অনীহা। দেশের স্বাস্থ্য বা চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মানেননি। নিজে কোভিডের বিধিনিষেধ মানেননি, দেশের নাগরিকদেরও সেই পথে চালিত করার চেষ্টা করেছেন। মাসখানেকের লকডাউনের পরেই বলেছেন, ভাইরাসের জন্য অর্থনীতি থমকে থাকতে পারে না। ভোটের ৩২ দিন আগে নিজে করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন। কিন্তু ৭৪ বছর বয়সেও তাতে থোড়াই কেয়ার!হাসপাতালে ভর্তি থেকেছেন দু’-তিন দিন। জনসমক্ষে এসে টান মেরে খুলে ফেলেছেন মাস্ক। বন্ধ করে দিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-এর অনুদান। এই সব কিছুই তাঁর বিপক্ষে গিয়েছে বলে মনে করছেন ভোট বিশ্লেষকরা।
উল্টো দিকে ডেমোক্র্যাট শিবির কিন্তু তাকেই হাতিয়ার করেছে গোড়া থেকে। প্রাক্তন ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার একটি কেবল ফাঁস হয়েছিল গত মে মাসে। নিজে প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন তাঁর সময়ের আমলাদের সঙ্গে কথোপকথনের সেই কেবল বার্তায় ওবামার বক্তব্য ছিল, বর্তমান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প করোনার সংক্রমণ রুখতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। অতিমারিকে ‘বিশৃঙ্খল বিপর্যয়’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, এর জন্য দায়ী ভাইরাস নিয়ে ট্রাম্পের উদাসীনতা, গুরুত্ব না দেওয়া। সেই বিশৃঙ্খলা বন্ধ করতে এবং অতিমারির মোকাবিলায় বাইডেনকে সমর্থনের আর্জি জানান আমলাদের কাছে। বাইডেন নিজেও প্রায় প্রতিটি প্রচার সভায় ট্রাম্পের ব্যর্থতা এবং উদাসীনতা তুলে ধরে আক্রমণ করেছেন। কোভিডে মৃত্যু সোশ্যাল মিডিয়ায় কটাক্ষ ছুড়ে দিয়ে বলেছেন, ‘আমেরিকাবাসী, আপনারা দেখছেন প্রায় প্রতিদিন বহু মানুষের প্রাতরাশের টেবিলে পরিবারের এক জন সদস্য কমে যাচ্ছে।’ আবার ভোটের ফলাফল মোটামুটি স্পষ্ট হতেই তিনি ঘোষণা করেছেন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়ে তাঁর প্রথম কাজই হবে করোনার সংক্রমম নিয়ন্ত্রণ।
এ বার আমেরিকার ভোটে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন রেকর্ড সংখ্যক ‘আর্লি ভোটিং’। সেখান থেকেই অনেকে বাইডেনের জয়ের পূর্বাভাস পেয়েছিলেন। কারণ, ট্রাম্পের উল্টো পথে হেঁটে করোনার ভয়াবহতা বুঝিয়ে মানুষকে বুথে না গিয়ে আর্লি ভোটিংয়ে উৎসাহ দিয়ে গিয়েছেন ডেমোক্র্যাটরা। বিপুল সংখ্যক এই আর্লি ভোটিংয়ের সিংহভাগই যে বাইডেনের পক্ষে গিয়েছে, ভোটের ফলের পর সেটা কার্যত জলের মতো স্পষ্ট বলেই মনে করছেন ভোট বিশ্লেষকরা।
অর্থাৎ দেশ, রাষ্ট্রনেতা আলাদা হলেও ভাইরাসের নাম এক, ফল এক। ব্যালট হোক বা ইভিএম— ‘সংক্রমণ’-এ কার্যত কোনও পার্থক্য নেই। ট্রাম্পের ক্ষেত্রে কার্যত প্রমাণিত। ১০ নভেম্বরের পর মিলে যেতে পারে নীতীশের ক্ষেত্রেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy