সারদার বিরুদ্ধে প্রথম এফআইআরটি দাখিল করেছিলেন যিনি, সারদা-কাণ্ডের তদন্তে নেমে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টোরেট (ইডি) এ বার সেই অর্পিতা ঘোষকে ডেকে পাঠাল। অর্পিতা লোকসভা নির্বাচনে বালুরঘাট কেন্দ্রে তৃণমূলের টিকিটে দাঁড়িয়েছেন। পাশাপাশি ইডি’র তদন্তকারীরা ইতিমধ্যে জেরা করেছেন রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি রজত মজুমদারকে, যিনি অবসরগ্রহণের পরে একটা সময় সারদার ‘নিরাপত্তা উপদেষ্টা’ হিসেবে যেমন কাজ করতেন, তেমন তৃণমূল ঘনিষ্ঠ হিসেবে পালন করতেন দলের বিবিধ দায়িত্ব। এমনকী, কখনও-সখনও তৃণমূল ভবনেও বসতেন রজতবাবু।
ইডি যে তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছে, অর্পিতা অবশ্য রবিবার নিজের মুখে তা জানিয়েছেন সাংবাদিক সম্মেলন করে। এ দিন বালুরঘাটের দলীয় কার্যালয়ে বসে তিনি বলেন, “সংবাদপত্রে খবর দেখে আমি ইডি-র অফিসে যোগাযোগ করে জানতে পারি, তিন দিন আগে তাঁরা আমার শিশু-কিশোর অ্যাকাডেমিতে চিঠি পাঠিয়েছে।” কিন্তু তাঁকে কেন ডাকা হচ্ছে?
অর্পিতার ব্যাখ্যা, “আমি যে চ্যানেলের দায়িত্বে ছিলাম, তার হিসেবপত্র ও চ্যানেলের অনুমোদন সংক্রান্ত ইনফর্মেশন ব্রডকাস্টিং মন্ত্রকের নথি দেখতে চেয়েছে ইডি। মৌখিক ভাবে ওদের জানিয়েছি যে, আমি সারদার চ্যানেলটির একজিকিউটিভ এডিটর ছিলাম। তাই চ্যানেলের হিসেবপত্র সম্পর্কে কোনও তথ্য আমার কাছে থাকার কথা নয়। সংস্থার কর্র্মী হওয়ার সুবাদে চ্যানেল চালুর অনুমতি সংক্রান্ত নথিও আমার কাছে নেই।” অর্পিতার এ-ও মন্তব্য, “ওই চ্যানেলের সহকর্মীদের হয়ে আমি-ই সারদার বিরুদ্ধে প্রথম এফআইআর করেছি। আর তারই ভিত্তিতে সুদীপ্ত সেন ধরা পড়েছেন।”
কবে তিনি ইডি-র তদন্তকারীদের সঙ্গে দেখা করবেন? অর্পিতা জানান, আগামী ২৪ এপ্রিল বালুরঘাটে ভোট। পরের দিন, অর্থাৎ ২৫ তারিখে তিনি ইডি-অফিসে যাবেন।
পাশাপাশি এ দিন সারদা-প্রসঙ্গে বিরোধীদেরও এক হাত নিয়েছেন বালুরঘাটের তৃণমূল প্রার্থী। তাঁর অভিযোগ, সিপিএমের দৈনিক মুখপত্রে তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা করা হচ্ছে। বিজেপি-ও কুৎসা করছে। দু’পক্ষের নামে এ দিন নির্বাচন কমিশনে নালিশ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্পিতা। তাঁর দাবি, সিপিএমের জেলা সম্পাদক মানবেশ চৌধুরীও তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার করেছেন, যে কারণে মানবেশবাবুর নামেও তিনি মামলা করবেন। এ ব্যাপারে এ দিন মানবেশবাবুর প্রতিক্রিয়া, “সত্যি কথা বলার জন্য যে কোনও মূল্য দিতে আমি রাজি।”
এ দিকে অর্পিতাকে ডাক পাঠানোর আগে, গত বৃহস্পতিবারই রজতবাবু পড়েছেন ইডি’র জিজ্ঞাসাবাদের মুখে। ইডি-সূত্রের খবর, রজতবাবুর কাছে জানতে চাওয়া হয়, সারদার সঙ্গে তিনি কী ভাবে, কতটা যুক্ত ছিলেন, এবং সংস্থার অর্থকরী বিষয় সম্পর্কে তিনি কতটা অবহিত। জবাব কী মিলেছে?
ইডি’র দাবি: রজতবাবু বলেছেন, লাস ভেগাসে ২০১২-র বঙ্গ সম্মেলনে পৃষ্ঠপোষক হওয়ার জন্য তিনিই সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত সেনকে অনুরোধ করেছিলেন। অনুদান হিসেবে অনুষ্ঠানটিতে সারদা অনেক টাকা দিয়েছিল। তিনি কেন সুদীপ্তকে এমন অনুরোধ করলেন, সে প্রশ্নের জবাবে রজতবাবুর ব্যাখ্যা, ‘নর্থ আমেরিকা বেঙ্গলি কনফারেন্স’-এর চেয়ারম্যান হিসাবে তিনি সুদীপ্তের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কথা ছিল, অনুষ্ঠানটি সুসম্পন্ন করতে সারদা তিন কোটি টাকা দেবে। রজতবাবুর এ-ও দাবি, পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়ে সারদা ও ‘নর্থ আমেরিকা বেঙ্গলি কনফারেন্স’-এর মধ্যে তিন বছর মেয়াদের (২০১২-২০১৪) চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু চুক্তি মোতাবেক টাকা না-পেয়ে কনফারেন্স সেটি বাতিল করে দেয়।
ইডি-র জেরাপর্ব প্রসঙ্গে এ দিন রজতবাবু বলেন, “আমি ইডি-কে বলেছি, ওই লেনদেন নগদে হয়নি। সারদার চেক জমা পড়েছিল এক বেসরকারি ব্যাঙ্কে। তার প্রমাণও দিয়েছি।” সারদার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের সূত্রপাত প্রসঙ্গে রজতবাবু জানান, ২০১১-র মে মাসে বেঙ্গলি কনফারেন্সের স্পনসরশিপ নিয়ে আলোচনার সময়েই সুদীপ্ত তাঁকে সারদার নিরাপত্তা-উপদেষ্টা পদে নিয়োগ করতে চেয়েছিলেন। “সংস্থার নানা অনিয়ম দেখে আমি সুদীপ্তবাবুকে বার বার সতর্ক করার চেষ্টা করেছি। তাতে কাজ না-হওয়ায় এগারো মাস বাদে, অর্থাৎ ২০১২-র এপ্রিলে আমি পদত্যাগ করি।” এ দিন বলেন রজতবাবু।
রজতবাবুর বক্তব্য অনুযায়ী, সারদার বিভিন্ন অনিয়মের কথা তিনি জেনেছিলেন ২০১২ সালে। অথচ তার পরেও তৃণমূলের বিভিন্ন নেতার সঙ্গে সারদার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল বলে ইডি-র তদন্তকারীরা দাবি করছেন। ২০১৩-র ১৬ এপ্রিল সারদার বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ (অর্পিতার তরফে) দায়ের হয়। আর ২০১২-য় সারদা সংস্থার চাকরি ছাড়ার পর থেকে ওই সময় পর্যন্ত রজতবাবু তৃণমূল ভবনেই বসতেন। তাই প্রশ্ন উঠছে, সারদার যে অনিয়মের কথা তিনি এখন বলছেন, তখন কি তা তৃণমূল নেতাদের জানানো হয়নি?
এ দিন রজতবাবুর জবাব, “আমি কোনও কালেই তৃণমূলের কোনও পদে ছিলাম না। এখনও নেই।” তা হলে তিনি তৃণমূল ভবনে বসতেন কেন?
রজতবাবুর কাছ থেকে এর কোনও ব্যাখ্যা অবশ্য মেলেনি। অন্য দিকে ইডি-সূত্রের ইঙ্গিত, সারদা-তদন্তের অঙ্গ হিসেবে ‘তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ’ শিল্পী শুভাপ্রসন্নকেও ডাকা হতে পারে। এ নিয়ে জানতে চাওয়া হলে শুভাপ্রসন্নবাবু এ দিন বলেন, “আমার তৈরি একটি টেলিভিশন চ্যানেল বিক্রির লেনদেন সম্পর্কে ইডি আমার কাছে তথ্য চেয়েছিল অনেক আগেই। সে সব ইতিমধ্যে ওদের জানিয়ে দিয়েছি।”
তাই ওঁকে ফের ডাক পাঠানোর কোনও কারণ নেই বলে এ দিন দাবি করেছেন শুভাপ্রসন্ন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy