গ্রাফিক- সনৎ সিংহ।
কাবুল দখলের পর নয় নয় করে কেটে গেল প্রায় সপ্তাহ তিনেক। এখনও সরকার গড়ে উঠতে পারেনি তালিবান। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে খবর, শেষমেশ হয়তো শুক্রবারই নতুন সরকার গড়ার ঘোষণা করবে তালিবরা। অন্য একটি সূত্র বলছে, শুক্রবার না হলে হয়তো আর দু’-এক দিনের মধ্যেই সরকার গঠন করতে পারে তারা। তবে, সরকার গড়লেও গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না আফগান-ভূমে। শুক্রবারও পঞ্জশির উপত্যকায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে।
আফগানিস্তান বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তুলছেন, দু’দশক পর ক্ষমতায় ফিরে সরকার গড়তে কেন এত দেরি হচ্ছে তালিবানের? তাঁদের আরও সন্দেহ, সরকার গড়লেও কি তালিবরা আফগানিস্তানে তাদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারবে? গৃহযুদ্ধ-দীর্ণ আগানিস্তানে শান্তি ফিরবে?
আফগানিস্তানের ইতিহাসই বলছে এই প্রশ্ন, এই সংশয় অমূলক নয়। ১৩-১৪টি জাতিগোষ্ঠী রয়েছে আফগান মুলুকে। যার মধ্যে পাশতুন, তাজিক, হাজারা, উজবেক, তুর্কমেনি ও বালুচি-সহ এমন অন্তত ৬-৭টি জাতিগোষ্ঠী রয়েছে, যারা সব সময়েই থেকেছে আফগান রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে। এরা যেমন আফগানিস্তানে সোভিয়েত জমানাতেও নিজেদের ওজন ধরে রেখেছিল, তেমনই নিজেদের জায়গা বুঝে নিয়েছিল ২০০১ সালের পর থেকে আমেরিকার হাতে চলে যাওয়া আফগান মুলুকেও। বিভিন্ন প্রদেশে অন্তত কয়েক জন ওয়ার লর্ড বা যুদ্ধপতীর জন্যই এই জাতিগোষ্ঠীগুলি নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পেরেছে। তাই ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত তালিবরা গোটা আফগানিস্তানে দাপিয়ে বেড়ালেও তাজিক অধ্যুষিত পঞ্চশির উপত্যকার মাথা নোওয়াতে পারেনি।
তালিবদের এ বারের সরকার যে দিনই গঠিত হোক, তা নিরঙ্কুশ আধিপত্য কায়েম করতে পারবে কি না তা খতিয়ে দেখা যাক।
তালিবরা মূলত যে জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে, সেই পাশতুন-রাই আফগানিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ। মোট জনসংখ্যার (প্রায় ৪ কোটি) ৪২ শতাংশ। কিন্তু সেই পাশতুনরাও যে সার্বিক ভাবে তালিবদের পাশে থেকেছে বরাবর, এমন নয়। যাঁকে হটিয়ে তালিবরা এ বার কাবুলের ক্ষমতা দখল করল, সেই পূর্বতন প্রেসিডেন্ট আশরফ গনি ও তাঁর পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইও পাশতুন জাতিগোষ্ঠীরই নেতা। সুন্নি হলেও মূলত দক্ষিণ ও পূর্ব আফগানিস্তানে প্রভাব খুব বেশি থাকা পাশতুনদেরও পুরোপুরি তাদের পাশে পাওয়ার আশা করে না তালিবরাও। তার কারণ, গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের মতো জনাকয়েক পাশতুন যুদ্ধপতী। যাঁরা তালিবদের কাছে মাথা নুইয়ে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ক্ষুণ্ণ হতে দিতে চাইবেন না।
এর পরেই রয়েছে তাজিক ও হাজারা জাতিগোষ্ঠী। আফগান মুলুকের মোট জনসংখ্যার ২৬-২৭ শতাংশ তাজিক আর ১০ শতাংশ হাজারা জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। এই দুই জাতিগোষ্ঠীই কখনও তালিবদের কাছে মাথা নোওয়ায়নি। পঞ্জশির উপত্যকা-সহ গোটা উত্তর আফগানিস্তান, বাদাকশান ও আফগান মুলুকের পশ্চিম দিকের একটি বড় অংশ রয়েছে তাজিকদের নিয়ন্ত্রণে। এরাই তালিবদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য নয়ের দশকে নর্দার্ন অ্যালায়েন্স বা উত্তরের জোট গড়ে তোলে। ১৯৯৬ সালে তাজিক নেতা প্রেসিডেন্ট বুরহাউদ্দিন রব্বানিকে সরিয়ে প্রথম ক্ষমতায় এসেছিল তালিবরা। এখন আহমেদ মাসুদের মতো তাজিক নেতা তালিবদের সবচেয়ে বড় শত্রু।
আর হাজারা জাতিগোষ্ঠীর মানুষের উপর আগের জমানায় নির্মম নির্যাতন চালিয়েছিল তালিবরা। শিয়া সম্প্রদায়ের হাজারাদের স্কুল, বাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। মধ্য আফগানিস্তানে গৌতম বুদ্ধের মূর্তি-সহ হাজারাদের অনেক স্থাপত্য নষ্ট করা হয়েছিল।
উজবেকিস্তান সীমান্তে উত্তর আফগানিস্তানে থাকা উজবেক জাতিগোষ্ঠীও মানে না তালিবদের। তারা মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ হলেও তালিবদের বিরুদ্ধে বরাবরই গড়ে তুলেছে প্রতিরোধ। তাদেরই অন্যতম যুদ্ধপতী আবদুল রশিদ দস্তুম। তুর্কমেনিস্তান সীমান্তে থাকা আফগানিস্তানের তুর্কমেনিরাও কখনও তালিবদের আধিপত্য মানতে চায়নি। তারা উত্তরের জোটের বড় শক্তি হয়ে থেকেছে বরাবরই। আর পাকিস্তানের বালুচিস্তান প্রদেশ লাগোয়া আফগানিস্তানের বালুচিরা কখনওই তালিবদের রেয়াত করেনি। তারাও বরং সঙ্গে থেকেছে নর্দার্ন অ্যালায়েন্সেরই।
তালিবদের মধ্যে সংখ্যাধিক্য যাঁদের, সেই পাশতুনদের যুদ্ধপতী হিসেবে যথেষ্টই খ্যাতি রয়েছে গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের। যিনি এক সময় আমেরিকার খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এখন পাকিস্তানের আইএসআই-এর ‘হাতের পুতুল’। তালিবদের পছন্দ করেন এমন পরিচিতি নেই হেকমতিয়ারের।
তালিবদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি লড়াই করবেন যিনি, তিনি তাজিক নেতা আহমেদ মাসুদ। পঞ্জশির উপত্যকায় তাঁরই নেতৃত্বে তালিবদের বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছেন তাজিকরা। রয়েছেন উজবেক নেতা আবদুল রশিদ দস্তুমও। কট্টর তালিব-বিরোধী বলেই যাঁর পরিচিতি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy