নরেন্দ্র মোদী প্রশ্ন তোলার ৪৮ ঘণ্টা পরেও ছবি-বিতর্কের অবসান হল না! বরং রাজ্যে তৃতীয় দফার ভোটের আগের দিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি বিক্রির রহস্য আরও ঘনীভূত হল সিপিএম নেতা গৌতম দেবের অভিযোগে।
রাজ্যে প্রচারে এসে বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী মোদী প্রশ্ন তুলেছিলেন, মমতার ছবি ১ কোটি ৮০ লক্ষ টাকায় বিক্রি হয় কী করে? কে কিনেছিল ওই দামে ছবি? তার জবাব দিতে গিয়ে সোমবার মোদীকে পাল্টা আক্রমণ করেছিলেন মুকুল রায়, অমিত মিত্রের মতো তৃণমূল নেতারা। মুখ্যমন্ত্রীর ছবির প্রদর্শনী বাবদ আয় এবং সেই টাকা আবার কোথায় কাকে দেওয়া হয়েছিল, সেই সংক্রান্ত কিছু তথ্য মঙ্গলবার তৃণমূলের তরফে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মূল প্রশ্নের জবাব মেলেনি। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীও সরাসরি জবাব এড়িয়ে এ দিন বড়বাজারে প্রচারসভায় মোদীর নাম না-করে বলেছেন, “যা কানে শুনছে, তা-ই বলে দিচ্ছে! খতিয়ে দেখছে না, কী বলছে। আমিও তো কত তথ্য শুনি। যাচাই না-করে কিছু বলি না!”
আবার মুখ্যমন্ত্রীর ছবি তিনি কেনেননি বলে সোমবার দাবি করেছিলেন সুদীপ্ত সেন। এ দিন কিন্তু তৃণমূলের সাসপেন্ডেড সাংসদ কুণাল ঘোষ দাবি করেছেন, সারদা-কর্তা বয়ান বদলেছেন! ফলে, ঘটনাপ্রবাহ নাটকীয় জায়গায় পৌঁছেছে!
আয়কর দফতরে দাখিল করা তৃণমূলের হিসেবের নথি দেখিয়ে এ দিন আলিমুদ্দিনে গৌতমবাবু দাবি করেছেন, শাসক দলেরই জমা দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সেই ২০০৪ থেকে এখনও পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রীর ছবির প্রদর্শনী হয়েছে চার বার। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী-সহ তৃণমূলের নেতারা সেই প্রদর্শনী থেকে যা আয়ের হিসেব বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ্যে এনেছেন, তা যোগ করলে দাঁড়ায় প্রায় দু’কোটি টাকা। অথচ তৃণমূল দল এবং তাদের দলীয় মুখপত্রের দু’টি অ্যাকাউন্ট থেকে যে হিসেব আয়কর দফতরে জমা পড়েছে, সেখানে ছবি বিক্রি থেকে মোট আয় (২০০৪-০৫ থেকে ২০১৩-র ৩১ মার্চ পর্যন্ত) দেখানো হয়েছে প্রায় সাড়ে ১০ কোটি টাকা। গৌতমবাবুর প্রশ্ন, তা হলে এই বাড়তি সাড়ে ৮ কোটির হিসেব মিলবে কী ভাবে?
নির্বাচন কমিশনের কাছে দেওয়া তৃণমূলের তথ্যও বলছে, ২০১১-১২ এবং ২০১২-১৩, এই দু’বছরে দলনেত্রীর ছবি থেকে আয় হয়েছে ৬ কোটি ৪৬ লক্ষ ৯০০ টাকা!
পঞ্চায়েত ভোটের আগে ২০১৩-র জানুয়ারিতে শেষ বার টাউন হলে মুখ্যমন্ত্রীর ছবির প্রদর্শনী হয়েছিল। আয়কর দফতরকে দেওয়া হিসেবেই দেখা যাচ্ছে, এক বারের এই প্রদর্শনী থেকে উঠেছে ৩ কোটি ৯৩ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা। জগদ্বিখ্যাত চিত্রকরদের কাছেও যা শ্লাঘার বিষয় হতে
পারে! গৌতমবাবুর কথায়, “আগেই জানতে চেয়েছিলাম, উনি কি
পিকাসো না মাইকেল এঞ্জেলো না লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, যে ওঁর ছবি এত টাকায় বিক্রি হবে?”
আলিমুদ্দিনে গৌতমবাবু এই প্রশ্ন তোলার অব্যবহিত পরেই রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিতবাবুর উপস্থিতিতে তৃণমূল ভবনে পুরমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম এবং দলের জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও ব্রায়েন পাল্টা নিশানা করেন বিজেপি এবং সিপিএমকে। ববি বলেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি ১ কোটি ৮০ লক্ষ টাকায় বিক্রি হয়েছে বলে মোদী যে কথা বলেছেন, আজ তাঁর তোতাপাখি গৌতম দেব সে কথাই বলছেন। এটা কেউ যদি প্রমাণ করতে পারেন, আমি মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেব।’’ তাঁর কথার সূত্র ধরে ডেরেকও বলেন, “মমতাদি’র ছবি থেকে যে আয় হয়েছে, তা চেকে মেটানো হয়েছে। তার সব নথিই নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হয়েছে। মমতাদি কখনও ব্যক্তিগত লাভের জন্য কিছু করেননি।” ডেরেকের আরও মন্তব্য, “উনি (মোদী) যদি প্রমাণ করতে পারেন, ১ কোটি ৮০ লাখ টাকায় মমতাদি’র কোনও ছবি বিক্রি করা হয়েছে, তা হলে কালই আমি সাংসদ থেকে ইস্তফা দেব!’’
বিজেপি আবার পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়েছে, গরিব মানুষের টাকা যারা আত্মসাৎ করেছে, দিল্লিতে মোদীর সরকার গঠনের পরে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কলকাতা প্রেস ক্লাবের ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে এ দিন বিজেপি রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেন, “মোদীজির ঘোষণায় ভয় পেয়ে গিয়ে তৃণমূল নেতারা আবোল-তাবোল বলতে শুরু করেছেন!”
তৃণমূলের একটি সূত্রের বক্তব্য, মমতার আঁকা ছবির প্রথম প্রদর্শনী হয় স্বভূমিতে ২০০৪ সালে। সেই প্রদর্শনী থেকে প্রায় তিন লক্ষ টাকা আয় হয়েছিল। তার থেকে ৫০ হাজার টাকা স্প্যাস্টিক সোসাইটি, অধুনা ইন্ডিয়ান ইন্সস্টিটিউট অফ সেরিব্রাল পালসি-কে দান করা হয়েছিল। সংস্থার ডেপুটি ডিরেক্টর শুভ্রা চট্টোপাধ্যায়ও চেক মারফত ২০০৪ সালে ৫০ হাজার টাকা পাওয়ার কথা বলেছেন। ২০০৭ সালে জাদুঘরে মমতার ছবির প্রর্দশনী হয়। প্রায় ১১ লক্ষ টাকা আয় হয় ছবি বিক্রি করে। সেই টাকা নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলিতে নিহত ও আহতদের পরিবারকে দেওয়া হয়েছিল। এর পর ২০১১-র এপ্রিলে গ্যালারি ৮৮-এ এবং ২০১৩-র জানুয়ারিতে টাউন হলে মমতার ছবির প্রদর্শনী হয়েছিল। এই দু’টি প্রদর্শনী ছাড়া বিদেশে ২০১২-র অক্টোবরে মমতার একটি ছবি নিলাম করে প্রায় ৩ হাজার ডলার আয় হয় বলে তৃণমূল সূত্রের দাবি।
আবার সিপিএম সূত্রের বক্তব্য, ২০১২ সালের শেষ দিকে সারদা গোষ্ঠীর কিছু সংবাদমাধ্যমে সমস্যা দেখা দিয়েছিল। এর অল্প দিনের মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রীর ছবির একটি প্রদর্শনী হয়। সমস্যায় পড়া সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর অর্থসাহায্যের কথাও প্রকাশ্যে আসে। তখনই জানা যায় ১ কোটি ৮৬ লক্ষ টাকায় মুখ্যমন্ত্রীর ছবি বিক্রির কথাও। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র সেই সময় প্রশ্ন তুলেছিলেন, কে ওই ছবি কিনলেন? সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু অভিযোগ করেছিলেন, ১ কোটি ৮৬ লক্ষ টাকা দিয়ে সারদা গোষ্ঠী মুখ্যমন্ত্রীর ছবি কিনেছে।
সূর্যবাবু এ দিন ফের বলেন, “তিন বছর ধরে এই প্রশ্ন করে আসছি, মুখ্যমন্ত্রীর ছবি এত দামে কারা কিনলেন? মোদী তখন কোথায়?” পূর্ব মেদিনীপুরের কর্মিসভাতেও তিনি বলেন, “যখন উনি (মুখ্যমন্ত্রী) ১ কোটি ৮৬ লক্ষ টাকায় ছবি বিক্রি করেছিলেন, সে দিনই আমি বলেছিলাম, মুখ্যমন্ত্রীর ওই ছবি কে কিনলেন, কী ভাবে বিক্রি হল, তা সবাইকে জানানো উচিত। ১ কোটি ৮৬ লক্ষ টাকা দামের ছবি সকলের দেখার সৌভাগ্য হওয়া উচিত! আর যদি ১ কোটি ৮৬ লক্ষ টাকায় ছবি বিক্রি করেন, তা হলে তো আপনাকে আয়কর দিতে হবে।” প্রসঙ্গত সূর্যবাবু প্রথম যখন এ কথা বলেছিলেন এবং মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছিলেন, তখন মুখ্যমন্ত্রী জবাব দিয়েছিলেন আয়কর-সহ সব কিছুই ঠিক আছে।
সারদা-কর্তার দাবি নিয়েও তির্যক প্রশ্ন তুলেছেন সূর্যবাবু। তাঁর বক্তব্য, “কাগজ দেখে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছি! ওই চিট ফান্ডের কর্ণধার সুদীপ্ত সেন, যিনি জেলে আছেন, তিনি বলছেন, ‘আমি পয়সা দিয়ে ছবি কিনিনি’। মুখ্যমন্ত্রী মহোদয়া, যদি আপনার ছবি কেউ পয়সা দিয়ে না কিনে থাকেন, তা হলে আপনার ছবি বিক্রির পয়সা থেকে ত্রাণ তহবিলে যে এক কোটি টাকা জমা দিয়েছিলেন, নন্দীগ্রামের জন্য কয়েক লাখ টাকা দিয়েছিলেন তা এল কোন ফান্ড থেকে?”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy