কলকাতার দিনগুলি। ’৮৬-র নভেম্বর। আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।
এই ভণ্ড দুনিয়ার উদ্দেশে শেষ বারের মতো জিভ কেটে জার্মানির লিউবেক শহরের হাসপাতালে ৮৭ বছর বয়সে মারা গেলেন গুন্টার গ্রাস। সোমবার ভোরে।
বাস্তবে সত্যিই কি জিভ কাটার ক্ষমতা ছিল? দেড় বছর আগে তাঁর বেহেলেনড্রফ গ্রামের বাড়িতে গিয়ে গৌতম ঘোষ ও শুভাপ্রসন্ন এক তথ্যচিত্র তৈরি করেন। গুন্টার গ্রাস কথা বলেন, ক্যামেরার সামনে ছবিও আঁকেন, কিন্তু মুখে নেবুলাইজার। মৃত্যুর কারণ জানা যায়নি। কিন্তু ‘টিনড্রাম’-এর নোবেলজয়ী লেখক যে শেষ কয়েক বছর শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন, সেটা কলকাতার অজানা ছিল না। ওই তথ্যচিত্রই কলকাতা আর গ্রাসের মধ্যে শেষ সংযোগ।
কিন্তু গুন্টার গ্রাস তো এই শহরের কাছে নিছক তথ্যচিত্রের চরিত্র নন। অন্য কোনও বিদেশি লেখকের সঙ্গে ঘৃণা ও ভালবাসায় ভরা এতটা প্যাশনের সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি কলকাতার। মার্ক টোয়েন এ শহরে হোটেলবাসিন্দা পর্যটক, অ্যালেন গিন্সবার্গ ও তাঁর সঙ্গীসাথীরা নিমতলায় গাঁজা খেয়ে, ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ লিখে কাঠমান্ডু পাড়ি দিয়েছেন। আর গুন্টার গ্রাস ফিরে এসেছেন বারংবার।
কখনও থাকছেন রাজভবনের অতিথিশালায়, কখনও (’৮৬ সালে) বারুইপুরের এক বাগানবাড়িতে। ঘুরে বেড়াচ্ছেন কফি হাউস, কালীঘাট আর বালিগঞ্জ স্টেশনের ফুটপাথে। ব্যোমকালী কলকাত্তাওয়ালিকে বিদেশিরা সচরাচর খেয়াল করেন না। কিন্তু গুন্টার গ্রাস চিনতে চেয়েছিলেন রক্তলোলুপ, মুণ্ডমালিনী সেই দেবীকেই। নইলে সাত মাস কলকাতায় থেকে সেই ছবি, ডায়েরি নিয়ে লেখা হতে পারে ‘ত্সুঙ্গে সাইগেন?’
‘জিভ কাটো লজ্জায়’ নামে সে বইয়ের একটি জনপ্রিয় বাংলা অনুবাদ হয়েছিল। যদিও গুন্টার গ্রাসের সে সময়ের সঙ্গী শুভরঞ্জন দাশগুপ্তের মতে, ‘নামটা ভুল। ত্সুঙ্গে সাইগেন মানে জিভ দেখাও।’ কৃত্রিম প্রসাধনীরঞ্জিত ওষ্ঠ নয়, এই শহরের আলজিভ, থুতু ও রক্তকোষসমন্বিত জিভটিই গ্রাস বারংবার আবিষ্কার করতে চেয়েছেন। নইলে কি কলকাতাবাসের পর আদৌ লিখতে পারতেন: ‘কালীপুজো আসছে। দেওয়ালের ধারে মাথা নিচু করা, নর্দমার জলে ভর্তি তিন হাজার বস্তি। তাদের পাশে শুধু রাত্রি আর তাদের ভয়ঙ্কর হাঁ মুখে জিভ বের করা ওই দেবী। তিনি আলটাগরায় শব্দ করছেন। আমি জিভ দেখালাম, নদী পেরিয়ে গেলাম, সীমান্ত মুছে দিলাম।’
এই দেখাটাই গ্রাসকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে দিয়েছে। ডমিনিক লাপিয়েরের মতো দরিদ্র রিকশাওয়ালার পিঠ চাপড়ে আবেগাপ্লুত ‘সিটি অব জয়’ লিখতে চাননি তিনি। বরং কলকাতা নিয়ে গ্রাসের প্রথম মন্তব্যটিই সাংঘাতিক: ‘ঈশ্বরের ছুড়ে দেওয়া এক তাল বিষ্ঠা। সাঁতরাচ্ছে, দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, আয়তনে বাড়ছে। ওই শহরটাকে সমস্ত গাইডবই থেকে উড়িয়ে দেওয়া হোক।’ ‘দ্য ফ্লাউন্ডার (১৯৭৭)’ উপন্যাসে লিখছেন তিনি। তার দু’বছর আগেই কলকাতায় তাঁর প্রথম পদার্পণ। নোবেল পুরস্কারের পরে গ্রাস অবশ্য অনেক বার বলেছেন, শহরটাকে আমি ভালবাসি বলেই এ সব লিখি।
চল্লিশ বছরের এই ভালবাসা নিছক মন রাখার প্রতিশ্রুতি নয়। কলকাতা তাঁর কাছে দান্তে বা র্যাঁবোর নরকের মতো। যন্ত্রণা, তবু প্রেরণা। তবু জাতীয়তাবাদী কিছু বাঙালি গ্রাস-এর ওপর রেগে গিয়েছিলেন। তাঁরা খেয়াল করেননি গ্রাস ফ্রাঙ্কফুর্টকেও ‘পাইলস অব কংক্রিট শিট’ লিখেছিলেন। বিশ্বশান্তিতে নোবেলজয়ী জার্মান চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্টের যিনি অন্যতম সহযোগী, তাঁর বক্তৃতাও লিখে দেন, সেই লেখককে গড়পড়তা বাঙালি জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিতে বোঝা শক্ত।
‘দ্য ফ্লাউন্ডারে’র পর ফের কলকাতা আগমন ’৮৬ সালে। বারুইপুরে থাকেন, লোকাল ট্রেনে বাদুড়ঝোলা ভিড়ে, ঘামের গন্ধে বালিগঞ্জ স্টেশনে আসেন। ‘ডয়েশ ব্যাঙ্কের কাচঘেরা ঔদ্ধত্যের পাশে যে বস্তি, সেটিই ভবিষ্যতের প্রতীক’ ডায়েরিতে লিখে রাখেন। কফি হাউসে আড্ডা মারেন, বাংলাদেশি কবির জার্মান ভিসার জন্য চেষ্টা করেন, জঞ্জাল কুড়ানিদের সঙ্গে মেশেন। ‘ৎসুঙ্গে সাইগেন’ বইটি কল্যাণী কার্লেকরদের ‘ক্যালকাটা সোশাল প্রোজেক্ট’কে উৎসর্গীকৃত। জঞ্জাল-কুড়ানো ও বস্তির শিশুদের লেখাপড়া শেখায় তারা। কয়েক বছর আগেও তাদের জন্য চেক পাঠিয়েছিলেন লেখক। মানুষ এত দুর্দশায় কী ভাবে বেঁচে থাকে, কী ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, সেটাই তো এই শহরে বারংবার দেখতে চেয়েছেন তিনি।
কলকাতার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কেবল বই লেখার ছিল না। গৌতম ঘোষের ‘পার’ ছবি যে বার ফ্রাঙ্কফুর্ট উৎসবে পুরস্কৃত হল, জুরি বোর্ডের অন্যতম সদস্য ছিলেন গুন্টার গ্রাস। বছর দশেক আগে সল্টলেকের এক বাড়ির পার্টিতে মৃণাল সেনকে দেখে এগিয়ে এসেছিলেন, ‘কেমন আছেন? ভাল তো? পরের ছবি কী নিয়ে?’ চেয়ে নিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় মিষ্টি দই। তারও আগে আটের দশকে দমদমের অন্ধকার এক মাঠে অরুণ মিত্র, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কবিতা পাঠেও মেতেছিলেন। তাঁর নিজের লেখা ‘প্লেবিয়ান’ নাটক বাংলায় মঞ্চস্থ করতে সাহায্য করেছেন গ্রুপ থিয়েটারকে। সুভাষচন্দ্র বসু নিয়ে এত উৎসাহিত যে ‘কল অব দ্য টোড’ উপন্যাসে সুভাষচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নামে এক চরিত্র পোলান্ডে আসে, বাংলাদেশ থেকে সাইকেল রিকশা আমদানি করে পোলান্ডের দূষণ দূর করে। একই ভাষায় কথা বলা বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গের বিভাজন কি তাঁকে টেনেছিল? বারংবার বলেছেন, ‘কলকাতা অতীতের যন্ত্রণা বহন করে। তার কথা লিখতে পারবেন এই শহরের কোনও জেম্স জয়েস বা আলফ্রেড ডবলিন।’ কিন্তু নিজের দেশের প্রসঙ্গে আদৌ ভেবেছেন ডবলিনের ‘বার্লিন আলেকজান্দারপ্লাত্স’ উপন্যাসের কথা? তা হলে কেনই বা বার্লিন প্রাচীর ভাঙার পর দুই জার্মানির সংযুক্তিকরণের বিরোধিতায় নামলেন? কলকাতার গ্রাস অন্য রকম, ইউরোপের বিতর্কিত লেখকের সঙ্গে তাঁকে মেলালে চলবে না।
কলকাতা তাই শুধু নোবেলজয়ী লেখককে দেখেনি, দেখেছে ‘টিনড্রাম’ উপন্যাসের নায়ক অস্কার ম্যাজারেথকে। অস্কার ড্রাম বাজায়, গির্জার কাচ থেকে সবই ঝনঝনিয়ে ভেঙে পড়ে। ২০০৫ সালে গুন্টার এ শহরে এসেছেন, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য একদা তাঁর একটি কবিতার অনুবাদ করেছিলেন। লেখক ও সাহিত্যপ্রেমী মন্ত্রীর দেখা। গুন্টার বললেন, ‘কমিউনিস্টদের পছন্দ করি না, জার্মান আইনসভা রাইখস্ট্যাগ পুড়িয়ে দিয়েছিল।’ বুদ্ধদেববাবু হাসতে হাসতে, ‘সোশাল ডেমোক্র্যাটদেরও আমরা পছন্দ করি না। ওরা হাত না মেলালে নাৎসিরা এই কাজ করে কমিউনিস্টদের ঘাড়ে দোষ চাপাতে পারত না।’ দু’জনেরই পরস্পরকে পছন্দ হয়েছিল। গুন্টার গ্রাস ভেবেছিলেন, প্রথা ভেঙে বুদ্ধবাবু বাংলার জন্য কিছু করতে চান। আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের গির্জার কাচ নির্ঘাত ঝনঝনিয়ে ভাঙছে।
এই বঙ্গে ভাঙেনি কিছুই। কিন্তু জীবনের এক দমচাপা অস্বস্তি ভেঙেছিলেন গ্রাস নিজে। কয়েক বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে সরাসরি জানালেন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় কিশোর বয়সে তিনি নাৎসিদের কুখ্যাত ‘ওয়াফেন এসএস’ বাহিনীর সদস্য ছিলেন। ‘‘তারুণ্যের ঔদ্ধত্যে যাকে বরণ করেছিলাম, পরে তাকে লজ্জায় লুকোতে চেয়েছি। কিন্তু ভার কমেনি, তাই আজ স্বীকার করলাম।’’ যে গুন্টার গ্রাস বরাবর নাৎসিবাদের বিরোধিতা করে এসেছেন, তিনি নাম লিখিয়েছিলেন ইহুদি খতম করার ওই দলে? গ্রাস, তুমিও! ইউরোপ ক্ষুব্ধ, কিন্তু কলকাতা নীরব। স্বদেশি যুগ থেকে গোপন পাপের বোঝা বয়ে ক্লান্ত এই শহর চায়নি সুদূর ইতিহাসের রণক্লান্ত দিনগুলি ঘাঁটাঘাঁটি করতে।
ঘেঁটে কী হবে? আটের দশকে শুভাপ্রসন্নের ‘আর্টস একর’ উদ্বোধন। রাজারহাটে আজকের সারদা-ইডি-সিবিআই-আক্রান্ত শিল্পকেন্দ্র নয়। অনেক ছোট মাপের এক বাড়ি। গুন্টার গ্রাস নিজেও ছবি আঁকতেন। ভাস্কর্য গড়তেন। সে দিন বলেছিলেন, ‘‘এই জায়গাটা হোক তারুণ্যের জন্য, শিল্পের জন্য। নিছক গজদন্তমিনার হয়ে যেন না থাকে।’’
এর পরও কলকাতা তাঁকে ভুলতে পারে? গ্রাস জানতেন, এই পৃথিবী লোভের, এই পৃথিবী পণ্যরতির। প্রথম সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘টিন ড্রাম’-এর শুরুতেই তাই হাসতে হাসতে বাইবেলকে বদলে দিয়েছিলেন, ‘‘গড সেড, লেট দেয়ার বি লাইট! তার পরই দুনিয়ায় এল ফিলিপ্স!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy