Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

মমতার প্রকল্প বুঝেই প্রতাপ কমলো প্রতাপের

চেতলা-আলিপুর অঞ্চলে একশোরও বেশি সংগঠনের সভাপতি তিনি। শুক্রবার আলিপুর থানায় হামলাকারী বিধানচন্দ্র রায় কলোনি কমিটিও সেই তালিকাতেই পড়ে। আলিপুর থানায় হামলার ঘটনায় তাঁর দিকে অভিযোগের আঙুল ওঠার পরেও এফআইআর দায়ের না করে পরিস্থিতি ‘কন্ট্রোল’ করতে তাঁকেই ডেকে পাঠান ওসি! ‘বেইজ্জত’ হওয়ার কিছু ক্ষণ পরে তাঁর সঙ্গেই এক টেবিলে বসে বৈঠক করে পুলিশ। এমনই ‘প্রতাপ’!

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০১৪ ০২:২৮
Share: Save:

চেতলা-আলিপুর অঞ্চলে একশোরও বেশি সংগঠনের সভাপতি তিনি। শুক্রবার আলিপুর থানায় হামলাকারী বিধানচন্দ্র রায় কলোনি কমিটিও সেই তালিকাতেই পড়ে। আলিপুর থানায় হামলার ঘটনায় তাঁর দিকে অভিযোগের আঙুল ওঠার পরেও এফআইআর দায়ের না করে পরিস্থিতি ‘কন্ট্রোল’ করতে তাঁকেই ডেকে পাঠান ওসি! ‘বেইজ্জত’ হওয়ার কিছু ক্ষণ পরে তাঁর সঙ্গেই এক টেবিলে বসে বৈঠক করে পুলিশ। এমনই ‘প্রতাপ’!

তিনি দক্ষিণ কলকাতা যুব তৃণমূলের সম্পাদক প্রতাপ সাহা। পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। শুক্রবার আলিপুর থানায় বিধানচন্দ্র রায় কলোনির বাসিন্দাদের হামলার পিছনে তিনি রয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠার পর থেকে বেশ ‘ব্যাকফুটে’। তাই বিধানচন্দ্র রায় কলোনির জমির দখল নিয়ে অনড় মনোভাব ছেড়ে শনিবার চেতলা এলাকার একটি রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে বললেন, “সরকারি জমি দখল করে কাজ আটকানো বেআইনি কাজ। সরকারি জমিতে সরকারি কাজই হবে। থানায় হাঙ্গামা করাও উচিত হয়নি।”

কিন্তু কেন তাঁর এই রাতারাতি ভোলবদল? তৃণমূলের এক শীর্ষস্থানীয় নেতা বলেছেন, ফিরহাদ হাকিমের মাধ্যমে প্রতাপকে বোঝানো হয়েছে যে, এই প্রকল্পের পিছনে রয়েছেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই এ নিয়ে আন্দোলন করলে ফল ভাল হবে না। নেত্রীর মনোভাব বুঝে সরে এসেছেন ববিও। অথচ, আগে তিনিই দু’কাঠা করে জমি পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বলে জানান ওই কলোনির একাধিক বাসিন্দা। নেত্রীর মনোভাব আগে বুঝতে পারেননি ববি। তাই প্রতাপও অন্য সব জায়গার মতোই নেমে পড়েছিলেন মারমুখী আন্দোলনে। এখন দলনেত্রীর কথায় ববি রাশ টেনেছেন। তাই প্রতাপের প্রতাপে টান! এখন ববিও বলছেন, তিনি কখনওই দু’কাঠা করে জমি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেননি।

এবং আশ্চর্য! আজ সুর বদলে গিয়েছে ওই কলোনির বেশির ভাগ বাসিন্দারও। শুক্রবারের ঘটনার পরে সবাই এখন দায় এড়াতে ব্যস্ত। মুখে বলছেন, ‘আর অশান্তি চাই না।’ এমনকী যে জমি নিয়ে ঘটনার সূত্রপাত, সেই জমিও আর চাইছেন না বিধানচন্দ্র রায় কলোনির বাসিন্দাদের একাংশ। এ দিন কলোনি কমিটির কার্যকরী সভাপতি রবীন্দ্রকুমার মহান্তি বলেন, “ওখানে সরকারি আবাসন-ই হোক। উত্তেজনা চাই না। শান্তি চাই।”

কলোনি কমিটির সভাপতির ‘প্রতাপ’ যে ধাক্কা খেয়েছে, তা বুঝেই সুর বদলেছে তাঁদের। এ দিন সকাল থেকেই থম মেরে গিয়েছে আলিপুরের অতিরিক্ত জেলাশাসকের বাংলো লাগোয়া ওই কলোনি। জমির পাশে বসানো হয়েছে পুলিশ পিকেট। শুক্রবারের ঘটনা নিয়ে কেউই মুখ খুলতে আগ্রহী নন। এক মহিলা বললেন, কাল রাতে পুলিশ এসেছিল। দশ জনকে থানায় নিয়ে যায়। মাঝ রাতের পর ছেড়েছে। তবে তাঁরা অতিরিক্ত জমি পাওয়ার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন। কলোনি কমিটির সম্পাদক নগেন্দ্রনাথ পাণ্ডে বলেন, “প্রতাপ সব জানে। ববিদার সঙ্গেও ওর কথা হয়েছে।” পুরমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার কথা স্বীকার করেছেন প্রতাপও। কিন্তু কী কথা হয়েছে, সেই প্রশ্ন করতেই হাসিমুখে এড়িয়ে গেলেন তিনি। কলোনির মানুষ অবশ্য আঁচ করতে পেরেছেন, কী কথা হয়েছে। তাই মুখে কুলুপ তাঁদের।

কিন্তু প্রতাপের মতো তৃণমূল নেতারাই তো জঙ্গি আন্দোলন করে আটকে দিয়েছেন অসংখ্য সরকারি প্রকল্প। তা সে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্প হোক বা ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের কাজ। কোনও ক্ষেত্রেই ‘জনস্বার্থ’ বা ‘বেআইনি’ ভেবে আন্দোলন থেকে পিছিয়ে আসেননি। তাই কোটি কোটি টাকা এসেও কাজ হয়নি একাধিক বড় প্রকল্পের। মুখ্যমন্ত্রীর নাম থাকায় সেই তালিকায় ওঠার হাত থেকে বাঁচল আলিপুর!

পরোক্ষে নাম জড়িয়েছে তো প্রতাপের রাজনৈতিক ‘দাদা’ তথা পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমেরও। সেটা বুঝেই ‘দাদা’র পাশে দাঁড়িয়েছেন প্রতাপ। এ দিন তিনি আনন্দবাজারকে বলেন, “অতিরিক্ত জমি দেওয়া নিয়ে ওই কলোনির বাসিন্দাদের কেউ আশ্বাস দেয়নি। তাঁরা একটা দাবি জানান। তা মুখ্যমন্ত্রীকে জানানো হয়।” জমি নিয়ে আন্দোলনের ব্যাপারেও তাঁর সঙ্গে কলোনির লোকেরা কেউ আলোচনা করেনি বলেও দাবি তাঁর। “পরে জানতে পেরেছি। ওসি জানান। ঘটনাস্থলে যাই। আন্দোলনকারীদের শান্ত করি। এর পর পুলিশকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি থানার মধ্যেই”বলছেন প্রতাপ। ভুল বোঝাবুঝির জন্যই শুক্রবার ওই ঘটনা হয়েছে বলে এ দিন তিনি দাবি করেছেন।

পরিস্থিতি শান্ত। কিন্তু ওই জমিতে আবাসন তৈরির কাজ আপাতত বন্ধ। এ দিন পূর্ত দফতরের এগ্জিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার (আলিপুর) ফৈয়াজ আহমেদ দলবল নিয়ে জমি মাপার কাজ শুরু করেন। পরে তিনি বলেন, “কাজ বন্ধ রয়েছে। দফতরের শীর্ষকর্তারা বিস্তারিত রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছেন। সেই রিপোর্ট তৈরির কাজ শুরু হয়েছে।” তবে পুলিশকর্তারা জানিয়েছেন, পূর্ত দফতর চাইলে যে কোনও দিন ওই জমিতে নির্মাণ শুরু করতে পারেন। এ দিন পূর্ত দফতরের সঙ্গে এ নিয়ে বৈঠকে বসার কথা ছিল পুলিশকর্তাদের। কিন্তু পূর্ত দফতর সূত্রের খবর, পুলিশকর্তারা তাঁদের জানিয়েছেন এ দিন বৈঠক হবে না।

থানায় হামলা নিয়ে কী বলেছেন প্রতাপ? তিনি বলেন, “ওই ঘটনার সময়ে ছিলাম না। তবে পুলিশেরও গাফিলতি ছিল। আহত এক মহিলাকে কেন এক ঘণ্টার বেশি থানায় বসিয়ে রাখা হল? এ নিয়ে ডিসি-কে নালিশ করেছি।” কারা হামলা করেছিল? প্রতাপের মন্তব্য, “বহিরাগতরাও ছিল গোলমালে। তারা সিপিএমের।”

প্রতাপ সিপিএমকে দুষলেও তাঁর দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় কিন্তু দায় চাপিয়েছেন স্থানীয় কংগ্রেস নেতা রাকেশ সিংহের উপরে। শুক্রবার ঘটনার পরে রাকেশ থানায় গিয়ে প্রতাপ-সহ অভিযুক্তদের গ্রেফতারের দাবি করেন। এ দিন পার্থবাবু বলেন, “যিনি অভিযোগ করছেন (রাকেশ), তাঁকেই তো পুলিশ খুঁজছে! ববি তো বলে দিয়েছে, কিছুই হয়নি!”

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE