পুড়ছে আমাজনের জঙ্গল। ছবি: এএফপি।
ব্রাজিলের বিখ্যাত লেখক মিলটন হাতুম ২০০৫ সালে আমাজনিয়া রাজ্য থেকে লিখেছিলেন— ‘অ্যাশেজ় অব দ্য আমাজন’। সেই বইটার কথা আজ বারেবারেই মনে পড়ছে।
আমাজনের অরণ্যে এর আগেও আগুন লেগেছে এবং নিয়মিত লেগেছে। ওখানে সারা বছর দুটো মাত্র ঋতু, খুব বর্ষাকাল আর কম বর্ষাকাল। জুন-জুলাই-অগস্ট কম বর্ষাকালের সময়। সাধারণত আমাজনে অতিরিক্ত আর্দ্রতার জন্য প্যাচপ্যাচে গরম থাকে আর যখন তখন বৃষ্টি। না, ঘ্যানঘ্যানে বৃষ্টি নয়, মুহূর্তের মধ্যেই রোদ ওঠে এবং রাস্তাঘাট শুকনো হয়ে যায়। খুব বর্ষাকালের সময় বন্যায় ভেসে যায় গ্রামের পর গ্রাম। জনজাতিরা জলের উপর বসবাসের জন্য ভাসমান বাড়িঘর তৈরি করেছেন। আবার কম বৃষ্টির সময় জলের পরিমাণ কমলেও শুষ্ক আবহাওয়ার ফলে জঙ্গলে আগুন লাগার সম্ভাবনা বাড়ে।
গত বছর জুনে গিয়েছিলাম আমাজনাস রাজ্যের রাজধানী মানাউসে। শহর থেকে সামান্য দূরে গেলেই ঘন অরণ্য, সবুজের গালিচা। একদিন সন্ধ্যের সময় ফেরার পথে দেখেছিলাম দূরে জঙ্গলের মাঝে বিক্ষিপ্ত ধোঁয়ার কুণ্ডলী। আমাদের গাড়ির চালক স্থানীয় মানুষ, উনি বললেন, “ধোঁয়া বলে যা মনে হচ্ছে, তা এত গাছের সালোকসংশ্লেষের ফলে উদ্ভূত বাষ্প হতে পারে। আবার দাবানল থেকেও হতে পারে। আলিবাবা আর চল্লিশ চোরেরা বসে আছে ক্ষমতায়, তারা কোনও দিনই আমাজনের উন্নতি করার কথা ভাবেননি।’’ আমাজন থেকে যে দিন ফিরে আসব, এক বন্ধু পরামর্শ দিলেন, অনেক তাড়াতাড়ি এয়ারপোর্টে চলে যেতে। কারণ, রাতের অন্ধকারে রাস্তা বন্ধ করে জঙ্গলের গাছ কেটে পাচার করা হয়।
এই ঘটনাগুলো বলার কারণ হল, আমাজনের অরণ্যের প্রতি উপেক্ষা আজ থেকে শুরু হয়নি। বছরের পর বছর ধরেই চলছে এমন উদাসীনতা। ২০ শতাংশ অরণ্য একেবারেই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, ব্রাজিলে এই বছরের মতো ভয়াবহ ক্ষতি আগে কখনও হয়নি। প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো একেবারেই নিরুত্তাপ। জানুয়ারি মাসে ক্ষমতায় আসার পর থেকে তিনি উপজাতিদের থেকে জঙ্গলের অধিকার কেড়ে নিয়েছেন। এই জঙ্গল তাদের খাদ্য, ওষুধ, অস্তিত্বের সম্বল। সারা বিশ্বে অক্সিজেনের সরবরাহ কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে জানি না, এই অরণ্যবিনাশে উপজাতিদের জীবন অতীব সঙ্কটে। অনেকে বলছেন, বোলসানারোর লোকেরাই গিয়ে জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে, কারখানা তৈরির জন্য। তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। কিন্তু লোকজনের মূল আক্ষেপ, সরকার থেকে দাবানল নেভানোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন? বলিভিয়া থেকে তাদের অংশের আমাজন বাঁচাতে বৃহত্তম জলের ট্যাঙ্ক কেনা হয়েছে। আর ব্রাজিলে বোলসানারো প্রথমে বললেন, এনজিও-রা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে আগুন লাগাচ্ছে। আমাজনের দমবন্ধ পরিস্থিতি থেকে চোখ সরাতে বেকারত্ব কমে যাওয়ার তথ্যও দিচ্ছেন। তিন সপ্তাহ ধরে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে চলেছে আমাজন, আর এখন তিনি সেনা পাঠাবেন বলছেন।
গত সোমবার প্যারাগুয়ের সীমান্ত হয়ে দাবানলের ধোঁয়া এসে পৌঁছয় সাও পাওলোয়। সকাল ১১টাকে মনে হচ্ছিল বিকেল ৬টা। সকালে এমন আঁধার জীবনে কখনও দেখিনি। সাও পাওলোয় সেই ধোঁয়া পৌঁছনোর পরেই জনগণ নড়েচড়ে বসে, এমন বিধ্বংসী আগুনের কথা জানতে পেরে ক্ষোভে ফেটে পড়ে দেশ।
আমার স্কুলে বা যে কোনও কর্মক্ষেত্রে আমাজন নিয়ে কোনও রকম আলোচনা করতে নিষেধ করা হচ্ছে। কারণ, বিষয়টি এখন রাজনৈতিক! দাবানলের জেরে মারা গেছে সহস্র জন্তু জানোয়ার। সপ্তাহান্তে দেশের বিভিন্ন শহর থেকে বেরিয়েছে প্রতিবাদের মিছিল, আগুনে ঝলসে যাওয়া মুখের মুখোশ পরে।
সব দেখেশুনে একটা কথা মনে হচ্ছে। যে ‘ট্রপিকাল ট্রাম্প’ প্রেসিডেন্টের নির্বাচন নিয়ে সারা দেশ বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল, পরিবারের মধ্যে ঝগড়া, বন্ধুবিচ্ছেদ, প্রতিবেশী দেশের প্রতি কটূক্তি নিত্যদিন লেগে থাকত, আমাজনের আগুন তাদের সকলকে আবার এক করে দিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy