মাত্র বছর দশেক আগের কথা। বিশ্বজোড়া আর্থিক মন্দা জাঁকিয়ে বসেছে তখন। চাকরি যাচ্ছে দেদার, বেতনে টান, বন্ধ হচ্ছে একের পর এক সংস্থা, শিল্পপতিরা হতভম্ব। মার্কিন আর্থিক সংস্থা ‘লেম্যান ব্রাদার্স’ নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করার পরেই কার্যত মন্দার শুরু। ওই সংস্থার সাইনবোর্ড খুলে নেওয়ার ছবিটাই তখন মন্দার ‘মুখ’।
সেই আমেরিকাই তখন দেখাচ্ছিল অন্য এক ছায়া-ছবি। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারির সমীক্ষা বলছে, মন্দার বছরেই আমেরিকায় সিনেমার টিকিট বিক্রি বেড়ে গিয়েছিল ১৭.৫ শতাংশ। ১৭০ কোটি ডলারের ব্যবসা করে নিজেরই দু’দশকের পুরনো রেকর্ড ভাঙতে বসেছিল হলিউড। বিশ্লেষকেরা বলছিলেন, ‘‘মনে হচ্ছে, দেশের সমস্ত মানুষ যেন সিনেমা দেখতেই ছুটছে।’’
ভারতের আইন ও যোগাযোগ মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ গত কালই বলেছিলেন, ‘‘গাঁধী জয়ন্তীতে বলিউডের মাত্র ৩টি ছবি ১২০ কোটি টাকার টিকিট বিক্রি করেছে। দেশের আর্থিক হাল ভাল না-হলে এটা অসম্ভব।’’ আজ অবশ্য উল্টো
কথা বলেছেন তিনি। আর এক দশক আগে সত্যিই এক ‘উল্টো কথা’ বলেছিল মন্দার আমেরিকার পরিসংখ্যান! মার্কিন পত্রপত্রিকায় সেই সময়ে রীতিমতো খবর
হয়েছিল রমরমিয়ে সিনেমার
টিকিট বিক্রি নিয়ে।
প্রশ্ন হল, এর কারণ কী? সাউথ ক্যারোলাইনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্টিন কাপলান বলেছিলেন, ‘‘এই মুহূর্তে আমেরিকানরা চাইছেন দুঃখ ভুলতে, অন্যদের সঙ্গে মিশতে। এটা তো কোনও রকেট সায়েন্স নয়, সহজেই বোঝা যায়।’’ একটি মার্কিন সংবাদপত্র লিখেছিল, ওই সময়ে সে দেশের সিনেমা হলগুলোর পর্দায় গুরুগম্ভীর বা দুঃখের সিনেমা প্রায় ছিলই না। এমনকি অস্কারজয়ীদের ছবিও ব্যবসা দিতে পারেনি আগের এক-দু’বছরে। বরং ভিড় টানছিল এমন ছবি, যা দেখতে হলে তেমন মাথা খাটানোর দরকার নেই। মন্দার সময়ে ‘মার্লে অ্যান্ড মি’ কিংবা ‘ম্যাডিয়া গোজ় টু জেল’-এর মতো কমেডি, ‘টেকেন’-এর মতো থ্রিলারের টিকিট বিকোচ্ছিল হুহু করে। এমনকি জোনাস ভাইদের কনসার্টের ভিডিয়োর থ্রি-ডি সংস্করণ দেখতেও বাচ্চাদের নিয়ে হাজির হচ্ছিলেন বাবা-মায়েরা। তেমনই এক মা বলেছিলেন, ‘‘এই সময়ে ডিজ়নিল্যান্ড গেলে ১০০ ডলারের ধাক্কা। তার চেয়ে ৬০ ডলারের মধ্যে তিনটে বাচ্চা নিয়ে সিনেমা দেখা, ও
দের একটু লজেন্স-টজেন্স কিনে দেওয়া— সবই হয়ে যাচ্ছে।’’ অনলাইন টিকিট বিক্রির একটি সংস্থা জানাচ্ছে, সেই সময়ে অন্তত ৮০০ স্ক্রিনে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল প্রিয়ঙ্কা চোপড়ার বর্তমান স্বামী নিক জোনাস ও তাঁর ভাইদের গানবাজনার সিনে-সংস্করণটির টিকিট।
আরও একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক। ১৯৮২। আমেরিকায় বেকারত্বের হার তখন ১০ শতাংশ পেরিয়েছে। কিন্তু সিনেমা দেখার ভিড় বেড়ে গিয়েছে ১০ শতাংশ! রীতিমতো রাজত্ব করছে স্টিভেন স্পিলবার্গের ‘ইটি’। মজার কথা, এর ঠিক তিন বছর পরেই আমেরিকা জুড়ে সিনেমা হলে ভিড় কমে যায় প্রায় ১২ শতাংশ। অথচ ‘ব্যাক টু দ্য ফিউচার’-এর মতো দুর্ধর্ষ কল্পবিজ্ঞানের ছবি তখন পর্দায়। সব চেয়ে বড় কথা, অর্থনীতির হালও ওই সময়ে শুধরেছে। বেকারত্বের কথা হচ্ছিল। ১৯৮৯ সালে আমেরিকায় বেকারত্বের হার ছিল মাত্র ৫.৪ শতাংশ। আর ২০০৮-২০০৯ সালের আগে একমাত্র সেই বছরেই মার্কিন সিনেমা হলে দর্শক সংখ্যা বৃদ্ধি পৌঁছেছিল দুই অঙ্কে (১৬.৪ শতাংশ)। প্রচুর ব্যবসা করেছিল ‘ব্যাটম্যান’। কোথায় গেল ‘দুঃখ ভোলার’ তত্ত্ব?
বিশেষজ্ঞদের অনেকের মতে, এ রকম কোনও তত্ত্ব আদৌ হয়-ই না। পরিসংখ্যান বলে, কখনও আর্থিক মন্দার সময়ে সিনেমা শিল্প প্রচুর ব্যবসা করেছে। কখনও অর্থনীতি পোক্ত হলেও ভাল ছবি হালে পানি
পায়নি। কাজেই শুধু সিনেমার টিকিট বিক্রির পরিসংখ্যান দিয়ে অর্থনীতির হাল কিংবা তার উল্টোটা বিচার
করা যায় না।
উদাহরণ অনেক আছে। পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময়ে (১৯৪৩) পুজোর কলকাতায় সিনেমা হলে খুব ভিড় হয়েছিল। শুধু দুঃখ ভোলা নয়, এর মধ্যে একটা আর্থিক অসাম্যের গল্পও আছে হয়তো। বিশ্বযুদ্ধ পুরোদমে চলার সময়েও দর্শকশূন্য হয়নি মহানগরীর সিনেমা হল। জীবন এগিয়েছে
নিজের গতিতেই।
মন্ত্রীমশাই কি শুনছেন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy