আগামী বছর কলকাতা পুরসভা নির্বাচন এবং ২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে বিজেপিকেই প্রধান রাজনৈতিক বিকল্প করে তোলার চেষ্টা চালাবেন তিনি। কিন্তু তার পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে রাজ্যের উন্নয়ন নিয়েও আলোচনা করতে চান ভাবী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেই কারণে মমতাকে রাজধানীতে আসার জন্য আমন্ত্রণও জানিয়েছেন তিনি।
আজ গুজরাত ভবনে পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন ভাবনা নিয়ে কথা প্রসঙ্গে আনন্দবাজারকে মোদী বলেন, “৩৪ বছরে সিপিএম কেন্দ্রের থেকে যে সহায়তা পায়নি, গত তিন বছরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে সাহায্য পাননি, আমি পশ্চিমবঙ্গকে তার থেকে বেশি সহায়তা দিতে চাই। উন্নয়ন নিয়ে কোনও রাজনীতি নয়। কেন্দ্র ও রাজ্যের ভিতরে জটিলতা নিরসনের জন্য আলোচনা করতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিল্লিতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।”
মোদী এ দিন জানান, প্রত্যেকটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেই তিনি সুসম্পর্ক চান। যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারত গঠন সহজ করতে এই সাংবিধানিক সম্পর্কের হৃত মর্যাদা ফেরাতে তিনি আগ্রহী। নির্বাচনী প্রচারের সময়ও মোদী এক বার বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নটা তিনি করতে চান রাজ্যের মানুষের জন্য। এটা কোনও দল বা সরকারের ব্যাপার নয়। তৃণমূল এবং বিজেপির রাজনৈতিক বিরোধ যা-ই থাকুক, উন্নয়নের প্রশ্নে তিনি আপস করবেন না। প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হতে যাওয়ার প্রাক্কালেও সেই অবস্থান বদল করেননি মোদী।
“৩৪ বছরে সিপিএম যে সহায়তা পায়নি, গত তিন বছরে মমতাও যা চেয়ে পাননি,
পশ্চিমবঙ্গকে আমি তার থেকে বেশি সাহায্য করতে চাই।”
নরেন্দ্র মোদী
প্রশ্ন হচ্ছে, ভাবী প্রধানমন্ত্রী মমতাকে ‘রাজনৈতিক ভাবে অস্পৃশ্য’ বলে মনে না করলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কি তাঁর সঙ্গে বৈঠক করতে প্রস্তুত?
মোদীর নেতৃত্বে বিজেপির বিপুল জয়ের পর বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ পর্যন্ত বলেছেন, মানুষের দেওয়া এই জনাদেশকে সম্মান করা উচিত। মমতা কিন্তু এখনও পর্যন্ত মোদীকে শুভেচ্ছা জানাননি। যে আমেরিকা এই সে দিনও মোদীকে ভিসা দিতে রাজি ছিল না, তার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা পর্যন্ত তাঁকে ফোন করে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন! কিন্তু মমতা জানাননি। তবে এও ঠিক, এই জয়ের পর মোদীর বিরুদ্ধে নতুন করে কোনও বিবৃতিও দেননি মমতা।
অটলবিহারী বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেছিলেন, এই সরকার বর্বর এবং অসভ্যের সরকার। এই সরকারের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ রাখব না। কিছু দিনের মধ্যেই সিপিএম বুঝতে পারে, ভারতের মতো একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারকে বয়কট করে কোনও মুখ্যমন্ত্রী তাঁর সরকার চালাতে পারেন না। নির্বাচন কমিশন দ্বারা স্বীকৃত একটি দল, নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে জেতা একটি দল, সংসদে জোরালো উপস্থিতি নিয়ে থাকা একটি দল যখন সরকার গড়ে, তখন তাকে সম্পূর্ণ বয়কট করে কোনও রাজ্য সরকার চলতে পারে না। তত্কালীন উপমুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রথমেই সেটি বুঝেছিলেন। মূলত তাঁর উদ্যোগেই বেশ কিছু দিন পর বুদ্ধবাবুকে সঙ্গে নিয়ে তত্কালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবাণীর সঙ্গে দেখা করেন জ্যোতিবাবু। বুদ্ধবাবুর সঙ্গে আডবাণীর আলাপও করিয়ে দেন তিনি। তার পর থেকে আডবাণীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলতেন বুদ্ধবাবু। মতাদর্শগত বিরোধ থাকলেও নীতিগত এবং সাংবিধানিক সম্পর্ককে কখনওই মলিন হতে দেননি। উল্টে রাজ্যের উন্নয়নের জন্য বুদ্ধবাবুর চাপে আডবাণী বেশ কিছু বেনজির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এক বার তো গ্যাস অথরিটি অব ইন্ডিয়া লিমিটেড (গেল) যাতে হলদিয়া ছেড়ে গুজরাতে চলে না যায়, সে জন্য বুদ্ধবাবুর অনুরোধে নিজে ময়দানে নামেন আডবাণী। বুদ্ধবাবুকে দিল্লিতে ডেকে পাঠিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে বসে তত্কালীন পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী রাম নায়েক ও ‘গেল’-এর অফিসারদের সঙ্গে নিয়ে বৈঠক করেন তিনি। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় গুজরাতে নয়, হলদিয়াতেই থাকবে ‘গেল’। এটা সম্ভব হয়েছিল বুদ্ধবাবুর সঙ্গে আডবাণীর ব্যক্তিগত সম্পর্কের জন্যই।
রাজ্যের উন্নয়নের স্বার্থে কেন্দ্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এগোনোর পথে হেঁটেছেন আরও অনেক মুখ্যমন্ত্রীই। এ বারের নির্বাচনেই পুরনো বন্ধুত্ব ভুলে মোদীর সঙ্গে তরজায় মেতেছিলেন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা। কিন্তু ভোট মিটতেই কেন্দ্রের সঙ্গে সমন্বয় বজায় রেখে কাজ করার কথা বলেছেন তিনি। তার পরেই আজ মোদী নিজে ফোন করেন জয়ললিতাকে। দু’জনের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে কথাও হয়েছে।
প্রশ্ন হল, মমতা কী করবেন?
বাজপেয়ী জমানায় কেন্দ্রে মন্ত্রী ছিলেন মমতা। বাজপেয়ীকে চাপ দিয়ে প্রমোদ মহাজন এবং সুধীন্দ্র কুলকার্নির মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের জন্য বেঙ্গল প্যাকেজ ঘোষণা করিয়েছিলেন। ব্রিগেডে দাঁড়িয়ে তত্কালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রমোদ মহাজন সেই প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন। একদা রাজ্যের প্রতি বঞ্চনা, মাসুল সমীকরণ নীতি প্রভৃতি বিষয় নিয়ে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছিল সিপিএম। মমতাও মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর রাজ্যের উন্নয়ন নিয়ে মনমোহন সিংহ সরকারের সঙ্গে কম সংঘাতে যাননি।
এখন মোদী যুগে মমতা কি প্রাক্-নির্বাচনী রাজনৈতিক বিবাদকে পাশে সরিয়ে রেখে উন্নয়ন ও প্রশাসনের প্রশ্নে মোদী সরকারের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করবেন? মোদী চাইলেও মমতা তাতে কী ভাবে সাড়া দেবেন? এই প্রশ্নের জবাবে মমতা এখনও নিরুত্তর। প্রসঙ্গত এ দিনই মমতার অবস্থানের সমালোচনা করে আসানসোলের বিজেপি সাংসদ বাবুল সুপ্রিয় বলেন, “মমতারও উচিত ছিল জয়ললিতার মতো কেন্দ্রের সঙ্গে সহযোগিতার বার্তা দেওয়া।” একই সঙ্গে তাঁর কটাক্ষ, “পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনী প্রচারে যে ভাবে মোদীজিকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে পরিবেশ বিষিয়ে দিয়েছেন, তাতে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে।”
অথচ মোদীর তরফে সম্পর্কটা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টায় ত্রুটি ছিল না বলেই জানিয়েছেন বিজেপির একাধিক শীর্ষ নেতা। বিজ্ঞান ভবনে জাতীয় উন্নয়ন পরিষদের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মোদী, মমতা দু’জনেই। সেখানে মমতার সঙ্গে নিজে গিয়ে কথা বলেন মোদী। ২০১২ সালে গুজরাত নির্বাচনে বিপুল জয়ের পরে নিজের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে মমতাকে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ করে চিঠি পাঠিয়েছিলেন মোদী। অখিলেশ যাদব ও পঞ্জাবে প্রকাশ সিংহ বাদলের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে প্রতিনিধি পাঠালেও মোদীর শপথে কিন্তু কাউকে পাঠাননি মমতা। তার পরেও মোদী পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে মমতার সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু মমতা আগ্রহী ছিলেন না। সেই কারণে মোদী পশ্চিমবঙ্গে গেলেও মমতার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেননি। বৈঠক না করলেও মোদী কলকাতায় গিয়ে মমতার প্রশংসাই করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সিপিএম ৩৪ বছরে যে গর্ত তৈরি করেছে, তা বোজানো এত তাড়াতাড়ি সম্ভব নয়। গুজরাতে কংগ্রেসের তৈরি করা গর্ত ভরাট করতে তাঁর দশ বছর লেগেছে। মমতার আরও বেশি সময় দরকার। উত্তরপ্রদেশে গিয়েও তিনি বলেছিলেন, মুলায়ম-মায়াবতী যে কারণে কংগ্রেসকে সমর্থন করেন, সেই বাধ্যবাধকতা মমতার নেই। যদিও পরের দিকে নির্বাচনী প্রচারে মমতা সম্পর্কে অবস্থান বদল করেন মোদী। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, মমতা সম্পর্কে অনেক কিছু জানতেন না। জানার পর মত বদল হয়েছে।
মোদী এবং মমতার তরজা এ বারের নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে এক অন্য রকম পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। সিপিএম তিন বছরে যা পারেনি, মোদী তা-ই করতে পেরেছেন। সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে হইচই বাধিয়ে সেটিকে প্রচারের অন্যতম হাতিয়ার বানিয়ে ফেলেন তিনি। এ বারের ভোটে মোদী পশ্চিমবঙ্গে মানুষের কাছে এই প্রত্যাশাও তৈরি করেছেন, তিনি সারদা কাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত করাবেন। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পর মোদী বলেছেন, তিনি ক্ষমতায় এলে এ ব্যাপারে তদন্ত চালিয়ে সত্য উদ্ঘাটিত করবেন। ফলে অনেকেই মনে করছেন, মোদী সরকারের পক্ষে সারদা কাণ্ডে সিবিআই তদন্তকে লঘু করে ফেলার সম্ভাবনা নেই। সুপ্রিম কোর্টে রাজ্য সরকারের আনুষ্ঠানিক অবস্থান ছিল, যাতে এই তদন্ত সিবিআইকে দিয়ে না করানো হয়। এখন মমতা কী করেন, সেটাই দেখার। মোদীর অনুরোধ, রাজনৈতিক মতপার্থক্য যাই থাকুক, মমতা যেন বয়কটের রাজনীতির পথে না হেঁটে আলোচনার টেবিলে বসে কথা বলার রাজনীতির পথেই এগোন। মোদীর কথায়, “আশা করি, উন্নয়ন নিয়ে কোনও ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি করা হবে না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy