অপেক্ষা আরও দীর্ঘ হল। বাঁধনবগ্রামে চিন্তিত নিহতের পরিবার। ছবি: বিশ্বজিত্ রায়চৌধুরী।
এক শিবিরে স্বস্তি।
অন্য দিকে হতাশা।
একপক্ষ মনে করছেন, এটা তাঁদেরই নৈতিক জয়। আর এক পক্ষ ধাক্কা সামলে পরবর্তী লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত।
বুধবার সকালে কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ পাড়ুই মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ খারিজের রায় দিতেই এমন বিপরীত চিত্র ধরা পড়ল দুই শিবিরে। খবর ছড়াতেই যত সময় গিয়েছে জেলাজুড়ে তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের অনুগামীদের উচ্ছ্বাস তত লাগামছাড়া হয়েছে। চওড়া হাসি ফুটেছে অভিযুক্ত নেতা-কর্মীদের মুখে। উল্টো দিকে ততটাই মুষড়ে পড়েছে নিহত সাগর ঘোষের পরিবার। দিনভর ফোন বেজে গিয়েছে। আত্মীয়, পরিচিতেরা এমনকী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও উদ্বিগ্ন হয়ে খোঁজ নিয়েছেন। পাশে থাকার বার্তাও অনেকের থেকে এসেছে। দিনের শেষে ডিভিশন বেঞ্চের এ দিনের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করার ব্যাপারে আরও মনোবল শক্ত করেছে সাগরবাবুর পরিবার।
এ দিন সকাল থেকে একটা বিষয় নিয়েই বাজার ছিল সরগরম। কেষ্টদা বনাম হৃদয় ঘোষ মামলার ফল কী হয়, তা নিয়ে চায়ের দোকান থেকে হাটবাজার— সর্বত্রই জোর চর্চা শুরু হয়েছিল। শাসক দলের কর্মী-সমর্থকেরা বিভিন্ন দলীয় কার্যালয়ে ভিড় জমান। তাঁদের চোখ টেলিভিশনে খবরের চ্যানেলে। বোলপুর শহর থেকে লাগোয়া পাড়ুইয়ের কসবা পঞ্চায়েত এলাকা, চিত্রটা ছিল এক।
এ দিকে, বেলা ১১টার পর থেকেই কসবা অঞ্চলে জটলা ও ভিড় পাতলা হতে শুরু করে। তত ক্ষণে ডিভিশন বেঞ্চে সাগরবাবুর খুনে সিবিআই তদন্তের আগের নির্দেশ খারিজ করে দিয়েছে। রায় বের হওয়ার পরে বিক্ষুব্ধ তৃণমূলদের (বর্তমানে তাঁরা বিজেপি-তে নাম লিখিয়েছেন) দখলে থাকা কসবা পঞ্চায়েত অফিসে গিয়ে দেখা গেল বিজেপি প্রধান শঙ্করী দাস নেই। জানা গেল নবান্ন করতে তিনি বাপের বাড়িতে গিয়েছেন। ফোনে ধরা হলে তিনি বলেন, “এলাকার মানুষ চাইছিলেন হাইকোর্ট সিবিআই তদন্তের উপর যেন শিলমোহর দেয়। কিন্তু তা হল না। এতে আমরা হতাশ হয়েছি ঠিকই। তবে, বিচার ব্যবস্থার প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্থা রয়েছে।” তাঁর আশা, নিহত সাগরবাবুর পরিবার ন্যায্য বিচার পাবে।
নিহত সাগরবাবুর ছেলে হৃদয় ঘোষের রাজনৈতিক সঙ্গী শঙ্করীদেবী এমন মনে করলেও এ দিনের রায়কে সাগরবাবুর পরিবারের হার বলেই মনে করছে বাসিন্দাদের একাংশ। পঞ্চায়েত দফতরের পাশের বাজারের (যেখানে অনুব্রত পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারে এসে সেই বিতর্কিত বক্তৃতা দিয়েছিলেন) এক সব্জি বিক্রেতা যেমন বলছেন, “আমরা গাঁয়ের মানুষ। অত সব বুঝি না। তবে, হাইকোর্ট যখন সিবিআই তদন্তে না বলে দিয়েছে, তখন তো কেষ্টদারই জিত হয়েছে। হৃদয় ঘোষ হেরেছে। এটুকুই বলতে পারি।” কসবা থেকে নিহত সাগরবাবুর বাড়ি বাঁধ নবগ্রামে যাওয়ার পথে কয়েক জন চাষির দেখা মিলল। মাঠের ধান তুলতে ব্যস্ত ওই চাষিরা আবার বললেন, “আদালতের রায়ে হৃদয় ঘোষরা হেরেছে। তৃণমূল আবার জিতে গিয়েছে!” এর উল্টো সুর শোনা গেল বাঁধ নবগ্রামে গিয়ে। চায়ের দোকানে গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে এক প্রৌঢ়ের অভিমত, “সুপ্রিম কোর্টে গেলে দেখবেন এই রায় ঠিক উল্টে যাবে। সারদা মামলার ক্ষেত্রেও দেখেছি। হৃদয়দের চিন্তার কোনও কারণ নেই।” একটা বড় অংশের এলাকাবাসী কিন্তু ন্যায় বিচারের জন্য নিহত সাগরবাবুর পরিবারকে দেশের শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার পরামর্শই দিচ্ছেন।
এ দিনের রায়ের পরে অবশ্য সাগরবাবুর খুনে ঘটনার রাতে পুলিশ যাঁদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল, সেই রায় ও ঘোষ পরিবার এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। যদিও পাড়ুই মামলার সঠিক তদন্তের জন্য তাঁরাই প্রথম হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। এ দিন দুই পরিবারের বাড়ির দরজা বন্ধ ছিল। বাইরে থেকে ডেকে কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি। এ দিকে, রায়ের খবর পেয়ে দৃশ্যতই হতাশ হয়ে পড়েছে সাগরবাবুর পরিবার। এ দিন বাঁধ নবগ্রামের বাড়িতে বসে হতাশার কথা স্পষ্ট করেছেন হৃদয়বাবু নিজেই। অন্য দিন সকাল ১১টার মধ্যে রান্নার কাজ শেষ হলেও এ দিন রায় শুনে আর ঘরে হাড়ি চড়েনি। বাড়ির চৌকাঠের পাশে দাঁড়িয়ে নিহতের স্ত্রী সরস্বতী ঘোষ ক্ষোভের সুরে বলেন, “হাইকোর্ট সিবিআই তদন্তে না বলেছে। তার মানে বিচারপতিদের এই রাজ্যের পুলিশের উপরে এখনও আস্থা রয়েছে। কিন্তু আমরা তো স্বামীর খুনের ন্যায্য বিচার চেয়েছিলাম। সেটা যে এই পুলিশ করবে না, সেটা সবাই জানেন।” তাঁর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে প্রতিবেশী বনলতা ঘোষ বললেন, “সবাই বলছেন, আইন আইনের পথে চলবে। অনুব্রত মণ্ডলও তা-ই বলছেন। কিন্তু আমরা কি ন্যায্য বিচার পেয়েছি? ওই ঘটনার কি আদৌ নিরপেক্ষ তদন্ত হয়েছে?” তবুও বিচার ব্যবস্থার উপর ভরসা করা ছাড়া এই মুহূর্তে কোনও রাস্তা নেই বলে তাঁর মত। হতাশ হৃদয়বাবু এবং তাঁর স্ত্রী শিবানীদেবী আবার বলেন, “বিচার ব্যবস্থার প্রতি আমাদের আস্থা রয়েছে। বাবার খুনিদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার ইচ্ছে আছে। কিন্তু সেখানে যাওয়ার আর্থিক সঙ্গতি আমাদের নেই। দেখা যাক কী হয়।”
হতাশ পরিবার ফের নতুন করে লড়াইয়ের শক্তি সঞ্চয়ে যখন ব্যস্ত, তখন এই রায় নতুন করে অক্সিজেন দিয়েছে অনুব্রতকে। চাঙ্গা হয়েছেন তাঁর অনুগামীরা। সাগরবাবুর খুনে অন্যতম অভিযুক্ত তৃণমূলের সাত্তোর অঞ্চল সম্পাদক শেখ মুস্তফার দাবি, “প্রথম থেকে বলে আসছি, ওরা মিথ্যা মামলায় আমাদের দলকে ফাঁসিয়েছে। নিরপরাধদের নাম জড়িয়েছে। মিথ্যা মামলায় আমাকে আর দলের অনেককে জেল খাটিয়েছে।” এই মিথ্যা মামলা বেশি দিন টিকবে না বলেই তিনি মনে করেন। এ দিকে, অনুব্রতর খাসতালুক বোলপুর শহরে দলের বিভিন্ন শাখা কার্যালয়ে কার্যত উত্সবের মেজাজ। ছোট বড় নেতারা সেখানে সকাল থেকে হাজির থেকেছেন। তাঁদেরই এক জনের কথায়, “খুব টেনশনে ছিলাম। অনেকেই মানত করেছিলাম। রায়ের পরে আমরা সবাই খুশি। পাড়ায় পাত পেড়ে খাওয়ানোর পরিকল্পনা করছি। কেষ্টদা অনুমতি দিলেই মাঠে নেমে পড়ব!”
হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন অভিযুক্ত নেতারাও। ক’দিন আগেই সিবিআই তলবের পরে মন্ত্রী মদন মিত্রকে অসুস্থ হতে দেখে অনেকের মধ্যেই আতঙ্ক ছড়িয়ে ছিল। এ দিনের রায়ে তাঁরা অনেকটাই স্বস্তি ফিরে পেলেন। ঘটনায় এফআইআর-এ থাকা দ্বিতীয় অভিযুক্ত তথা জেলার সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরীর প্রতিক্রিয়া, “মিথ্যা মামলায় আমাদের ফাঁসানো হয়েছে। রাজ্যের পুলিশের তদন্তে তা প্রমাণিতও। এ দিনের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে বলতে পারি, হাইকোর্ট আমাদের ওই অভিযোগকেই কার্যত মান্যতা দিল।” অন্য দিকে, রায় শোনার পর থেকেই দিনভর খোস মেজাজে থাকতে দেখা গিয়েছে অনুব্রতকে। তাঁরও দাবি, “আমরা যা বলি, তা তো আপনারা লেখেন না। তবুও বলছি, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র করে আমাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। প্রথম থেকেই আমি বলে আসছি, তদন্তে কোনও প্রভাব খাটানো হচ্ছে না। আইন আইনের পথে চলছে।” এ দিনের পরে অনুব্রতর পরামর্শ, “সবাইকে আদালতের এই রায় মানতে হবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy