সারদা মামলা নিয়ে শনিবারই কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমকে আক্রমণ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁরই নির্দেশে রবিবারের ভোট বাজারে সেই আক্রমণ আরও তীব্র করল তাঁর দল। সারদা তদন্তে ইডি-র সক্রিয়তাকে সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক চক্রান্ত হিসেবে ব্যাখ্যা করা হল। প্রশ্ন তোলা হল, চিদম্বরমের স্ত্রী-পুত্রের বিরুদ্ধে কেন তদন্ত হচ্ছে না।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তদন্তে গতি আসায় ভোটের মরসুমে হঠাৎই ফের শিরোনামে সারদা কেলেঙ্কারি। তাতেই নতুন করে অস্বস্তিতে পড়েছে তৃণমূল। দলীয় কার্যালয় থেকে শুরু করে প্রচারের মাঠ-ময়দান, সর্বত্রই এ দিন দলীয় নেতৃবর্গের আক্রমণের নিশানা ছিলেন চিদম্বরম। বিরোধীরা অবশ্য মনে করছেন, এই ভাবে চিদম্বরমের বিরুদ্ধে চক্রান্তের অভিযোগ তুলে আসলে নিজেদেরই মুখরক্ষার রাস্তা খুঁজছে শাসক দল।
এ দিন তৃণমূল ভবনে সাংসদ ডেরেক ও ব্রায়েনকে পাশে বসিয়ে দলের মুখ্য জাতীয় মুখপাত্র অমিত মিত্র প্রশ্ন তোলেন, সিবিআই-কে লেখা সুদীপ্ত সেনের চিঠিতে চিদম্বরমের স্ত্রীর নাম থাকা সত্ত্বেও কেন তা নিয়ে তদন্ত হচ্ছে না। টু-জি দুর্নীতিতে যুক্ত থাকা চিদম্বরমের পুত্রের বিরুদ্ধেই বা কেন তদন্ত হল না। অমিতবাবুর বক্তব্য, “তত্ত্বাবধায়ক সরকারে চিদম্বরমের ভিআরএস নিতে আর ২৬ দিন বাকি। তার মধ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ইডি-কে ব্যবহার করছেন উনি।” চিদম্বরমের স্ত্রী, আইনজীবী নলিনীর কাছে কংগ্রেসের এক প্রাক্তন মন্ত্রীর স্ত্রী ৪২ কোটি টাকার ‘ডিল’ নিয়ে গিয়েছিলেন বলে অভিযোগ অমিতবাবুর। ওই চুক্তির নথি তৈরি করতে নলিনী এক কোটি টাকা নিয়েছিলেন বলেও দাবি করেন তিনি। অমিতবাবু বলেন, “টু-জি দুর্নীতিতে জড়িত সংস্থাগুলি নিয়ে গোটা একটি দিন সংসদে আলোচনা হল। ওই সংস্থাগুলির মধ্যে একটির মালিক চিদম্বরমের পুত্র। সে ব্যাপারে ইডি তদন্ত করছে না কেন?”
তৃণমূলের অভিযোগের জবাবে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেন, “চিদম্বরম যদি স্ত্রী-পুত্রকে আড়াল করতেই চাইতেন, তা হলে সারদা তদন্তই হতে দিতেন না। যদি কেলেঙ্কারিতে তৃণমূল জড়িত নাই থাকবে, তা হলে তদন্তে ওদের এত ভয় কেন?” মুর্শিদাবাদে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেন, “সারদার লক্ষ-কোটি টাকা সব গেল কোথায়? উত্তর নেই। কারা নিয়েছে? উত্তর নেই। কত সৎ আমাদের সব জানা আছে। সব বেরোবে।”
শনিবার রাজ্যে এসে সারদা-কেলেঙ্কারিতে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য পদক্ষেপ না করে সরকার অভিযুক্তদের বাঁচানোর চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ করেছিলেন রাহুল গাঁধীও। রাহুলের এই মন্তব্য তাঁর ‘অজ্ঞতা’ বলে মন্তব্য করে এ দিন অমিতবাবু বলেন, “সাড়ে ১৭ লক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত যে টাকা পাওয়ার জন্য আবেদন করছেন, তা কি রাহুল জানেন না! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য ইতিমধ্যেই অর্থ দফতর ১৬৫ কোটি টাকা দিয়েছে। এটা পৃথিবীর কোথাও হয়নি।”
কিন্তু সারদা নিয়ে দীর্ঘ দিন তদন্ত করেও রাজ্য সরকারের বিশেষ তদন্তকারী দল সুদীপ্ত সেনের স্ত্রী ও পুত্রের নাগাল পায়নি। ইডি কী করে পেল? জবাব এড়িয়ে অমিতবাবু বলেন, “সিট নিজের কাজ করছে। তবে রাজ্যের হাতে আইনি পদক্ষেপের ক্ষমতা নেই। সে জন্য রাজ্য সরকার যে বিলটি তৈরি করেছিল, তা রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য পাঠানো হয়েছে।” ওই বিলে যাতে দ্রুত রাষ্ট্রপতি সম্মতি দেন, সে জন্য কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে শনিবার ফের রাজ্য সরকার অনুরোধ করবে বলে জানান তিনি।
চিদম্বরমকে চক্রান্তকারী হিসেবে তুলে ধরার এই সুরটি শনিবার মমতাই বেঁধে দিয়েছিলেন। ‘যদি সাহস থাকে আমাকে টাচ করে দেখুন’ বলে হুমকি দিয়েছিলেন। আক্রমণের সুর চড়িয়ে তুইতোকারিতেও চলে গিয়েছিলেন। এ দিনের নির্বাচনী সভায় মুকুল রায়, মদন মিত্রদের বক্তৃতাতেও চিদম্বরমই ভিলেন থাকলেন। দক্ষিণ দিনাজপুরের তপনে এক সভায় মুকুল অভিযোগ করেন, অসমের কংগ্রেস নেতা হেমন্ত কিস্কু এবং চিদাম্বরমের স্ত্রী চিটফান্ড কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে রয়েছেন। “কেন ওঁদের সিবিআই ডাকছে না? রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ইডি-কে সামনে রেখে আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে।” মুকুল প্রশ্ন তোলেন, “টু-জি স্পেকট্রামে ১ লক্ষ ৭৬ হাজার কোটি টাকা চুরি হয়েছে। এর কতটা ভাগ গিয়েছে রাহুল গাঁধীর বাড়িতে? আর কতটা ভাগ গিয়েছে সনিয়া গাঁধীর বাড়িতে?” এঁদের কেন ইডি ডেকে পাঠাবে না বা সিবিআই তদন্ত করবে না, প্রশ্ন করেন মুকুল। অর্পিতা ঘোষকে যে ইডি ডেকে পাঠিয়েছে, তা নিয়ে মুকুলবাবু বলেন, “অর্পিতার সম্পর্কে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল অপপ্রচার করেছে। তাঁকে কুণাল ঘোষের বোন বলা হচ্ছে বলে শুনেছি। এ বিষয়ে নির্বাচনী পর্যবেক্ষককে জানালাম। নির্বাচন কমিশনকেও জানানো হয়েছে।”
আর এক ধাপ এগিয়ে এ দিন রাষ্ট্রপতির পরিবারের বিরুদ্ধেও সারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগ তুলেছেন পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র। কেতুগ্রামের সভায় এ দিন মদনবাবু বলেন, “সারদা গোষ্ঠীকে টাকা তোলার অনুমতি কে দিয়েছে? ইডি হিম্মত থাকলে তা বের করুক। যারা অনুমতি দিয়েছে, তাদের মধ্যে রিজার্ভ ব্যাঙ্কও রয়েছে। তা হলে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরকে গ্রেফতার করা হবে না কেন? ভারতের সর্বোচ্চ পদে যিনি রয়েছেন, তাঁর ছেলেমেয়েরাও বীরভূমের মাটি থেকে সারদার টাকা নিয়েছেন। তাঁরা কত টাকা নিয়েছেন, তা-ও ঘোষণা করতে হবে।”
কিন্তু মন্ত্রীর নিজের নাম যে সারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছে, তার কী হবে? এ দিন পরিবহণমন্ত্রী বলেন, “সারদা গোষ্ঠীর সঙ্গে আমার কোনও যোগাযোগ ছিল না। তাঁর নাকি স্ত্রী পিয়ালি সেন, তাঁর নাকি থাকার ব্যবস্থা আমি করে দিয়েছি। বাপের ব্যাটা হয়ে থাকলে, মায়ের দুধ খেয়ে থাকলে প্রমাণ করে দেখা। প্রমাণ করতে পারলে নাকখত দেব, মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেব। না হলে ৫০ কোটি টাকার মামলা করব।”
সারদা মামলাই তৃণমূলের পতনের অনুঘটক হবে বলে মনে করছে বিজেপি। দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ জানিয়েছেন, রাজ্য না চাইলেও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সিবিআই তদন্ত হবে। রাহুলবাবুর কথায়, “রাজ্যে চিটফান্ডের জন্ম সিপিএমের জমানায়। কিন্তু তাদের লালন-পালন করেছে বর্তমান সরকার।” কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বিজেপির যত সমালোচনাই থেকে থাকুক, মমতা যে ভাষায় চিদম্বরমকে আক্রমণ করেছেন, বিজেপি তা সমর্থন করে না বলেও জানিয়েছেন রাহুল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy