ইস্তফার কথা ঘোষণা করছেন টেরেসা মে। শুক্রবার লন্ডনে ১০, ডাউনিং স্ট্রিটের সামনে। এএফপি
লৌহমানবী হতে চেয়েছিলেন। লৌহমানবীর মতো শাসনকালের শেষ প্রান্তে এসে চোখের জল ফেলতে হল তাঁকেও।
আজ সকালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ১০, ডাউনিং স্ট্রিটের সামনে দাঁড়িয়ে টেরেসা মে জানালেন, কনজ়ারভেটিভ দলের নেত্রী তথা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যাচ্ছেন তিনি। ইস্তফার কথা ঘোষণা করার সময়ে প্রায় কেঁদে ফেলেন প্রধানমন্ত্রী। কথা বলতে বলতে মুখ-চোখের ভাব পাল্টে যায়। গলা ধরে আসে। কোনও মতে কথা শেষ করে দ্রুত বাসভবনে ঢুকে যান তিনি।
টেরেসা বলেন, ‘‘যে দায়িত্ব পালন করে আমি ধন্য হয়েছি, সেই পদ থেকে খুব শীঘ্রই সরে যাব। আমি এ দেশের দ্বিতীয় মহিলা প্রধানমন্ত্রী এবং জানি, আমিই শেষ নই। মনে কোনও রকম অসন্তোষ রেখে এই ঘোষণা করছি না। বরং যে দেশকে ভালবাসি, সে দেশের জন্য কাজ করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি।’’
দলীয় নেত্রীর পদ থেকে তিনি ৭ জুন সরে যাবেন বলে জানিয়েছেন মে। তবে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে কবে সরছেন, সে বিষয়ে কিছু বলেননি। দলীয় সূত্রের খবর, টেরেসা ইস্তফা দেওয়ার পরেই নতুন নেতা নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হবে। জুলাই মাসের মধ্যে নেতা ঠিক হয়ে যাবে। তত দিন কার্যনির্বাহী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাজ চালিয়ে যাবেন টেরেসা।
২০১৬ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন টেরেসা। ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের ফল প্রকাশের পরে ইস্তফা দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। পদে এসেই টেরেসা বলেছিলেন, ‘‘ব্রেক্সিট মানে ব্রেক্সিট। আমরা ২৯ মার্চ ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ছেড়ে বেরিয়ে যাব।’’ কিন্তু ইইউয়ের সঙ্গে টানা তিন বছর টানাপড়েনে টেরেসার ক্যাবিনেট থেকে একের পর এক মন্ত্রীদের ইস্তফা আর তাঁর ব্রেক্সিট বিলের খসড়া বারবার পার্লামেন্টে খারিজ হওয়ার পরে সময়টা ক্রমশই কঠিন হয়ে পড়ে প্রধানমন্ত্রীর জন্য। আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে সীমান্ত চুক্তির মতো কয়েকটি বিষয় নিয়ে দলের কট্টর ব্রেক্সিটপন্থীদের মন তিনি কিছুতেই জয় করতে পারেননি। ব্রিটেন ২৯ মার্চ ইইউ থেকে বেরোতেও পারেনি।
টেরেসার সরে যাওয়া তাই এক রকম প্রত্যাশিতই ছিল। তবু হাল ছাড়েননি কনজ়ারভেটিভ নেত্রী। বিরোধীদের কাছ থেকেও সমর্থন জোটানোর চেষ্টা করেছেন। বারবার বৈঠক করেছেন লেবার নেতা জেরেমি করবিনের সঙ্গেও। চতুর্থ বারের জন্য ব্রেক্সিট বিলের খসড়া এনে শেষ চেষ্টা করে দেখতে চেয়েছিলেন মে। কিন্তু কাজ দিল না কিছুই। বিরোধী লেবার এবং তাঁর দলের ব্রেক্সিটপন্থীরা সাফ জানিয়ে দিলেনন, তাঁরা ওই খসড়ারও বিরোধিতা করবেন। ফলে সরে যাওয়া ছাড়া টেরেসার সামনে আর কোনও রাস্তা খোলা ছিল না। ইস্তফা দেওয়ার পরে ব্রেক্সিটের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে আজ প্রশ্ন তুলেছে ইইউ।
আজ সকালে টেরেসার সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন দলীয় এমপি গ্র্যাম ব্র্যাডি। গ্র্যাম তাঁকে বলেন, ইস্তফার সময়সীমা ঘোষণা করতে হবে তাঁকে। ফলে আজ ১০, ডাউনিং স্ট্রিটের বাইরে এসে টেরেসা যা বলেছেন, তা বলতে তাঁকে বাধ্য করা হয়েছে, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
১৯৯০-এর নভেম্বর। চোখের জলে বিদায় মার্গারেট থ্যাচারের। ফাইল চিত্র
টেরেসা নিজে বহু বার বলেছেন, তাঁর আদর্শ দেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী ‘লৌহমানবী’ মার্গারেট থ্যাচার। ‘দ্বিতীয় থ্যাচার’ হতে চেয়েছিলেন তিনি। ভেবেছিলেন, ব্রিটেনকে ব্রেক্সিট ‘উপহার’ দিয়ে যাবেন। সেটাই হবে তাঁর উত্তরাধিকার। কিন্তু ঘরে-বাইরে সাঁড়াশি চাপের মুখে পড়ে সেই পরিকল্পনা আর বাস্তবায়িত হল না।
কোনও নেতা যখন দলের ‘বোঝা’ হয়ে দাঁড়ান, তখন তাঁর প্রতি যথেষ্ট নির্মম কনজ়ারভেটিভ পার্টি। সে নজির আছে থ্যাচারের সময় থেকেই। ১৯৯০ সালে থ্যাচারকেও তারা এক রকম ‘টেনেহিঁচড়ে’ ১০ ডাউনিং স্ট্রিট থেকে বার করে দিয়েছিল। তাদের তখন মনে হয়েছিল, থ্যাচার দলের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তিন বারের প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও ‘রেয়াত’ করা হয়নি থ্যাচারকে। তাঁর জায়গায় এসেছিলেন জন মেজর। ইস্তফা ঘোষণা করার সময়ে চোখে জল চলে এসেছিল ‘ম্যাগি’ থ্যাচারেরও।
টেরেসা আজ বলেন, ‘‘গণভোটের ফল যাতে ব্রিটেনের সবার জন্য কার্যকরী হয়, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে সেই চেষ্টাই করে গিয়েছি। এখন আমার কাছে স্পষ্ট, ব্রিটেনের স্বার্থে নতুন কোনও প্রধানমন্ত্রী সে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। তাই আমি আজ ঘোষণা করছি, ৭ জুন কনজ়ারভেটিভ নেত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়াব। এমপি-দের বোঝাতে যতটা করা সম্ভব, আমি করেছি। দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, সেটা যথেষ্ট ছিল না। আমার উত্তরসূরিকে ঐকমত্যের সূত্র খুঁজে বার করতে হবে। ব্রেক্সিট হবেই।’’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনীতি এ রকমই নিষ্ঠুর। এক ব্রেক্সিট তিন বছরে দু’জন প্রধানমন্ত্রীকে পদচ্যুত করল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy