খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও নামবদল। এই বিশ্ববিদ্যালয়েও সিন্ডিকেট জরুরি সভা ডেকে শেখ মুজিবুর রহমান বা তাঁর পরিবারের লোকেদের নামে ছয়টি ভবন, ব্যায়ামাগার ও উদ্যানের নাম পাল্টে দিয়েছে। সঙ্গে নতুন একটি আবাসিক ছাত্রাবাসের নাম দেওয়া হয়েছে ‘চট্টগ্রামের সব চেয়ে কুখ্যাত গণহত্যাকারী রাজাকার’ ফজলুল কাদের (ফকা) চৌধুরীর নামে। নির্যাতন কক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে নিয়ে গিয়ে এই ফকা চৌধুরী ও তাঁর পুত্র সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর ভয়ঙ্কর অত্যাচার এবং পরে তাঁদের হত্যার অজস্র ঘটনা চট্টগ্রামে মুখে মুখে ফেরে। পরে বিএনপি-তে যোগ দিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হয়েছিলেন সাকা চৌধুরী। আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আদালত দোষী সাব্যস্ত করে প্রাণদণ্ড দিয়েছিল তাঁকে। পরে তা কার্যকরও করা হয়। তাঁর পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর নামে ছাত্রাবাসের নামকরণের খবর বাংলাদেশের প্রথম সারির কোনও জাতীয় সংবাদমাধ্যম প্রকাশ করেনি।
শনিবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট এই সভাটি ডেকে নামবদলের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ হাসিনা এবং বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছার নামে আবাসিক ছাত্রাবাসগুলির নাম বদলে যথাক্রমে শহিদ মোহাম্মদ ফারাদ হোসেন হল, বিজয় ২৪ হল এবং নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী হল করা হয়। আবু ইউসুফ ভবনের নাম হয়েছে শহিদ হৃদয়চন্দ্র তরুয়া ভবন। এ ছাড়া শেখ কামাল জিমনাসিয়ামের নাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জিমনাসিয়াম এবং বঙ্গবন্ধু উদ্যানের নাম জুলাই বিপ্লব উদ্যান করা হয়েছে। সঙ্গে নতুন গড়ে ওঠা ছাত্রাবাসটির নাম দেওয়া হয়েছে ফজলুল কাদের চৌধুরীর নামে, পাকিস্তান আমলে যিনি জাতীয় পরিষদের স্পিকার, এমনকি ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্বও পালন করেছিলেন। ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হিসাবে পরিচিত ফকা চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের কট্টর বিরোধী ছিলেন। চট্টগ্রামে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগী সশস্ত্র রাজাকার, আল বদর ও আল শামস বাহিনী গঠনে তিনি প্রধান ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করার পরে ১৮ ডিসেম্বর একটি জলযানে চড়ে দেশ ছাড়ার সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়েন ফজলুল কাদের। তাঁর কাছ থেকে দেড় মন সোনা উদ্ধার করা হয়। ১৯৭৩-এর ১৭ জুলাই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মারা যান ফকা চৌধুরী।
এমন এক জন শীর্ষ রাজাকারের নামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসের নামকরণে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন। তাদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ফাঁসি হওয়া সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর নামে নতুন আবাসিক হলের নাম রাখা হয়েছে, যার বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংসদ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে।’ কিন্তু বাংলাদেশের প্রায় কোনও জাতীয় সংবাদ মাধ্যম ফকা চৌধুরীর নামে ছাত্রাবাসের নামকরণের খবরই করেনি। কেন? ঢাকার একটি সংবাদপত্রের শীর্ষ পদে থাকা এক সাংবাদিক জানাচ্ছেন, “ইউনূস সরকার কোন খবর পছন্দ করবে, আর কোনটা পছন্দ না করে কোনও সংবাদ সংস্থাকে ‘স্বৈরাচারের দালাল’ ট্যাগ দেবে, তা বিবেচনা করে খবর প্রকাশ করতে হয়। বাঁচার স্বার্থে এটা স্বেচ্ছা আরোপিত সেন্সরশিপ বলতে পারেন। বিশেষ করে চট্টগ্রামের খবরে সরকারের ছটফটানি বেশি। ইউনূস চট্টগ্রামের লোক, তাঁর প্রেস উইংও।” নাহিদ ইসলাম পদত্যাগ করার পরে আর এক বিতর্কিত ছাত্র উপদেষ্টা মাহফুজ আলমকে তাঁর তথ্য ও সম্প্রচার, তথ্যপ্রযুক্তি-সহ দফতরগুলির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দু’তিন দিনের মধ্যে ছাত্রদের দল আসছে। তার আগে পদ নিয়ে খেয়োখেয়ি তুঙ্গে। এ দিন কোটা-বিরোধীদের নতুন একটি ছাত্র সংগঠন আত্মপ্রকাশ করার পরেই প্রবল মারপিঠে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)