সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে নেমে এ বার খোদ শাসক দলের সদর দফতরে পৌঁছে গেলেন এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)-এর তদন্তকারীরা।
তৃণমূলের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক শঙ্কুদেব পণ্ডাকে জেরা করার নোটিস ধরাতে মঙ্গলবার দুপুরে তৃণমূলের সদর দফতর তৃণমূল ভবনে যান তদন্তকারীরা। আগামী সোমবার, ২৯ ডিসেম্বর শঙ্কুকে ইডি দফতরে ডেকে পাঠানো হয়েছে।
সারদা কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে ইতিমধ্যেই সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন তৃণমূলের সহ-সভাপতি রজত মজুমদার, দলীয় মুখপত্রের সম্পাদক-সাংসদ সৃঞ্জয় বসু এবং রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র। জেরা করা হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ চিত্রশিল্পী শুভাপ্রসন্নকেও। শেষ পর্যন্ত এ দিন শঙ্কুকে নোটিস দিতে ইডি একেবারে তৃণমূলের সদর দফতরে পৌঁছে গিয়েছে। বস্তুত রাজ্যে কোনও আর্থিক কেলেঙ্কারির তদন্তে এ ভাবে কোনও রাজনৈতিক দলের অফিসে তদন্তকারীদের যাওয়াটা নজিরবিহীন।
শঙ্কু শুধু তৃণমূলের উঠতি নেতাদের অন্যতম নন, মমতার অত্যন্ত প্রিয়পাত্রদেরও এক জন। তৃণমূল সূত্রেরই খবর, তৃণমূল নেতাদের মধ্যে এক মাত্র শঙ্কুই ‘পিসি’ বলে ডাকেন মমতাকে। তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে এই সম্পর্কের জেরেই একটি চ্যানেলের জেলা সাংবাদিক পদ থেকে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে দলের শাখা সংগঠনের শীর্ষ স্তরে পৌঁছে যান শঙ্কু। সেখান থেকে দ্রুত তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (টিএমসিপি) সভাপতিও হন তিনি। বিরোধীদের অভিযোগ, শঙ্কুর আমলেই রাজ্যের বিভিন্ন কলেজে অধ্যক্ষ-শিক্ষক নিগ্রহ থেকে শুরু করে নানা রকম তাণ্ডব শুরু করে টিএমসিপি। তৃণমূলের একাংশের বক্তব্য, বস্তুত এই সময় থেকে ‘শঙ্কু স্যার’ এতটাই ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন যে, তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুও তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। বরং শঙ্কুর আপত্তি না মেনে রাজ্যের কলেজগুলিতে ‘অনলাইন’-এ ভর্তির ব্যবস্থা চালু করতে গিয়ে পদ খোয়াতে হয় তাঁকে। পরবর্তী কালে ছাত্রনেতার পদ থেকে ‘প্রমোশন’ পেয়ে তৃণমূলের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক হন শঙ্কু।
শঙ্কুর দিকে কেন নজর দিয়েছে ইডি? ইডি সূত্রের খবর, শঙ্কুর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সারদা থেকে প্রতি মাসে প্রচুর টাকা ঢুকেছে। ঘটনাচক্রে, শঙ্কু প্রথমে সারদার ‘চ্যানেল ১০’-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে মমতা-ঘনিষ্ঠ চিত্রশিল্পী শুভাপ্রসন্নর চালু না হওয়া সংবাদ চ্যানেল ‘এখন সময়’-এ (পরে যে চ্যানেলটি কিনে নেন সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেন) তিনি ‘ইনপুট এডিটর’ হিসেবে নিযুক্ত হন। এই চ্যানেলে দায়িত্বে ছিলেন আর এক তৃণমূল ব্যক্তিত্ব, বর্তমান সাংসদ অর্পিতা ঘোষ। তাঁকেও ইতিমধ্যেই জেরা করেছে ইডি। তদন্তকারীদের একাংশের বক্তব্য, মোটা বেতন ছাড়াও সারদা থেকে আরও বহু টাকা পেয়েছেন শঙ্কু। কী বাবদ ওই টাকা তিনি নিয়েছেন, তা জানতেই শঙ্কুকে জেরা করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন ইডি-র তদন্তকারীরা।
কিন্তু সেই জেরার চিঠি দিতে কেন একেবারে ইএম বাইপাসের তৃণমূল ভবনে পৌঁছে গেলেন ইডি-র তদন্তকারীরা? ইডি-র তদন্তকারীদের ব্যাখ্যা, শঙ্কুর বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুরের আঠিলাগোড়ি এলাকায়। কিন্তু কলকাতায় তিনি থাকেন তৃণমূল ভবনেই। বিশ্বস্ত সূত্রে এই তথ্য জানতে পেরেই এ দিন দুপুর ২টা ৪৫ মিনিট নাগাদ তদন্তকারীরা পৌঁছে যান সেখানে। দফতরে ঢুকে শঙ্কুর খোঁজ করতেই তৃণমূলকর্মীরা তদন্তকারীদের জানান, শঙ্কু এখন দফতরে নেই। তিনি কখন দফতরে আসবেন, তদন্তকারীরা তা জানতে চাইলে ওই তৃণমূল কর্মীরা বলতে পারেননি। তখন তদন্তকারীরা ওই কর্মীদের শঙ্কুর নোটিসটি নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু তাতে রাজি হননি তৃণমূল কর্মীরা। বাধ্য হয়ে সল্টলেকের সিজিও দফতরে ফিরে আসেন তদন্তকারীরা। সূত্রের খবর, এর মধ্যে তৃণমূল কর্মীরা শঙ্কুকে টেলিফোনে বিষয়টি জানান। তখন শঙ্কু নিজেই যোগাযোগ করেন ইডি-র তদন্তকারীদের সঙ্গে। শঙ্কুর দেওয়া একটি নম্বরে ফ্যাক্স করে নোটিসটি পাঠিয়ে দেন তদন্তকারীরা। ওই নোটিসটি কি পেয়েছেন শঙ্কু? এ ব্যাপারে শঙ্কু কোনও মন্তব্য না করলেও তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রের খবর, তিনি নোটিস পেয়েছেন। আগামী সোমবার তিনি ইডি-র দফতরে হাজির হবেন বলে তাঁর ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন। তবে এ দিন ইডি-র তদন্তকারীরা যে ভাবে সংবাদমাধ্যমকে সঙ্গে নিয়ে শঙ্কুকে নোটিস ধরাতে দলের সদর দফতরে গিয়েছেন, তাতে ক্ষুব্ধ তৃণমূলের একাংশ।
শঙ্কুদেব পণ্ডার পাশাপাশি ইডি এ দিন হাজিরার নোটিস পাঠিয়েছে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মাতঙ্গ সিংহকেও। ইডি-র বক্তব্য, বার বার তলব করা সত্ত্বেও তাঁদের সামনে হাজির হননি মাতঙ্গ। এই প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সম্পত্তি এবং সারদার সঙ্গে লেনদেন সংক্রান্ত পর্যাপ্ত তথ্যও হাতে পাননি তদন্তকারীরা। দিল্লিতে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে মাতঙ্গের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট ছাড়াও তিনটি সংস্থার অ্যাকাউন্ট এবং দু’টি সম্পত্তি ব্যবহার বা কেনাবেচা সাময়িক ভাবে বন্ধ করতে উদ্যোগী হল ইডি। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চিঠিও পাঠিয়েছে তারা।
একই ভাবে সারদাকাণ্ডে গ্রেফতার হওয়া তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ সৃঞ্জয় বসু, তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ চিত্রশিল্পী শুভাপ্রসন্ন, শিবা নামের একটি বেসরকারি সংস্থা এবং এক প্রবীণ সাংবাদিকের নির্দিষ্ট কিছু সম্পত্তি এবং কয়েকটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে লেনদেন সাময়িক ভাবে বন্ধ করতে সক্রিয় হয়েছে ইডি। দাবি, একাধিক বিষয়ে তথ্য না পাওয়াতে ওই সব অ্যাকাউন্টে আপাতত লেনদেন বন্ধ রাখার কথা ভাবা হয়েছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চিঠিও পাঠিয়েছে তারা।
এ দিন কলকাতার একটি ক্যাসেট প্রস্তুতকারক সংস্থার প্রতিনিধিদেরও ডেকে পাঠিয়েছিল ইডি। তাদের কাছ থেকে সারদার সঙ্গে লেনদেন সংক্রান্ত তথ্য চাওয়া হয়েছে বলে ইডি সূত্রের খবর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy