বেথলেহেমের ঠিক এই জায়গায় জিশু জন্মেছিলেন বলে মনে করা হয়। বড়দিনের আগের রাতে সেখানে এক শিশু। রবিবার। ছবি: রয়টার্স।
বড়দিনের উৎসবে মেতেছে গোটা বিশ্ব। শুধু ‘জিশুর ঘরই’ অন্ধকার, বিষণ্ণতায় ভরা!
বেথলেহেম, জিশুর জন্মস্থান। প্রতি বছর এই সময়টা আলোয় আলোয় সেজে ওঠে প্যালেস্টাইনের ইজ়রায়েল অধিকৃত অঞ্চল ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের এই ছোট্ট শহরটি। পর্যটকে ছেয়ে যায়, হোটেলগুলোয় তিল ধারণের জায়গা হয় না। স্থানীয় দোকানপাটগুলোয় বিদেশি মুখের ভিড় দেখা যায়। শহরের মূল স্কোয়ারে ব্যান্ড-বাজনা নিয়ে শোভাযাত্রা হয়। এ বারে সে সব কিছুই নেই। ইজ়রায়েল-হামাস যুদ্ধের আবহে বেথলেহেমে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানটুকু ছাড়া সবই বাতিল হয়েছে। বড়দিনের প্রাক্কালে জনশূন্য স্কোয়ারে টহল দিচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনী।
ভিয়েতনামের নাগরিক জন ভিন গত ছ’বছর ধরে জেরুসালেমে থাকেন। বড়দিনের সময়ে প্রতি বছর তিনি বেথলেহেমে আসেন। বললেন, ‘‘এ বছর কোনও ক্রিসমাস ট্রি নেই, আলোর রোশনাই নেই, শুধুই অন্ধকার ছেয়ে।’’ বরং ম্যাঙ্গার স্কোয়ারে এক টুকরো গাজ়ার প্রতিচ্ছবি। বড় বড় ধূসর পাথরের চাঁইয়ের উপরে শুয়ে ‘জিশু-শিশু’। সাদা কাপড়ে মোড়ানোর তার দেহ। গাজ়ার যুদ্ধে হাজার হাজার শিশু-হত্যার প্রতীকী প্রতিবাদ।
ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ও জেরুসালেমে ৫০ হাজার খ্রিস্টানের বাস। গাজ়াতেও আনুমানিক ১৩০০ খ্রিস্টান থাকেন। অসহায় অবস্থায় রয়েছেন সেই সব প্যালেস্টাইনি খ্রিস্টানরা। নিজেরা অক্ষত থাকলেও পরিবার-পরিজনের চিন্তায় দুঃসহ জীবন। ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের বাসিন্দা, বেথলেহেমের ব্যবসায়ী সমিতির কর্ত্রী সুজ়ান সাহোরি বলেন, ‘‘মনের মধ্যে আর কোনও আনন্দ নেই। ঈশ্বরের কাছে জানতে ইচ্ছে করে, কেন এত শিশুকে মরতে দিচ্ছেন উনি? ...ঈশ্বরের উপরেও রাগ হচ্ছে। উনি আমাকে মাফ করুন।’’
জেরুসালেমের গির্জাগুলিতে এ বছর উৎসব সীমিত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শুধুমাত্র ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানেই নজর দেওয়া হচ্ছে। গাজ়ায় নিহতের সংখ্যা ২০,৪২৪ ছাড়িয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১৬৬ জনের মৃত্যু হয়েছে, জখম ৩৮৪ জন। শুধু নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা ১০৩। ২৩ লক্ষ মানুষ ঘরহারা। যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে বেথলেহেম-সহ অন্য প্যালেস্টাইনি শহরগুলোতেও। ইজ়রায়েল অধিকৃত অঞ্চলগুলোতে জায়গায় জায়গায় মিলিটারি চেক পয়েন্ট বসানো হয়েছে। সেখানে যানবাহনের লম্বা লাইন। সেনার নজর এড়িয়ে কেউ ঢুকতে-বেরোতে পারবেন না। প্যালেস্টাইনের এই সব জায়গার অনেক বাসিন্দাই ইজ়রায়েলের কোনও শহরে কাজ করেন। কিন্তু এখন তাঁদের ইজ়রায়েলে ঢোকার অনুমতি নেই। ফলে কাজ হারিয়ে ঘরবন্দি অনেকেই।
বড়দিনের উৎসব বাতিল হওয়া বেথলেহেমের অর্থনীতির জন্যেও বড় ধাক্কা। বাসিন্দাদের ৭০ শতাংশ উপার্জনই হয় বছরের এই সময়টা। বেশির ভাগ এয়ারলাইন্স উড়ান বাতিল করে দিয়েছে। হাতেগোণা কিছু বিদেশি পর্যটক দেখা গিয়েছে শহরে। বেথলেহেমের ৭০টি হোটেল জোর করে বন্ধ করে দিয়েছে প্রশাসন। তাতেও হাজার খানেক মানুষ কাজ হারিয়েছেন। এর মধ্যে বৃষ্টি হচ্ছে। নামমাত্র কিছু উপহার সামগ্রীর দোকান, এক-দু’টো রেস্তরাঁ খুলেছে উৎসবের রাতে। আলা সালামে নামে এক রেস্তরাঁ মালিক বললেন, ‘‘গাজ়ায় মানুষের মাথার উপরে ছাদ নেই। এত মৃত্যু... উৎসব করার
কোনও অর্থ খুঁজে পাচ্ছি না।’’ বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় আলা জানালেন, প্রতি বছর এই সময়টা সবচেয়ে ব্যস্ততার মধ্যে কাটে। একটা চেয়ার ফাঁকা পাওয়া যায় না। সেখানে এ দিন সন্ধ্যায় একটি মাত্র চেয়ারেই লোক বসে। তা-ও এক সাংবাদিক, বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচাতে কিছু ক্ষণের জন্য আশ্রয় নিয়েছেন।
রাস্তার ধারে কিছু কিশোর-কিশোরী সান্টা ক্লজ়ের বেলুন বেচছিল। তাতেও লেখা, ‘‘গাজ়ায় যুদ্ধবিরতি চায় বেথলেহেমের ক্রিসমাস বেল।’’ রাস্তাজুড়ে চিরাচরিত গান-বাজনা-শোভাযাত্রা নেই। তার বদলে এক দল অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে রাস্তায় প্যালেস্টাইনের পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে। বেথলেহেমের মেয়র হানা হানিয়ে জনসাধারণের উদ্দেশে বলেছেন, ‘‘প্রতি বছর ক্রিসমাসে আমরা শান্তি ও ভালবাসার বার্তা দিই। কিন্তু এ বছর শুধু দুঃখ, হতাশা, ক্ষোভের কথাই বলব। গাজ়া স্ট্রিপে যা হচ্ছে, তা মেনে নেওয়া যায় না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy