দীর্ঘ রোগভোগের পর দুবাইয়ের হাসপাতালে প্রয়াত হলে পারভেজ মুশারফ। — ফাইল ছবি।
দীর্ঘ রোগভোগের পর প্রয়াত পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মুশারফ। দুবাইয়ের আমেরিকান হাসপাতালে রবিবার তাঁর মৃত্যু হয়। বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর।
অনায়াসে যে কোনও সাড়াজাগানো ছবির বিষয়বস্তু হতে পারতেন। পরতে পরতে কড়া ডোজের বিতর্কের সঙ্গে বজ্রকঠিন ব্যক্তিত্বের এক বিরল মিশেল পারভেজ মুশারফ। ২০০২-এ বাংলাদেশ সফরে গিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের সেনার ‘বাড়াবাড়ি’ নিয়ে ‘দুঃখপ্রকাশ’ করেছিলেন। তার আগে তিন-তিন জন পাকিস্তানি প্রধান বাংলাদেশ ঘুরে গিয়েছেন। কিন্তু কেউ ‘খান সেনা’র বাড়াবাড়ি নিয়ে টুঁ শব্দটিও করেননি। অথচ যা শুনতে উদ্গ্রীব ছিলেন বাংলাদেশিরা। মুশারফের সটান দুঃখপ্রকাশ সেই ক্ষতে খানিকটা হলেও প্রলেপ দিতে পেরেছিল কি? পরবর্তী কালে মুশারফের গলাতে শোনা গিয়েছিল, ‘‘মনে রাখবেন, জোর করে কোনও দিন কারও দৃষ্টিভঙ্গি বদল করা যায় না। পৃথিবীর ইতিহাস বলে, কোনও ধারণাই মানুষের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যায় না।’’ অথচ এই মুশারফই ক্ষমতা ধরে রাখতে পাকিস্তানের সংবিধানের কোমর ভেঙে দিয়েছিলেন বলে আজও লাহোর, করাচিতে গুঞ্জন ওঠে। পাকিস্তানের প্রথম শ্রেণির দৈনিকে লেখা হয়, ‘ডিকটেটর মুশারফ পাসেস অ্যাওয়ে।’ স্ববিরোধিতার এমন জলজ্যান্ত প্রতিমূর্তি বিরলই বটে।
১৯৪৩-এর ১১ অগস্ট অবিভক্ত ভারতের দিল্লিতে জন্ম মুশারফের। দেশভাগের পর পরিবার গিয়ে ওঠে করাচিতে। সেখানেই সেন্ট প্যাট্রিকস স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয় ছোট্ট মুশারফকে। উচ্চশিক্ষা লাহোরের ফোরম্যান ক্রিশ্চিয়ান কলেজে। সেখান থেকে কাকুলের ‘পাকিস্তান মিলিটারি অ্যাকাডেমি’তে। অতঃপর, ১৯৬৪ সালে স্নাতক পাশ করে পাক সেনায় আনুষ্ঠানিক যোগদান। ১৯৬৫-তে প্রথম যুদ্ধের স্বাদ পান মুশারফ। ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তরুণ মুশারফ সে বার প্রথম সারিতে ছিলেন। তার পর ১৯৭১-এর ভারত-পাক যুদ্ধ। তখন তিনি পাকিস্তানি সেনার ‘স্পেশাল সার্ভিসেস গ্রুপ’ (এসএসজি) কম্যান্ডো ব্যাটালিয়নের কোম্পানি কম্যান্ডার। যুদ্ধে পাকিস্তান হারলেও মুশারফের উত্থানেরও যেন আরম্ভ সেই হারের জ্বালা বুকে নিয়েই। এর পর একাধিক সামরিক ‘অ্যাসাইনমেন্ট’-এ বার বার নিজের জাত চিনিয়েছেন দিল্লির পারভেজ। কারগিলে ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকে আক্রমণের নেপথ্যেও ছিলেন তিনি।
সেটা ১৯৯৮ সাল। প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ চিনতে ভুল করেননি মুশারফকে। অক্টোবরে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান হিসাবে দায়িত্বভার নেন জেনারেল মুশারফ। বছর গড়ানোর আগেই যে শরিফকে ছুড়ে ফেলে নিজেই দেশের তখতে বসে পড়েন মুশারফ। ইতিহাসের পাতায় যা পরিচিত ‘ব্লাডলেস ক্যু’ নামে।
১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর সাতসকালে পাক সেনা ঘিরে ফেলে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শরিফকে করাচির বিমানবন্দরে নামতে সটান বারণ করে দেন সেনাপ্রধান মুশারফ। শ্রীলঙ্কা থেকে ফিরছিলেন নওয়াজ। কিন্তু করাচির মাটি ছুঁতে পারেনি তাঁর বিমান, আকাশেই চক্কর কেটে যায়। বস্তুত, আকাশে থাকা অবস্থাতেই শরিফ জানতে পারেন, তিনি প্রাক্তন হয়েছেন। দেশের ভার নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন পারভেজ মুশারফ। পাকিস্তানে জারি হয় জরুরি অবস্থা। সংবিধানকে বাতিল ঘোষণা করেন একনায়ক হতে চলা মুশারফ।
২০১১-এর জুনে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন মুশারফ। তার কয়েক মাসের মধ্যেই আমেরিকায় ঘটে যায় ৯/১১-এর জঙ্গি হামলা। যার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ আমূল বদলে দেয় মুশারফের গতিপথ। আমেরিকার ‘ওয়ার অন টেরর’-এ প্রেসিডেন্ট বুশের পাশে দাঁড়ান প্রেসিডেন্ট মুশারফ। পাক ওয়াকিবহাল মহলের একটি অংশ মনে করে, পাকিস্তানে আমেরিকার সরাসরি হস্তক্ষেপেরও সেই শুরু। যা ইদানীং সে দেশের ভোটের অন্যতম ইস্যু হয়ে উঠেছে। জীবদ্দশায় মুশারফ যে সমালোচনার মুখে কঠোর ভাবে নিজেকে ‘ডিফেন্ড’ করেছেন বরাবর।
২০০২ সালে পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন করান মুশারফ। পাকিস্তান মুসলিম লিগ (কায়েদ)-এর সঙ্গে হাত মেলান। জড়িয়ে পড়েন মুত্তাহিদা কউমি আন্দোলনে। ছ’টি ধর্মাশ্রয়ী দলকে নিয়ে জোটের নাম দেন মুত্তাহিদা মজলিস-ই-আমল। ২০০৪-এ পাক পার্লামেন্টের দুই কক্ষেই আস্থা ভোটে জয়লাভ করেন মুশারফ। ২০০৬ সালে বেরোয় তাঁর আত্মজীবনী ‘ইন দ্য লাইন অফ ফায়ার’।
ভিতরে ভিতরে সমস্যা চলছিল। কিন্তু ২০০৭ সালের মার্চে সমস্যা যেন উপচে ওঠে। পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি ইফতিকার মহম্মদ চৌধরিকে বরখাস্ত করেন প্রেসিডেন্ট মুশারফ। তাতে খেপে যায় পাকিস্তানের আইনজীবীমহল। লাহোর, করাচি, ইসলামাবাদের রাস্তায় কালো কোটের মিছিল ক্রমশ হিংসাত্মক চেহারা নিতে থাকে।
যে কায়দায় মুশারফ দেশের ক্ষমতা দখল করেছিলেন তা নিয়ে ঘোর আপত্তি ছিল আন্তর্জাতিক মহলের। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে এক ফোঁটাও রক্ত ঝরেনি। ফলে আপাত ভাবে মুশারফের গদি ছিল কণ্টকহীন। কিন্তু প্রধান বিচারপতিকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত যেন আপাত শান্ত পরিবেশে ঘৃতাহুতি দিল। আইনজীবী, বিচারকদের পাশাপাশি মুশারফের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে নাগরিক সমাজের একটি অংশের মনোভাব। তা সরাসরি প্রভাবিত করে জনমানসকে। ২০০৭-এর জুনে পাক সুপ্রিম কোর্ট প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তকে বদলে দেয়। স্বপদে আসীন হন ইফতিকার। যদিও সেই পদ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ৩ নভেম্বর মুশারফ দেশে আবার জরুরি অবস্থা জারি করেন। জরুরি অবস্থা জারির ২৫ দিনের মধ্যে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান মুশারফ। সেই পদে বহাল করেন জেনারেল আশফাক পারভেজ কিয়ানিকে। ১৫ ডিসেম্বর জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের কথা ঘোষিত হয় ইসলামাবাদ থেকে।
মুশারফকে ‘ইমপিচ’ করার তোড়জোড় শুরু হয় সরকারের অন্দরে। যদিও তার প্রয়োজন পড়েনি। স্বেচ্ছায় প্রেসিডেন্ট পদ ছেড়ে দেন মুশারফ। ২০১০ সালে মুশারফ নিজের রাজনৈতিক দল অল পাকিস্তান মুসলিম লিগ (এপিএমএল) গঠন করেন। কিন্তু বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি। ২০১৩-য় তাঁর বিদেশযাত্রার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। কিন্তু ২০১৬-তে তা তুলে নেওয়া হয়। মুশারফ চিকিৎসা করাতে দুবাই যাওয়ার ছাড়পত্র পান। সে বছরই ১৭ মার্চ দুবাই উড়ে যান মুশারফ। আর ফেরেননি।
২০১৮ নাগাদ জানা যায়, জটিল এবং বিরল রোগে আক্রান্ত মুশারফ। রোগের কারণেই ক্রমশ চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়ছেন এককালের দাপুটে সেনাপ্রধান তথা একনায়ক। এ দিকে পাকিস্তানে মুশারফের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের মামলা শুরু হয়। তৎকালীন পিএমএলএন সরকার তাঁর বিরুদ্ধে মামলাটি করেছিল ২০০৭-এ সংবিধান বাতিল ঘোষণা নিয়ে। ২০১৯-এর ১৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের একটি বিশেষ আদালত দেশদ্রোহের দায়ে মুশারফকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। যদিও সেই রায়ের এক মাসের মধ্যে লাহোর হাই কোর্ট মুশারফকে মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই দেয়। কিন্তু বিরল রোগ থেকে মুক্তি পাননি মুশারফ। যে রোগে ক্রমশ তিনি চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়েন। দাপটে দেশ চালানো মুশারফ শেষ দিকে এক প্রকার অথর্ব হয়ে পড়েছিলেন। সে কথা জুন মাসে দেওয়া বিবৃতিতে মেনে নিয়েছিল মুশারফের পরিবারও। রবিবার তিনি প্রয়াত হলেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy