Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
ফের প্রশ্ন লগ্নির পরিবেশ নিয়ে

রাজ্যের চাপে জমি ফেরাচ্ছে জিন্দলরা

দীর্ঘ টানাপড়েনের পর শেষ পর্যন্ত রাজ্যের সঙ্গে আপোসের পথেই হাঁটতে বাধ্য হল জিন্দলরা। জানিয়ে দিল, শালবনি প্রকল্পের জন্য জমির মালিকদের কাছ থেকে সরাসরি কেনা ২৯৪ একর বিনা পয়সায় ফিরিয়ে দেবে তারা। অথচ ওই জমি কিনতে প্রায় ৯ কোটি টাকা উপুড় করেছিল সজ্জন জিন্দলের সংস্থা। প্রকল্পের জন্য এখনও পর্যন্ত খরচ করেছে ৭০০ কোটি। তার পরেও যদি সংস্থাকে রাজ্যের সঙ্গে স্রেফ ‘শান্তি বজায়’ রাখতে এ ভাবে জমি ফেরাতে হয়, তা হলে সেখানে বিনিয়োগ করতে আর কেউ আসবে কেন, সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে শিল্পমহলে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:৩৯
Share: Save:

দীর্ঘ টানাপড়েনের পর শেষ পর্যন্ত রাজ্যের সঙ্গে আপোসের পথেই হাঁটতে বাধ্য হল জিন্দলরা। জানিয়ে দিল, শালবনি প্রকল্পের জন্য জমির মালিকদের কাছ থেকে সরাসরি কেনা ২৯৪ একর বিনা পয়সায় ফিরিয়ে দেবে তারা। অথচ ওই জমি কিনতে প্রায় ৯ কোটি টাকা উপুড় করেছিল সজ্জন জিন্দলের সংস্থা। প্রকল্পের জন্য এখনও পর্যন্ত খরচ করেছে ৭০০ কোটি। তার পরেও যদি সংস্থাকে রাজ্যের সঙ্গে স্রেফ ‘শান্তি বজায়’ রাখতে এ ভাবে জমি ফেরাতে হয়, তা হলে সেখানে বিনিয়োগ করতে আর কেউ আসবে কেন, সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে শিল্পমহলে। শাসক দলের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য বিনিয়োগকে এ ভাবে হাঁটু গাড়তে দেখে তারা আতঙ্কিত।

প্রকল্পের কাজ সময়ে না-হওয়ার অভিযোগে ওই জমি বেশ কিছু দিন ধরেই জিন্দলদের ফিরিয়ে দিতে বলছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। চাপ বাড়ছিল সংস্থার উপর। ইতিমধ্যেই ঢেলে ফেলা ৭০০ কোটি টাকা আর প্রকল্প হওয়ার সম্ভাবনাটুকু বাঁচাতে সেই চাপের কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হল জিন্দল গোষ্ঠী।

সোমবার নবান্নে সাংবাদিক সম্মেলন করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, জিন্দলদের প্রকল্পে অনেক দিন হব-হব করেও কিছুটা কাজ হয়েছে। বাকিটা হয়নি। এই পরিস্থিতিতে শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্রের সাথে জিন্দলদের কথা হয়েছে। তারা জানিয়েছে, যে জমি মালিকদের কাছ থেকে সরাসরি কেনা হয়েছিল, তা তারা ফিরিয়ে দিচ্ছে। মালিকদের এ জন্য ক্ষতিপূরণের টাকা ফেরাতে হবে না। এই পুরো প্রক্রিয়ার জন্য জেলা শাসকের অধীনে কমিটি গড়ছে রাজ্য।

মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “এটা ওঁদের মহানুভবতা যে, ওনারা জণগণের জমি ফেরত দিচ্ছেন। আমি তাঁদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। অভিনন্দন জানাচ্ছি এ রকম সাহসী (বোল্ড) সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। এটা খুব বড় ব্যাপার যে, জমিটা ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা একটা বড় বার্তা (ইটস আ বিগ মেসেজ)।” এই প্রসঙ্গে সিঙ্গুরের জমির সঙ্গে শালবনি প্রকল্পের তুলনা করেন তিনি। মমতার দাবি, সিঙ্গুরেও এই একই রকম ভাবে জমি ফেরত চেয়েছিল তাঁর সরকার।

জে এস ডব্লিউ বেঙ্গলের কর্তা বিশ্বদীপ গুপ্ত জানান, প্রকল্প চালু হতে দেরি হচ্ছে বলে ওই জমি ফিরিয়ে দেওয়া হবে। তবে যে জমি কেনা হয়েছে, সেই জমিই ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না। কারণ, তাতে ভবিষ্যতে প্রকল্প তৈরির সময় সমস্যা হবে। সে ক্ষেত্রে প্রকল্প এলাকা থেকে সম পরিমাণ জমি ফেরানো হবে।

কিন্তু ঠিক এখানেই সিঁদুরে মেঘ দেখছে রাজ্যের শিল্পমহল। আতঙ্কিত হচ্ছে, রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য বিনিয়োগের গন্তব্য হওয়ার প্রাথমিক শর্তটুকুও এ ভাবে জলে ভাসাতে দেখে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিল্পকর্তার কথায়, “জিন্দলদের এ ভাবে আপোস করতে হচ্ছে। তা-ও সেখানে ৭০০ কোটি টাকা খরচ করার পর! এই ঘটনা দেখে রাজ্যে শিল্পের পরিবেশ নিয়ে সংশয় আরও গভীর হবে অন্য লগ্নিকারীদের। বণিকসভার এক কর্তার আশঙ্কা, “জমি নিয়ে রাজ্যের অবস্থান এমনিতেই শিল্পের কাছে অস্বস্তির কারণ। তার উপর এ ভাবে জমি ফেরানো হলে, বড় বিনিয়োগ আসা বন্ধ হবে।”

প্রসঙ্গত গত সপ্তাহেই কলকাতায় এসে রাজ্যের জমিনীতির কড়া সমালোচনা করে গিয়েছেন শিল্পপতি আদি গোদরেজ। বলেছেন, রাজ্যে শিল্পায়নের পথে তা বড় বাধা। প্রশ্ন তুলেছেন, যেখানে প্রতিটি রাজ্যই লগ্নি টানার প্রতিযোগিতায় নেমেছে, সেখানে এমন শিল্পবিরোধী জমিনীতি নিয়ে এগোনো কী ভাবে সম্ভব? বলে গিয়েছেন, “রাজ্য সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন।”

শালবনির ইস্পাত প্রকল্প নিয়ে তৃণমূল-সরকারের সঙ্গে জিন্দলদের সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে বেশ কিছু দিন ধরেই। তৈরি হয়েছে জমি-জটিলতা। প্রকল্প তৈরির জন্য প্রয়োজন ছিল মোট ৪,৩৩৪ একর জমি। তার মধ্যে ২৯৪ একর জমি মালিকদের কাছ থেকে সরাসরি কিনেছিল সংস্থা (বাকিটা পতিত জমি)। এই জমিই জিন্দলরা ফিরিয়ে দেবে বলে এ দিন জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। উল্লেখ্য, জমির ঊর্দ্ধসীমা আইন অনুযায়ী শিল্পের জন্য বাড়তি জমি রাখতে ১৪-ওয়াই ধারায় আবেদন আবেদন করে ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের অনুমোদন নিতে হয়। ২৯৪ একর কেনার আগে সংস্থা তা না-নেওয়ায় লিজ চুক্তি আটকে গিয়েছিল। কিন্তু পরে শিল্প দফতরের হস্তক্ষেপে সেই সমস্যা মেটে।

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে কয়লা ব্লক বাতিল হওয়ার পর শালবনি প্রকল্পে কয়লা জোগানো মুশকিল হয়ে পড়েছে জিন্দলদের পক্ষে। চিন-সহ বিশ্বজুড়ে এই মুহূর্তে তলানিতে ইস্পাতের চাহিদাও। কিন্তু এই সব কিছু সত্ত্বেও শিল্পমহল মনে করছে, জিন্দলদের এই মূল্য চোকাতে হল নিখাদ রাজ্যের সঙ্গে শান্তি বজায় রাখার লক্ষ্যেই। কারণ, মুখ্যমন্ত্রী বা তাঁর দলীয় প্রতিনিধিরা সম্প্রতি শালবনি এলাকায় যতবার জনসভা করেছেন, ততবার প্রকল্প চালু না-করতে পারার জন্য তোপ দেগেছেন জিন্দলদের বিরুদ্ধে। যে কারণে শেষ পর্যন্ত তিতিবিরক্ত সজ্জন জিন্দল গত মাসের শেষে কলকাতায় এসে কয়লা ও আকরিক লোহা জোগানের সমস্যার জন্য শালবনি প্রকল্প স্থগিত রাখার কথা জানান। তবে একই সঙ্গে ঠারেঠোরে রাজ্যের সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক গড়িমসিকেও তখন দায়ী করেছিলেন জিন্দল গোষ্ঠীর কর্ণধার।

জিন্দলের কাছে প্রশ্ন ছিল, ইস্পাত কারখানার সঙ্গে শালবনিতে যে বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ার কথা ছিল, খনি হাতে থাকাকালীন তা চালু করেননি কেন? জবাবে তাঁর ইঙ্গিত ছিল, সরকারি বাধা-নিষেধের কারণেই তা সম্ভব হয়নি। বস্তুত, প্রথমে ইস্পাত কারখানার জন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির কথা থাকলেও পরে রাজ্যেরই অনুরোধে জিন্দল গোষ্ঠী জানিয়েছিল, শালবনিতে তাদের বিদ্যুৎ সরকার কেনার প্রতিশ্রুতি দিলে, অন্তত সেই প্রকল্পের কাজ দ্রুত শুরু করবে তারা। সংস্থা চেয়েছিল, প্রথমে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালুর জন্য এই সহযোগিতাটুকু করুক রাজ্য। সেখানে তৈরি বিদ্যুৎ কেনার আশ্বাস দিয়ে নতুন করে সই করুক চুক্তিপত্রে (পাওয়ার পারচেজ এগ্রিমেন্ট)। কিন্তু সেই প্রস্তাবে নারাজ বিদ্যুৎ দফতরের বক্তব্য ছিল, ওই বিদ্যুৎ বরং বাণিজ্যিক ভাবে অন্যত্র বিক্রি করুক জিন্দলরা।

এই জমি ফেরতকে প্রত্যাশিত ভাবেই রাজনৈতিক জয় হিসেবে দেখাতে চেয়েছে রাজ্য। মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, অনেকে জমি দিয়ে চাকরির আশায় বসে আছেন। ফলে যতক্ষণ কারখানা না হচ্ছে, জমি ফেরত পেলে ততক্ষণ অন্তত তা ব্যবহার করতে পারবেন তাঁরা। কিন্তু জমি ফেরতের সিদ্ধান্ত আদপে জল ঢেলে দিয়েছে স্থানীয় গ্রামবাসীদের আশায়। তাঁদের আশঙ্কা,

শালবনি জেএসডব্লিউ বেঙ্গল স্টিল লিমিটেড ল্যান্ড লুজার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন-এর সম্পাদক পরিষ্কার মাহাতো বলেন, “আমাদের সরাসরি কেউ এ কথা জানায়নি। তাই আন্দোলন চলবে। তা ছাড়া, কোন শর্তে জমি ফেরানো হবে, তা দেখতে হবে।”

অন্য বিষয়গুলি:

zindal steel shalbani sajjan steel
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE