শিশির বাজোরিয়া
পরিচয়ে শিল্পপতি। হাবে-ভাবে বাঙালি। বন্ধু কমিউনিস্ট পার্টির।
এমন আশ্চর্য এক ইনিংসের ‘বেদনাদায়ক’ সমাপ্তি ঘটছে আজ, শনিবারের বারবেলায়! যখন প্রায় দু’দশকের সিপিএম-সঙ্গ ছেড়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে বিজেপি-তে যোগ দেবেন শিশির বাজোরিয়া। আলিমুদ্দিন এবং দিল্লির এ কে জি ভবনে অনায়াস যাতায়াতে অভ্যস্ত শিশিরকে আজ সাদরে গেরুয়া শিবিরে বরণ করে নেবেন বিজেপি নেতারা। শিশির যাকে বলছেন, “একটা সফরের শেষ। আর একটা যাত্রা শুরু।”
প্রকাশ কারাট থেকে বিমান বসু, সীতারাম ইয়েচুরি থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় থেকে হাসিম আব্দুল হালিম এক ডাকে চেনেন এবং জানেন শিশিরকে। নিজের পেশাগত ব্যস্ততায় বছরের একটা বড় সময় বিদেশে কাটিয়েও তিনি বরাবর থেকেছেন সিপিএমের কাছাকাছি। রাজ্যপাট থেকে সিপিএমের বিদায়ের পরেও তাদের সঙ্গে থাকা শিল্পপতি হিসাবে শিশিরই ছিলেন উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। অধুনা প্রয়াত মার্ক্সীয় ইতিহাসবিদ এরিক হবস্বমের সঙ্গে দেখা করে এসেছেন, এমন কৃতিত্ব গোটা সিপিএমে ক’জন দাবি করতে পারবেন সন্দেহ! শিশির এ সবই ভালবেসে করতেন। আর এখন নানা অভিমানে তিনিই পাট চুকিয়ে দিচ্ছেন বাম রাজনীতিতে!
কেন এমন চমকপ্রদ সিদ্ধান্ত?
আনন্দবাজারকে শিশির বলেছেন, “টি-২০’র চেয়ে প্রথাগত টেস্ট ম্যাচই আমার বেশি পছন্দ। প্রায় দু’দশক ধরে সমস্ত দুর্যোগের মধ্যেও আমি যে ভাবে সিপিএমের সঙ্গে ছিলাম, এ বার সে ভাবেই বিজেপি-র সঙ্গে থাকব। ঝড়, শিলাবৃষ্টি, রোদ যা-ই আসুক!” শিল্প-বন্ধ্যা পশ্চিমবঙ্গের ভাগ্য বদলানো বিজেপি-র পক্ষেই সম্ভব বলে এখন তিনি বিশ্বাস করছেন। ভবিষ্যতে তাঁর ভূমিকা কী হবে, তা নিয়ে বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের সঙ্গে শিশিরের দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। কর্মসূত্রেই দিল্লির অলিন্দে পরিচিত মুখ শিশিরের ঘনিষ্ঠ অরুণ জেটলি, সিদ্ধার্থনাথ সিংহের মতো বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারাও। বিজেপির এক শীর্ষ নেতার কথায়, “সমাজের নানা ক্ষেত্রের মানুষের সঙ্গে এখন আমাদের সংযোগ বাড়ছে। শিশিরবাবুকে সঙ্গে পেয়ে পশ্চিমবঙ্গে দলের বিস্তার আরও ভাল হবে।”
সিপিএম সূত্রের খবর, বিগত লোকসভা নির্বাচনে উত্তর কলকাতা থেকে শিশিরকে প্রার্থী চেয়েছিলেন দলের একাংশ। সে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত তো হয়ইনি, রাজস্থান-বাংলা মৈত্রী পরিষদের হয়ে অবাঙালি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যে আলাপচারিতার আসরের আয়োজন শিশির করেছিলেন, তাতে শেষ মুহূর্তে উপস্থিত হননি ওই কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী রূপা বাগচি। আত্মমর্যাদায় আঘাত পেয়েছিলেন শিশির। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য ও রাজ্যসভার সাংসদ ইয়েচুরি শিশিরের মনোভাব আঁচ করে চেষ্টা করেছিলেন জট কাটানোর। কিন্তু শিশির তাঁকে বলে এসেছেন, তিনি কোনও কালেই সিপিএমের কাছে কিছু চাননি। সিপিএমেরও কিছু দেওয়ার কথা মনে হয়নি। এখন আর এ সব নিয়ে না ভাবাই ভাল!
শিশিরের মতে, ২০০৬ সাল থেকেই এ রাজ্যে কোনও প্রশাসন নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিঙ্গুর থেকে যখন শিল্প-বিরোধী আন্দোলন শুরু করলেন, প্রবল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার কী ভাবে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করে বসল ভাবলে এখনও বিস্মিত হন তিনি! তাঁর কথায়, “ক্ষতিগ্রস্ত হলেন এ রাজ্যের মানুষ। বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারালেন রাজ্যটার উপরে। আর ২০১১-র পর থেকে যেখানে এ রাজ্য তলিয়ে গিয়েছে, সে কথা যত কম বলা যায়, তত ভাল!” এই গভীর হতাশার খাদ থেকে বিজেপি-ই আলো দেখাতে পারে বলে তাঁর মনে হচ্ছে।
বন্ধু-বিদায়ের এই পর্বে ইয়েচুরি মন্তব্য করতে চাননি। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল বলছে, তিনি যারপরনাই মর্মাহত। রাজনৈতিক পথ আলাদা হয়ে গেলেও ব্যক্তিগত সম্পর্কে আঁচ পড়ুক, চান না। “ওঁকে ধরে রাখার আমি কে! যেখানেই যাক, শিশির যেন ভাল থাকে!” ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছেন তিনি।
আর পুত্রসম এক শিল্পপতির পথ পরিবর্তনে অসুস্থ শরীরে সোমনাথবাবুর প্রতিক্রিয়া, “ওর বাবাকে চিনতাম। সুযোগ নেওয়ার জন্য রাজনীতি করবে, এমন ছেলে শিশির নয়। শুনছিলাম, ইদানীং পার্টি ওকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। এই সিদ্ধান্ত যদি নিয়ে থাকে, সে তো ওর নিজস্ব ব্যাপার। আর কত কিছু যে দেখে যেতে হবে!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy