বাজেয়াপ্ত হওয়া গাড়ি এ ভাবেই নষ্ট হচ্ছে। ছবি: শৌভিক দে
মার্সিডিজ বেন্জ-এর সেডান গাড়িটার নম্বর এইচ আর ১০-৩৪৩৪। কোনও এক সময়ে গাড়িটার রং ছিল দুধসাদা। মাস কয়েক ধরে নিউটাউনের এক আবাসনের চৌহদ্দিতে পড়ে থেকে তার উপর পুরু ধুলোর আস্তরণ জমছে। এতটাই যে, গাড়িটার আসল রং বোঝার উপায় নেই।
লাল সাদা রঙের মিৎসুবিশি প্যাজেরো। যার নম্বর ডব্লিউ বি ২৬ কে-৯০৬৪। প্রায় দশ মাস ধরে সল্টলেকের সেক্টর ফাইভে ইলেকট্রনিক কমপ্লেক্স থানার সামনের মাঠে রোদে পুড়ছে, জলেও ভিজছে ওই এসইউভি। ফাটা চাকার মধ্যে মাটি জমতে জমতে তাতে গজিয়ে ওঠা গাছ বেড়ে উঠে ইঞ্জিন পর্যন্ত পৌঁছেছে।
শুধু ওই দু’টি গাড়ি নয়, একই অবস্থা আরও ১৯টি গাড়ির। মার্সিডিজ বেন্জ-এর মতো জার্মান কিংবা মিৎসুবিশির মতো জাপানি গাড়ির পাশাপাশি জাগুয়ার-এর মতো ব্রিটিশ গাড়িও সেই সারিতে রয়েছে।
এ সব গাড়ির মালিক সারদা সংস্থা। আমানতকারীদের কাছ থেকে প্রায় ২৪০০ কোটি টাকা তুলে আত্মসাতের অভিযোগে সংস্থার কর্নধার সুদীপ্ত সেন গত এক বছর যাবৎ পুলিশি হেফাজতে। কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকা থেকে সারদা সংস্থার মোট ৬৪টি গাড়ি বাজেয়াপ্ত করে পুলিশ। সরকারি হিসেবে, সময় মতো ওই সব গাড়ি বিক্রি করা গেলে প্রায় ৯ কোটি টাকা পাওয়া যেত। কিন্তু তার বদলে গাড়িগুলি পড়ে থেকে থেকে নষ্ট হচ্ছে এবং স্বাভাবিক ভাবেই সেগুলির দাম-ও কমছে বলে সরকারি সূত্রের খবর। এক পুলিশ অফিসারের কথায়, “পড়ে থেকে থেকে ওই গাড়িগুলোর এখন যা দশা হয়েছে, তাতে সাধারণ লোহালক্কড়ের দামেও বিকোবে কি না সন্দেহ রয়েছে।”
সুদীপ্ত সেনের স্ত্রী পিয়ালি ও পুত্র শুভজিৎকে এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট গ্রেফতার করার পর যেমন সারদা কেলেঙ্কারির তদন্ত করার ক্ষেত্রে রাজ্যের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ উঠেছে, তেমনই রাজ্যের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সারদার বাজেয়াপ্ত গাড়িগুলো নিলামের ব্যাপারে গড়িমসি করার ক্ষেত্রেও।
সারদা কেলেঙ্কারির ঘটনা সামনে আসার পর রাজ্য সরকার বিচারপতি শ্যামলকুমার সেনের নেতৃত্বে তদন্ত কমিশন গঠন করে। আর তদন্তের কাজে কমিশনকে সাহায্য করার জন্য বিশেষ তদন্তকারী দল বা স্পেশ্যাল ইনভেস্টিগেশন টিম (সিট) গঠিত হয়। বাজেয়াপ্ত ওই গাড়িগুলির কাগজপত্র দেখার ভার দেওয়া হয়েছিল সিট-কে। দ্রুত ওই সব গাড়ি নিলাম করতে চেয়েছিল কমিশন।
কিন্তু তাড়াতাড়ি তো দূরে থাক, এক বছর পেরোতে চললেও গাড়ি নিলামের কাজ একচুলও এগোয়নি।
কেন? কারণ হিসেবে সারদার তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি শ্যামলকুমার সেন পুলিশের ঢিলেমিকেই দায়ী করছেন। তিনি জানান, বিষয়টি নিয়ে সিট-কে কমিশনের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে, এমনকী, সিট-এর প্রধান তদন্তকারী অফিসার তথা বিধাননগরের কমিশনারকে মৌখিক ভাবেও বিষয়টি জানানো হয়েছে। ফের এই ব্যাপারে তাঁদের চিঠি দেওয়া হচ্ছে বলে বিচারপতি সেন জানিয়েছেন।
বিচারপতি সেনের কথায়, “গাড়িগুলি এত দিন ধরে ফেলে রাখা উচিত হচ্ছে না। দ্রুত নিলাম করা দরকার। এই ব্যাপারে একাধিক বার বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে।”
তার পরেও পুলিশ ব্যবস্থা নিল না কেন? শ্যামল সেন বলেন, “পুলিশ কাজটা ফেলে রেখে দিচ্ছে। ওরা নাকি অন্য কাজে ব্যস্ত।” ক্ষুব্ধ শ্যামলবাবুর বক্তব্য, “এটাও (গাড়িগুলো নিলামের ব্যবস্থা করা) তো একটা কাজ। অথচ সেগুলো পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টা ভাবা দরকার।” শ্যামলবাবুর বক্তব্য, কমিশনের কাছে সুদীপ্ত সেন জানিয়েছেন, দেশ জুড়ে ছড়ানো তাঁর সংস্থার বিভিন্ন অফিসে চারশোরও বেশি গাড়ি রয়েছে এবং যার আর্থিক মূল্য কয়েক কোটি টাকা।
বিধাননগর কমিশনারেটের এক অফিসার তথা সিট-এর এক সদস্য বলেন, “সারদা সংস্থার অধিকাংশ গাড়ি কেনা হয়েছিল ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে। নিলাম করার ক্ষেত্রে সেখানে বাধা রয়েছে। এই ধরনের সম্পত্তি নিলাম করার আগে আইনি জটিলতা থেকে মুক্ত হওয়া দরকার।” এই সব কাজের জন্য গাড়িগুলি নিলামের ব্যবস্থা করতে দেরি হচ্ছে বলে ওই অফিসারের দাবি।
কমিশন অবশ্য ওই যুক্তি মানতে নারাজ। কমিশনের মতে, ইতিমধ্যেই ৪৪টি গাড়ির ক্ষেত্রে আইনি জটিলতা দূর হয়ে গিয়েছে এবং সেগুলি বিক্রি করার ক্ষেত্রে কোনও বাধা নেই। তাই, মূলত পুলিশের ঢিলেমিকেই দায়ী করছে কমিশন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy