ভেঙে পড়েছে ভাবমূর্তিও। রবিবার সকালে ইসলামাবাদে জাতীয় পরিষদ ভবনের সামনে। — পিটিআই
পাকিস্তানে অতীতের সব প্রধানমন্ত্রীর মতো তিনিও পুরো ইনিংস টিকে থাকতে পারলেন না। কিন্তু প্রেসিডেন্টকে দিয়ে অ্যাসেম্বলি ভেঙে দেওয়ার মোক্ষম সুইংয়ে অন্য কারও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যাত্রাও ভঙ্গ করে দিলেন ইমরান খান। তবে সসম্মানে টিকে থাকতে তাঁর নিজস্ব খেলা রিভার্স সুইং কি আদৌ কাজ করল? প্রশ্নটা লেগেই থাকবে ইমারানের রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে।
ঘটনার ঘনঘটার মধ্যে মাঝ পথেই ক্রিজ ছেড়ে দিতে হল পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে। একদা বল হাতে যখন মাঠে নামতেন তখন তাঁর রিভার্স সুইং দেখার জন্য মুখিয়ে থাকতেন ক্রিকেটমোদীরা। কিন্তু রাজনীতির বাইশ গজে তা কাজ করল না। অনেক চেষ্টা করেও পুরো মেয়াদ টিকিয়ে রাখতে পারলেন না সরকার। দেশে কিংবা বিদেশে হারা ম্যাচ জেতাতে অনেকবার ব্যাট হাতেও পাকিস্তানের রক্ষাকর্তা হয়েছেন অলরাউন্ডার ইমরান। কিন্তু এ বার দেশের মাঠেই হার মেনে প্যাভেলিয়নে ফিরতে হল। রাজনীতির পরের ইনিংস কেমন হবে আপাতত অজানা। দেশ বার বার বোলার কিংবা ব্যাটার ইমরানে আস্থা রেখেছে। কিন্তু দেশের পার্লামেন্টেই তিনি অনাস্থার মুখে। ক্ষমতাচ্যুত না হলেও প্রধানমন্ত্রী থেকে হয়ে গেলেন কেয়ারটেকার প্রধানমন্ত্রী।
পাকিস্তানে পুরো মেয়াদ পূর্ণ করতে না পারা প্রধানমন্ত্রীর তালিকা দীর্ঘ। কেয়ারটেকার প্রধানমন্ত্রীও হয়েছেন অনেকে। সেই ইতিহাসেরই যেন পুনর্নির্মাণ হল। পূর্বসূরিদের মতোই আরও একটা মিল তৈরি করলেন। পাকিস্তান রাজনীতিতে ভারত বিরোধিতার যে ধারা, তা-ও অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। ক্ষমতায় আসার পরে প্রথম টেলিভিশন বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘‘ভারত যদি আমাদের দিকে এক ধাপ এগিয়ে আসে, আমরা তাদের দিকে দুই ধাপ এগোব।’’ কিন্তু তাঁর জমানায় ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক মোটেও ভাল হয়নি। আর টিকে থাকার মরিয়া চেষ্টার মধ্যেই গত বৃহস্পতিবার তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত এবং বিরোধীরা দেশের সার্বভৌমত্ব বেচার চক্রান্ত করছে অভিযোগ তুলতে গিয়ে কৌশলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দিকে ইশারা করেছেন ইমরান। এক ভারতীয় সাংবাদিকের বইয়ের উদাহরণ তুলে ইমরান বলেন, ‘‘ওই বইয়ে সুনির্দিষ্ট ভাবে লেখা আছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে আমাদের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ নেপালে গোপন বৈঠক করেছেন।’’ ঘটনাচক্রে, ইমরানের বিরুদ্ধে পাক পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছিল নওয়াজের দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ (নওয়াজ)। প্রধানমন্ত্রিত্বের দাবিদার হিসেবে উঠে আসছিল নওয়াজের ভাই শাহবাজের নামও।
রাজনৈতিক জীবন একেবারে ছোটও নয় ইমরানের। ১৯৯২ সালে ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়ের পর ১৯৯৬ সালে রাজনীতির ময়দানে আসেন। দুর্নীতি বিরোধী স্লোগান তুলে ১৯৯৬ সালের এপ্রিলে প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ। পরের বছর ১৯৯৭ সালে তিনি নির্বাচনে দু’টি কেন্দ্র মিয়াওয়ালি এবং লাহৌর থেকে দাঁড়ালেও হেরে যান। তবে তাতে থামেননি। ২০০২ সালে মিয়াওয়ালি থেকে জয়ী হন। প্রথমে সেনাপ্রধান পারভেজ মুশারফকে সমর্থন দিলেও ২০০৭ সালে ৮৫ জন পার্লামেন্ট সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে পদত্যাগ করেন ইমরান। সে বারের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট হয়ে মুশারফ পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা জারি করেন। গৃহবন্দী করা হয় ইমরানকে। কিছুদিন হাজতবাসও করতে হয়। তবে রাজনৈতিক লড়াই চলতেই থাকে। ২০১৩ সালে পাকিস্তানের দশম নির্বাচনে তার দল দ্বিতীয় বৃহত্তম হয় আর ২০১৮ সালের ২৫ জুলাই পাকিস্তানের একাদশ জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে। ১৮ অগস্ট প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। চার বছর পূর্ণ হওয়ার অনেকটা আগেই প্রধানমন্ত্রীর আসন টলমল।
ক্রিকেট মাঠে বরাবর নায়োকিচত ছিলেন ইমরান। অনেকে ভেবেছিলেন, রাজনীতিতেও তিনি নায়কের মতো আসবেন, দেখবেন, জয় করবেন। পাক রাজনীতির বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাইশ গজের সফল অধিনায়ক নিজেও বুঝতে পারেননি রাজনীতির মঞ্চে খেলাটা অন্যরকম। সেটা বুঝতে বুঝতেই প্রায় দেড় দশক কাটিয়ে ফেলেন ইমরান। খাবি খেতে হয়েছে বারবার। ষড়যন্ত্র, সন্ত্রাস, মৌলবাদ-সহ নানা রোগে ভরা পাক রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে যে মেপে পা ফেলা উচিত, তা সেটাই নাকি মানতে চাননি ইমরান। সারাক্ষণই তিনি দেশে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের কথা বলেছেন। গণতান্ত্রিক সরকারে সেনাবাহিনী, আইএসআই-এর প্রভাব নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। অনেকের সমর্থন পেলেও সেটা মোটের থেকে অনেক কম। ফলে রাজনীতিতে বারবার হোঁচট খেতে হয়েছে স্পোর্টসম্যান খানকে।
একটা সময়ে বুঝতে শুরু করেন নিজের ত্রুটি। নওয়াজকে সরিয়ে সেনাবাহিনী ও আইএসআই-এর আরও কাছে চলে আসেন। প্রধানমন্ত্রীর তখতে বসার স্বপ্নও সফল হয়ে যায়। কিন্তু পুরোপুরি রক্ষা পাননি। জোটসঙ্গী মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট পাকিস্তানের (এমকিউএম-পি)-এর পাশাপাশি ইমরান সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয় বালুচিস্তান আওয়াম পার্টিও। তার পরেও অনেক চেষ্টা চালিয়েছেন। খেলা ঘুরিয়ে দিতে উদ্যোগী হয়েছেন অনবরত। তাতে ক্ষমতা ধরে রাখতে সফল হলেও এটা মানতেই হবে যে, খেলাটা ঠিক খেলার মতো হল না। খেলা জিতলেন খেলা ভন্ডুল করে।
আসলে ক্রিকেটীয় অভিজ্ঞতা তেমন কাজে লাগেনি ইমরানের রাজনৈতিক জীবনে। তাঁর আমলেই পাক ক্রিকেট বাহিনী জনপ্রিয় করে ফেলে রিভার্স সুইং। পা কাঁপত অনেক ঘাঘু ব্যাটসম্যানেরও। বল ভিতর দিকে ঢুকবে না বাইরের দিকে যাবে বুঝতে বুঝতেই উইকেট চলে যেত। ক্রিকেট ব্যাকরণ বলে, খেলা অনেকটা গড়ালে, বল অনেকটা পুরনো হলে তবেই তাকে রিভার্স সুইংয়ে বাধ্য করা যায়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর তখতে থাকার টানটান ম্যাচটা বেশিদূর গড়ালই না! ফলে রাজনীতির খেলায় মাঠের রিভার্স সুইংয়ের জোর দেখাতে পারলেন না ইমরান। নাকি পারলেন! ‘নো বল’ ডাকার জন্য আম্পায়ারই তো রইলেন না। ম্যাচ কঠিন বুঝে ‘ফেয়ার প্লে’র তোয়াক্কা না করে আগেভাগে অ্যাসেমব্লি ভেঙে দিয়েছেন ইমরান ‘কেয়ারটেকার’ খান। চেয়ারটা রইল ঠিকই কিন্তু ভিক্ট্রি স্ট্যান্ডে ওঠার যোগ্যতা রইল না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy