বুধবার বিকেল ৩টে নাগাদ বসিরহাটে সারদা কাণ্ডে অভিযুক্ত দেবযানীকে বসিরহাট এসিজেএম আদালতে তোলা হয়। বিচারক ৯ এপ্রিল তাঁকে ফের আদালতে হাজির করানোর নির্দেশ দিয়েছেন। ছবি: নির্মল বসু।
সারদা কেলেঙ্কারিতে কারা জড়িত এবং তার থেকে কারা লাভবান হয়েছেন, তার স্পষ্ট উত্তর চায় সুপ্রিম কোর্ট। রাজ্য সরকার যদি দশ দিনের মধ্যে এর সন্তোষজনক জবাব দিতে না পারে, তা হলে সারদা মামলা সিবিআইয়ের হাতে যাওয়ার সম্ভাবনা যে বেড়ে যাবে, আজ সে কথা জানিয়ে দিল সর্বোচ্চ আদালত।
আজ সারদা-মামলার শুনানির সময় বিচারপতিরা রাজ্য সরকারের সামনে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রেখেছেন। নির্বাচনের কথা বলে ওই সব প্রশ্নের জবাব দিতে রাজ্য সরকারের তরফে চার সপ্তাহ সময় চাওয়া হয়। কিন্তু লগ্নিকারীদের দিকে তাকিয়ে রাজ্যকে ১০ দিনের মধ্যে হলফনামা জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয় বিচারপতি টি এস ঠাকুর ও বিচারপতি সি নাগাপ্পনের বেঞ্চ। ৯ এপ্রিল মামলার পরবর্তী শুনানি হবে।
সারদা মামলায় গত শুনানির দিনেও রাজ্যের তদন্ত নিয়ে কড়া মন্তব্য করেছিল সুপ্রিম কোর্ট। তার পরে এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল যে, সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হবে কি না, তা নিয়ে এ দিনই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিতে পারে সর্বোচ্চ আদালত। শেষ পর্যন্ত যদি সারদা তদন্তের দায়িত্ব সিবিআইয়ের হাতে যায়, তা হলে লোকসভা ভোটের আগে রাজ্য রাজনীতির উপরে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে, তা নিয়ে জোর জল্পনাও শুরু হয়ে যায়।
শেষ পর্যন্ত এ দিন অবশ্য সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয়নি সর্বোচ্চ আদালত। তবে সে প্রসঙ্গও উঠেছে। বিচারপতিরা সরাসরি রাজ্যের কাছে জানতে চান, কোটি কোটি টাকার এই কেলেঙ্কারিতে কারা জড়িত? কারা এর ফলে লাভবান হয়েছেন? রাজ্য কি এই বিষয়গুলি নিয়ে তদন্ত করছে? তাঁদের বক্তব্য, এটি একটি বৃহত্তর ষড়যন্ত্র। এর রহস্যমোচনে রাজ্য সরকার কী করছে? এর পরে তাঁদের মন্তব্য, যদি ইচ্ছাকৃত ভাবে এই বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা হয়, তা হলে সিবিআই তদন্তের দরকার পড়বে।
সারদা সংস্থার হয়ে সুদীপ্ত সেন কোথায়, কত টাকায় কত সম্পত্তি কিনেছিলেন, সে বিষয়ে রাজ্যের কাছে সবিস্তার রিপোর্ট চেয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। আজ সেই রিপোর্ট নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন বিচারপতিরা। তাঁরা বলেন, ওই রিপোর্টে যথেষ্ট ফাঁকফোকর রয়েছে। একই ভাবে সারদা-কাণ্ডে পুলিশ যে সব চার্জশিট পেশ করেছে, তার নমুনা দেখেও অসন্তোষ প্রকাশ করেন বিচারপতিরা। বিচারপতি ঠাকুর বলেন, সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে তদন্ত হচ্ছে। এক জন লগ্নিকারীকে কী ভাবে ঠকানো হল, কে প্রতারণা করল এখানে শুধু তার তদন্ত করে চার্জশিট পেশ হচ্ছে। বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের রহস্য উদ্ঘাটন প্রয়োজন।
রাজ্য পুলিশের তদন্তের গুণগত মান বুঝতে এর আগের দিন কিছু চার্জশিটের নমুনা পেশ করার নির্দেশ দিয়েছিল সর্বোচ্চ আদালত। আবেদনকারীদের আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য সেই সব চার্জশিট দেখিয়ে অভিযোগ তোলেন, প্রতারণা করে তোলা টাকা কোথায় গেল, কোনও চার্জশিটেই তার জবাব নেই। বিচারপতি ঠাকুর এই সময় রাজ্যের আইনজীবীকে উদ্দেশে বলেন, “এই বড় বিষয়টি চার্জশিটে অনুপস্থিত। ক্ষুদ্র পরিসরে বিষয়টি দেখা হচ্ছে। তদন্তের আসল লক্ষ্য তা হওয়া উচিত নয়।”
আদালতে উপস্থিত বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার রাজ্যের আইনজীবী সি এস বৈদ্যনাথনের মাধ্যমে আদালতকে জানান, বিধাননগর থানায় দায়ের হওয়া একটি মামলায় যে চার্জশিট পেশ হবে, তাতে এই বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের বিশদ বিবরণ থাকবে। ওই মামলার তদন্তের কাজ ৯০ শতাংশ হয়ে গিয়েছে। দু’মাসের মধ্যে সেই চার্জশিট পেশ হবে। বিচারপতি নাগাপ্পন বলেন, “সেটাই তো প্রধান মামলা হওয়া উচিত। অথচ এ বিষয়ে কোনও হলফনামাতেই একটাও কথা নেই।”
সারদা গোষ্ঠীর আর্থিক খতিয়ানের রিপোর্ট পেশ করে রাজ্য সরকারের আইনজীবী সি এস বৈদ্যনাথন জানান, সারদার মোট ২২৪টি সম্পত্তি চিহ্নিত করে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০৯টি সম্পত্তি পশ্চিমবঙ্গে। সারদার হিসেবনিকেশের সফটওয়্যার থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই জমি-বাড়ি সম্পত্তি কিনতে ৪০ কোটি টাকা খরচ করেছিল তারা। রাজ্যের বক্তব্য, তার বাইরেও নগদে ১০০ কোটি টাকা মেটানো হয়েছিল। বাকি সম্পত্তিগুলি রয়েছে প্রতিবেশী রাজ্যে। যার জন্য ব্যয় হয়েছে ৫ কোটি টাকা। আবার রাজ্যের তরফে এ-ও জানানো হয়েছে, সব মিলিয়ে জমি-বাড়ি কিনতে প্রায় ১১০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
রাজ্য সরকারের রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, পাওয়ার অব অ্যাটর্নির মাধ্যমে বহু সম্পত্তি কিনেছিলেন সুদীপ্ত সেন। এ জন্য কোথায় কত টাকা খরচ হয়েছিল, তার কোনও হিসেব মেলেনি। বাজার থেকে মোট ২৪৬০ কোটি টাকা তুলেছিল সারদা। যার ৯০ শতাংশই নগদে তোলা হয়েছে। ব্যাঙ্কের মাধ্যমে কোনও রকম লেনদেন হয়নি। এর মধ্যে ৪৭৫ কোটি টাকা লগ্নিকারীদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
রাজ্যের রিপোর্ট বিচারপতিদের যে সন্তুষ্ট করতে পারেনি, তা তাঁদের প্রশ্ন থেকেই পরিষ্কার। রিপোর্ট বলছে, গত বছরের এপ্রিল থেকে তদন্ত শুরু হয়েছে। কিন্তু রাজ্য যে সব তথ্য পেশ করছে, সেগুলি সারদার সফ্টওয়্যার থেকে পাওয়া। বিচারপতিরা প্রশ্ন তোলেন, “পুলিশ নিজে কী করেছে? যাদের কাছ থেকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নির মাধ্যমে সম্পত্তি কেনা হয়েছিল, তাদের কাছ থেকে তথ্য জোগাড়ের চেষ্টা হয়নি কেন?” রাজ্যের আইনজীবী যুক্তি দেন, কেউ প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়নি। বিচারপতিদের প্রশ্ন, “পুলিশ নিজে গিয়ে কেন তাঁদের বয়ান নথিভুক্ত করেনি? যদি ১১০ কোটি টাকার সম্পত্তি কেনা হয়ে থাকে, তা হলে বাকি টাকা কোথায়?” রাজ্যের তরফে বলা হয়, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রতারণার দাবিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্ত শেষ করতে পুলিশকে মে মাস পর্যন্ত সময় দেওয়া হোক। বিচারপতিরা সেই আবেদন নাকচ করে দেন।
রাজ্য সরকারের আইনজীবী আজ আদালতে অভিযোগ তুলেছেন, সিবিআই তদন্ত দাবির পিছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। এক জন আবেদনকারী কংগ্রেসের প্রার্থী হয়েছেন।
আবেদনকারীদের আইনজীবী কলকাতার মেয়র ছিলেন। বিকাশবাবু জবাব দেন, “মেয়র ছিলাম বলে কি মামলা লড়তে পারি না? কোনও আবেদনকারীই কংগ্রেসের প্রার্থী হননি।” বিচারপতি ঠাকুর মন্তব্য করেন, “রাজনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও তা নিয়ে আলোচনার এটা আদর্শ সময় নয়। বাইরে নির্বাচনী যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে।” পশ্চিমবঙ্গে ভোটগ্রহণ কবে কবে, সে বিষয়েও জানতে চান তিনি।
বিচারপতিরা জানতে চান, কত দিনের মধ্যে রাজ্য হলফনামা পেশ করতে পারবে? রাজ্যের যুক্তি ছিল, নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। চার সপ্তাহ সময় লাগবে। তদন্তকারীদের অনেকেই ভোটের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। বিকাশবাবু বলেন, এই তদন্তের সঙ্গে ভোটের সম্পর্ক নেই। রাজ্য সিবিআই তদন্তে ভয় পাচ্ছে। তাই সময় নষ্ট করছে। বিচারপতিরা জানান, সারদার তদন্তকারীদের যাতে আইন-শৃঙ্খলার দায়িত্ব না দেওয়া হয়, তার নির্দেশ দেওয়া হবে।
প্রতারিতদের টাকা ফেরত দেওয়ার বিষয়ে কী কী করা হয়েছে, আজ সুপ্রিম কোর্টে শ্যামল সেন কমিশনের তরফে তা জানানো হয়। বিচারপতিরা জানান, কমিশন ভাল কাজ করে থাকতে পারে। সেটা এখানে বিচার্য নয়। বিচারপতি ঠাকুর বলেন, “সুপ্রিম কোর্ট শ্যামল সেন কমিশনের কাজে কোনও বাধা দিচ্ছে না। আমরা সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিলে একটাই পার্থক্য হবে। কলকাতা হাইকোর্ট তখন রাজ্য পুলিশের বদলে সিবিআই তদন্তে নজরদারি করবে।”
এ দিনই সারদার কাছে প্রতারিত ১০ হাজার লোকের তরফে একটি আবেদনে সিবিআই তদন্তের বিরোধিতা করা হয়। আবেদনকারীদের আইনজীবী পি ভি শেট্টি বলেন, সিবিআই-কে তদন্তভার দিলে গোটা প্রক্রিয়া পিছিয়ে যাবে। প্রতারিতদের টাকা ফেরত পেতে সমস্যা হবে। বিচারপতি ঠাকুর প্রশ্ন করেন, সিবিআই তদন্ত হলে এই প্রতারিতদের সমস্যা কোথায়? সত্যিই প্রতারিতরা এই আবেদন করছেন কি না, সেই প্রশ্নও তোলেন তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy